হাসুন অন্যকে হাসান

আপনি দিনমজুর হোন, শিক্ষক হোন, ডাক্তার হোন, সমাজসেবী হোন, গবেষক হোন, গৃহিণী হোন, পাইলট হোন বা যেকোনো খেটে খাওয়া মানুষই হোন না কেন, আপনি কি আপনার প্রতিদিনের কাজ-কর্মের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে মানুষের অন্তরে চিরস্মরণীয় হতে থাকতে চান? আমার কাছে তার একটা খুবই সহজ সমাধান আছে, যা আপনি শুরু করতে পারেন এখনই। প্রকৃতপক্ষে, এই পৃথিবীর প্রায় সব জনপ্রিয় ও চিরস্মরণীয় মানুষও এটা করছেন। আপনার পরিচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় কোনো মানুষও সেটা থেকে ব্যতিক্রম নয় বলে আমার বিশ্বাস। আর, তা হচ্ছে ‘মুচকি হাসি’। মুচকি হাসি আর কী কী কাজে লাগে? পড়েই দেখুন—
১. ভালোবাসার মাধ্যম হিসেবে
মুচকি হাসিতে অনেকেই প্রেমে পড়ছেন—এ রকম উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। আমি অনেকের মুখেই শুনেছি, তাঁরা যখন তাঁদের প্রেমিকার বর্ণনা দেন, প্রথমেই বলেন, কী আর বলব! ওর হাসিটা জগৎ ভোলানো! জীবনে আর কিছুই লাগবে না, ওর মুখের হাসি দেখেই পার করে দেব সারা জীবন! কাজেই, আপনি যদি কোনো মেয়ে হন এবং এই লেখা পড়ছেন, তাহলে আপনার স্বপ্নের পুরুষের সঙ্গে এ রকম একটা হাসি দিয়েই দেখুন না, কী হয়! কি রকম হাসি? সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। আমি সে হাসির নাম জানি না। আর, আপনি হাসলে যদি আপনার গালে টোল পড়ে, তবে তো আর কোনো কথাই নাই। পাথরের মতো শক্ত মনের বাস্তববাদী কোনো পুরুষও তাঁর নিজের অজান্তেই আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এমনকি অমাবস্যার রাতেও যে আকাশে চাঁদ দেখবেন না, তার নিশ্চয়তা দিতে পারলাম না। তবে দোহাই আপনার, যার সঙ্গে আপনি ঘর করবেন না, তাঁকে এই হাসি দিয়ে তাঁর জীবনটা পঙ্গু করবেন না।
২. যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে
শুধু যে ছোট্ট শিশুরা ‘হা হা হা’ বা ‘হি হি হি’ করে হেসে হেসে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তা কিন্তু নয়। আমি অনেক রেস্টুরেন্টে কর্মচারীদের দেখেছি যাঁরা ইংরেজি বলতে পারেন না। তবে, শুধু হাসির মাধ্যমে ইশারা-ইঙ্গিতে কাস্টমারদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সেবা দিয়ে থাকেন। ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের তাজিকি রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেওয়ার পর খাবার রেডি হলে একজন মানুষ সদা-সর্বদা হাসিমুখে খাবার টেবিলে পৌঁছে দেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন জানতে পারি, তিনি স্প্যানিশ ছাড়া আর কোনো ভাষাই বলতে পারেন না; এমনকি ইংরেজিও না। কিন্তু গত তিন বছর থেকে তিনি প্রতি বছরই এই রেস্টুরেন্টের সেরা কর্মচারী হিসেবে পুরস্কৃত হচ্ছেন। কীভাবে? শুধু তাঁর মায়াভরা হাসিমুখ দিয়ে মানুষের সঙ্গে অন্তরের যোগাযোগের মাধ্যমে! আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই পৃথিবীর সব ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের হাসির ভাষা এক ও অভিন্ন।
৩. চাকরি পাওয়ার যোগ্যতায়
‘নাসকার কার ওয়া৭’, লারগো, ফ্লোরিডাতে আমার কার (গাড়ি) ওয়াশ করছিলাম। হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল, যার বাংলা এ রকম—‘আপনি হাসতে পারেন? তাহলে আমাদের কাছে লোভনীয় বেতনের চাকরি আছে। আবেদন করুন।’ লক্ষ্য করে দেখুন, কার ওয়াশে চাকরি পেতে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা, ভাষাগত যোগ্যতা বা অন্য কোনো কিছুই বড় করে না দেখে দেখা হচ্ছে আপনি হাসতে পারেন কি না! শুধু নাসকার কার ওয়াশই কেন, ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ বা ‘ওয়েন্ডের’ মতো আমেরিকান ফুড চেইন দোকানগুলোতেও কর্মচারী নেওয়া হয়, আপনি কতটুকু হাসতে পারেন তার ভিত্তিতে। কারণ তাঁরা ভালোভাবেই জানেন, আপনি যদি হাসতে পারেন আপনাকে দিয়েই তাঁদের ব্যবসা ভালো চলবে।
৪. সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে
আমাদের হাসিতে অ্যাণ্ড্রোফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয় যা আমাদের শুধু দাঁতের ব্যথা নয়, যেকোনো ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ডাক্তাররা হাসিখুশি থাকতে পরামর্শ দেন। কারণ এই হাসি আমাদের মন ভালো রাখে, কাজের স্ট্রেস কমায়, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমাদের বেশি বছর বাঁচতে সাহায্য করে। আপনার পরিচিত সবচেয়ে বয়স্ক ও সুস্থ মানুষের কথা ভেবে দেখুন। নিঃসন্দেহে তিনি একজন হাসিখুশির মানুষ। বেশি দিন বাঁচতে চান? একটু প্রাণখুলে হাসুন।
৫. কাস্টমার রিলেশনে
ফোন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার বা অন্যান্য কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় তাঁদের কাস্টমারদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে। যদিও কাস্টমাররা তাদের দেখছেন না, তবুও তাঁরা হেসে হেসে কথা বলেন। আর তাঁরা হেসে হেসে কথা বললে কাস্টমাররা বেশি রাগান্বিত হতে পারেন না। অনেক সময় কাস্টমাররাও হাসেন। আপনি হেসে হেসে ফোনে কথা বলেই দেখুন, অপর পক্ষও হাসবে।
৬. সৌন্দর্য তুলে ধরতে
আপনি যখন ছবি তোলেন, তখন আপনি হাসেন। হাসি না আসলেও ইচ্ছা করেই হাসেন। কেন? আপনাকে হাসি মুখে সুন্দর লাগবে বলে। আপনার প্রিয় যেকোনো তারকা বা যেকোনো সুন্দর মানুষের ছবির দিকে তাকান। দেখবেন তাঁরা হাসছেন। বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই-ই বলেন আর জনপ্রিয় অভিনেত্রী রানি মুখার্জিই বলেন—চিন্তা করছেন কখনো, তাঁরা না হেসে গোমড়া মুখে বসে থাকলে কেমন লাগত? শুধু মানুষই কেন? সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ আর সবুজের সমারোহসহ যেকোনো সৌন্দর্যই ম্লান হয়ে যেত হাসি না থাকলে।
ছোট্ট বাচ্চাদের সবাই খুবই মায়া করে, কোলে নিতে চায়। কেন? ওরা খুবই কিউট ও হাসতে পারে বলে। অনেক মানুষের মুখে শুনেছি, দিন শেষে বাসায় ফিরে বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালেই নাকি পুরো দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখলে। শুধু বাচ্চারাই কেন? ১০৩ বছর বয়সী তরুণী মিনারভা বরানের নাচ আপনি নিশ্চয়ই দেখছেন ইন্টারনেটে। লক্ষ্য করছেন, তিনি কীভাবে হাসতে পারেন? তাই, আপনি যদি মনে করে, আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, একটু হাসুন। তারুণ্য ফিরে পাবেন।
বিয়ের একটি অনুষ্ঠানে যেতে খুবই সুন্দর একটা পোশাক পরছেন, যে পোশাকে আপনাকে সবচেয়ে বেশিই মানায়। কেমন মানাবে আপনার মুখে হাসি না থাকলে? এই বিয়ের অনুষ্ঠান বলেন, ঈদ বলেন, আর পূজা বা যেকোনো খুশির অনুষ্ঠান, মানুষের এত ভালো লাগে কেন? সেখানে মানুষ অনেক হাসে বলে।
৭. আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে
আপনি কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন? দূর থেকে কোনো কথা না বলেই একটু হাসুন। দেখবেন তিনিও হাসছেন। এটা কোনো পাগলের হাসি নয়। দেখবেন, এতে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে। প্রথম দেখায় এ রকম হাসি আপনার সম্পর্কে আপনি খোলা মনের মানুষ হিসেবে ইম্প্রেশন তৈরি করবে। ভিসা, ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে যেকোনো ইন্টারভিউর টিপসে আপনাকে স্মাইলিং থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয় আপনি যাতে ভালোভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, তা ভেবে।
স্বামী হয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বা স্ত্রী হয়ে স্বামীর সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে কথা বলেই দেখুন, আপনাদের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া অনেকটাই কমে যাবে। কারণ? অমত আর তর্ক নিঃসন্দেহে মুচকি হাসির পরম দুশমন।
তাই, আপনি হাসুন। হাসি দিয়ে আপনার আশপাশের মানুষকে হাসান। এই হাসি আপনার পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে মোহিত করে আপনার জীবন খুশিতে ভরপুর করুন। হাসিই হোক আপনার অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরার মাধ্যম এবং আপনার জীবনকে সহজ করার গোপন রহস্য। আর সে জন্যই হয়তো মার্টিন লুথার বলেছিলেন, ‘স্বর্গে যদি আমাকে হাসতে দেওয়া না হয়, আমি সেখানে যেতে চাই না।’