স্বপ্নভঙ্গের স্বপ্নযাত্রা: আর কত প্রাণ যাবে?

বছর খানেক আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমিয়েছিল তিনি। সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পথে যাত্রা। ব্রাজিল, গুয়াতেমালা থেকে মেক্সিকো। এরপর সীমান্ত পাড়ি। স্বপ্ন পূরণের ঠিক শেষপ্রান্তে এসে জীবন থেকেই হারিয়ে গেল ছেলেটি। ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায়, দক্ষিণ টেক্সাসের রিও গ্র্যান্ড নদীতে যে মরদেহ মিলেছে সেটি এই স্বপ্নবাজ তরুণের। নাম মাইনুল ইসলাম হৃদয়। এই পরিচয় জানা গেল ৪৮ ঘণ্টা পর। প্রথম আলোর সাহেদ আলমের কল্যাণে।
রিও নদীতে দুই দিনের ব্যবধানে পাওয়া গেছে দুই বাংলাদেশি তরুণের মৃতদেহ। একটি হৃদয়ের। অন্যটি শাহাদাৎ হোসেন নাঈম নামের এক তরুণের। এ মরদেহটি পাওয়া যায় ১২ মে। ১৭ মে ভোরে এ লেখা যখন লিখছি তখন নাঈমেরও পরিচয় পাওয়া গেছে।
১৬ মে দুপুরে, “দেশিজ রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিং—ড্রাম” এর সাংগঠনিক পরিচালক কাজী ফৌজিয়ার মাধ্যমে প্রথমে দুজনের মৃত্যুর খবর পাই। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশি পরিচয় ছাড়া আর কিছু জানা নেই স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সম্বল, একজনের নাম, ছবি আর এক জোড়া জুতা। অন্য জনের ছবি আর হাতে লেখা কয়েকটা ফোন নম্বর। বাংলাদেশি দূতাবাস কিংবা কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো সাহায্য পাননি বলে জানালেন কাজী ফৌজিয়া।
এক বছরের বেশি আগে, একই নদীতে ভেসে গিয়েছিলেন আরমান নামে এক তরুণ। একই কায়দায় তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ শেষে মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ড্রাম। এবারও সে চেষ্টা। ছবি আছে, নামও আছে। কঠিন কাজ হবে না ভেবে ফেসবুকে পোস্ট দিলাম। ইতিমধ্যে সাহেদ আলমও পেয়েছেন একই তথ্য কাজী ফৌজিয়ার কাছ থেকে। তিনি নেমে পড়লেন অনুসন্ধানে। একজনের কাছে পাওয়া হাতে লেখা ফোন নম্বরের সূত্র ধরে মিলল তাঁর পরিচয়। সে তরুণ হচ্ছে হৃদয়। সাহেদ বললেন, কাউকে তার কাছের মানুষের মৃত্যুর খবর দেওয়া সত্যি বেদনার। হৃদয়ের খালাতো ভাই বোরহান উদ্দিন থাকেন ব্রুকলিনে।
হৃদয়ের মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া টেলিফোন নম্বরের সূত্র ধরে খোঁজ পাওয়া যায় বোরহানের। তাঁকে জানানো হয় হৃদয়ের মৃত্যুর খবর। রাতে চার্চ ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউতে কথা হয় বোরহানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, হৃদয়ের জন্ম আর জাতীয়তা সনদের কপি হাতে পাওয়ার এক ঘণ্টা পর পেয়েছেন তাঁর মৃত্যুও খবর। সনদগুলো বাংলাদেশ থেকে তাঁর বাবার পাঠানো। যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে আটক হওয়ার পর এমন সনদের প্রয়োজন হয় বলে এমন আগাম ব্যবস্থা জানালেন বোরহান।
ঢাকা থেকে ১৭ মে ভোরে ফোন হৃদয়ের চাচা আবুল খায়েরের। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অচল হৃদয়ের বাবা। একমাত্র ছেলে বাবা-মার। ছেলের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে নিজের সহায়সম্পত্তি সব বিক্রি করেছেন। এখন সেই ছেলের মৃত্যুতে তার বাবাকেও বাঁচানো দায়—কেঁদে কেঁদে সে কথা জানালেন আবুল খায়ের।
এর আগে, মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড থেকে মামুনুর রশীদ নামের আরেকজনের ফোন। এই দুই তরুণের পরিচয় চেয়ে দেওয়া আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ার হতে হতে কোথাও নজরে গেছে তাঁর। জানালেন ঝাপসা ছবিটা তাঁর ভাতিজা নাঈমের। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির দেউটি ইউনিয়নে বাড়ি এ তরুণের।
হৃদয়ের বয়স ২১ বছর। নাঈমের ১৮ বছর শেষ হলো গত মার্চে। এত অল্প বয়সে বিপৎসংকুল এমন পথ এই দুই তরুণকে পাড়ি দিতে কেন হলো—তাঁদের বয়স জানার পর থেকে এই ভাবনা আমার। এর আগেও এ নদীতে বাংলাদেশিরা মরেছে। শুধু নদী কেন? এ রুটে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। জলে কুমিরে গিলে খেতে পারে, খরস্রোতা নদীতে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা, নৌকা ডুবে মারা পড়ার সম্ভাবনা, জলপথে অজগরের পেটে যাওয়ার আশঙ্কা, অন্য কোনো প্রাণীর হাতে প্রাণও যেতে পারে। এমন বিপদের কথা জেনেও পা বাড়াচ্ছে হাজারো তরুণ।
ঝাঁপিয়ে নদী পেরোনোর এমন দুঃসাহস দেখানো এই অভিযাত্রীদের কেউ বলেন ‘জাম্পার’, আবার বনেবাদাড়ে সব ঝুঁকি মোকাবিলা করার কারণে এদের ‘টারজান’ বলেও ডাকা হয়। “বর্ডার ক্রসার” হচ্ছে এদের আনুষ্ঠানিক পরিচয়। বিশেষণ ভিন্ন হলেও এই তরুণ গোষ্ঠীর সিংহভাগ কিন্তু বাংলাদেশের নোয়াখালী অঞ্চলের বাসিন্দা। আর এদের বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে এসে ওঠেন নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে।
মেক্সিকো পাড়ি দেওয়া অনেকের সঙ্গে আলাপের সময় তাঁরা এ পথে মারাত্মক জীবন-ঝুঁকির কথা বলেন সমসময়। এরপরও কেন এ পথে মানুষের চলাচল বন্ধ হচ্ছে না? তাদেরই উত্তর—স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষা, উন্নত জীবনের হাতছানি! কারও কারও মতে, এ ক্ষেত্রে দেশে অনেকের পরিবার, আর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আত্মীয়স্বজনদের উৎসাহ আর ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। যুক্তরাষ্ট্রের মাটি ছোঁয়ানো পর্যন্ত একেকজনের পেছনে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ডলার খরচে কার্পণ্য নেই প্রবাসীদের। একজন যে পথে গিয়ে সাফল্য পেয়েছে, পঙ্গপালের মতো বাকিরাও সেপথ ধরেছে।
সমৃদ্ধ অঞ্চলের দিকে মানুষের স্রোত তৈরি হয়েছে প্রয়োজন থেকে। অভাব থেকে। অভিবাসনের ইতিহাস এটাই। ধনী দেশে গরিব দেশের মানুষ যাবেই। কিন্তু সে যাত্রায় লাখ লাখ (অন্তত ৩০ লাখ) টাকা কিংবা ৩৫/৪০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে পারার সক্ষমতাকে অভিবাসন বলা যায়? এত এক উচ্চাভিলাষী অভিযাত্রা! এমন উচ্চাভিলাষের সঙ্গে জীবনধারণের সম্পর্ক কতটুকু? আমি একে আত্মহত্যা বলি। আবার বলি গণহত্যাও।
হৃদয়ের পরিবার তাদের সব সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। তাঁর বাবা অসুস্থ। একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছে তাঁর পরিবার। পরিবারের প্রধানও অসুস্থ। তিনি কর্মক্ষম নন। জমি-জিরেত সব শেষ। স্বপ্ন ছিল, হৃদয় আমেরিকায় গেলে তাদের স্বচ্ছলতা আসবে। সে স্বপ্ন ভেঙে খান খান। আর পরিবার? শরীরে মরেনি হয়তো তাদের কেউ, মানসিকভাবে? হৃদয়কে হারানো, সঙ্গে সহায়-সম্বল সব—দুয়ে মিলে ভাবুনতো পরিবারটির অবস্থা!
আমরা কিছু হৃদয়ের প্রকাশ্য দেহান্তর দেখি। মৃত্যুর খবর পাই। এর বাইরে, বনে জঙ্গলে আরও অনেক হৃদয়, অনেক নাঈম যে হারিয়ে গেছে, সে খবর কী রাখি? এসব রুটে হৃদয়রা যে কী নির্মম নির্যাতন আর লাঞ্ছনার শিকার, সে খবরও আমরা রাখি না।