২০ বছর পরও সারেনি নাইন-ইলেভেনের ক্ষত

টুইন টাওয়ার নিউইয়র্ক শহরের বিজয়কেতন হিসেবে তিন দশকের বেশি সময় দাঁড়িয়ে ছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় তা সবার চোখের সামনে ধসে পড়ে। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘নাইন-ইলেভেন হামলা’ নামে ঠাঁই করে নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করছেন এক কর্মী। ওই হামলার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এখানেই স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। গত বুধবার নিউইয়র্ক শহরে
ছবি: এএফপি

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ঝকঝকে উজ্জ্বল হেমন্তের দিন, আকাশে এক ফোঁটা মেঘের চিহ্ন নেই। রোজকার মতো সেদিনও আমি সকাল নয়টার আগেই কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে গিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের সাবওয়ে স্টেশন থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তর হাঁটাপথে পাঁচ-সাত মিনিট। ব্যতিক্রমী কিছুই নজরে আসেনি, কিন্তু ৪২ স্ট্রিটের মূল ফটকে আসতেই থমকে গেলাম। দরজা বন্ধ, অনেক লোক গেটের বাইরে জটলা করছে। শুনলাম, মাত্র কয়েক মিনিট আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার একটি বিমান দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। তাকিয়ে দেখি, দূরের আকাশে ঘন কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। ঠিক কী হয়েছে কেউ জানে না, বুঝতেও পারছে না। মুহূর্ত পরেই দেখি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারে আরেকটি বিমান আছড়ে পড়ল। কোনো সন্দেহ থাকল না, দুর্ঘটনা নয়, এটি ইচ্ছাকৃত সন্ত্রাসী হামলা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওই সন্ত্রাসী হামলা ইতিহাসে ‘নাইন-ইলেভেন হামলা’ নামে ঠাঁই করে নিয়েছে।

অফিস বন্ধ হয়ে গেল। আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে—এই আশঙ্কায় সাবওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো। শহর থেকে বেরোনোর টানেলও বন্ধ। চারদিকে আতঙ্ক, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। ইস্ট রিভারের অপর পারে কুইন্সে আমার বাড়ি, সেখানে কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। তখনো হাতে হাতে সেলফোন আসেনি। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে হাঁটা পথে ফিরে চললাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পালানো মানুষের কাফেলা দেখেছি। কিন্তু এত মানুষ, এত বিভিন্ন দেশের মানুষ একই সন্ত্রাসের শিকার হয়ে এভাবে প্রস্থান করছে, সে দৃশ্য আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

পিঁপড়ার মতো পায়ে-পায়ে এগোচ্ছি সবাই। আমাদের লক্ষ্য মিড ম্যানহাটনের দ্বিতল কুইন্স বরো ব্রিজ, সেই সেতু পেরোলেই আমরা কুইন্সের আবাসিক এলাকায় পড়ব। শহর ছেড়ে পালাচ্ছে সব বয়সের মানুষ। কারও মুখে কোনো কথা নেই, অপ্রত্যাশিত এক দুর্যোগের ভাগীদার সবাই, সবার মনে ভীতি। নৈঃশব্দ্যের ভাষায় আমরা একে অপরের কথা বুঝে নেই। খুব বৃদ্ধ, একা হাঁটতে পারেন না, সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের হাতে হাত রেখে ধীর পায়ে হাঁটছেন এমন অনেকে। কেউ রাস্তার পাশে এক মুহূর্ত জিরিয়ে নিচ্ছেন। দোকানপাট সব বন্ধ, সেসব দোকানের সামনে পানির বোতল বা বিস্কুট হাতে দাঁড়িয়ে অনেকে। যার প্রয়োজন হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিচ্ছে। ব্রিজ পেরোতে আমাদের ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল। অপর পাড়ে আসতেই দেখি একাধিক বাস ও গাড়ি যাত্রী পারাপারের জন্য প্রস্তুত। অঞ্চল ভাগ করে রাখা আছে, যার যেখানে প্রয়োজন কোনো প্রশ্ন না করতেই উঠে পড়ছে। মনে আছে, প্রায় ছয় ঘণ্টা পর, বিকেল নাগাদ ঘরে ফিরে এসেছিলাম।

সন্ত্রাসের নিন্দা

এই হামলার পেছনে ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর সন্ত্রাসী দল আল-কায়েদা যুক্ত, এ কথা জানার পর আমাদের মনে ভর করল ভীতি। মুসলমান, অথবা দাড়ি আছে এমন মানুষ সম্পূর্ণ অকারণে আক্রান্ত হয়েছে, সে কথা কানে এল। একজন শিখ ধর্মযাজক, পোশাকে ও চেহারায় লাদেনের মতো, অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার খবর পেলাম। নিউইয়র্কের বাইরে, দূর টেক্সাস বা অন্য কোথাও মুসলিম পাড়া আক্রান্ত হলো। মসজিদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটল। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বহিরাগত, বিশেষত মুসলমানদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা করলেন। তা যথেষ্ট না হওয়ায় তিনি ওয়াশিংটনের ইসলামিক সেন্টারে এসে সংহতি প্রকাশও করে গেলেন।

অভিবাসী বাঙালি, এ দেশের রাজনীতি থেকে যারা বরাবর দূরে থাকে, তারাও সন্ত্রাসের নিন্দা করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে রাস্তায় নেমে এলেন। ম্যানহাটনে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কাছে মার্কিন পতাকা হাতে একটি সংহতি সমাবেশ হলো। আমি পতাকাটি উল্টো ধরেছিলাম, এক কৃষ্ণকায় যুবক রাস্তার অপর দিক থেকে হেঁটে এসে সে পতাকা সোজা করে দিয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ পর শহরের কেন্দ্রস্থল ইউনিয়ন স্কয়ারে মোমবাতি হাতে আমরা নীরব মিছিল করলাম। উভয় জমায়েতেই অন্যান্য দেশের মানুষেরা যুক্ত হলো। মনে পড়ছে, ইউনিয়ন স্কয়ারে আমার শিশুকন্যা বারবার চেষ্টা করেও মোমবাতি জ্বালাতে পারছিল না। একটি শ্বেতকায় মার্কিন তরুণী এগিয়ে এসে দুই হাতে মোমটি ঢেকে বলল, এবার জ্বালানোর চেষ্টা করো।

ছিনতাই করা উড়োজাহাজ নিয়ে চালানো হামলায় দাউ দাউ করে জ্বলছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে
ফাইল ছবি: এএফপি

নিহতদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশিও

টুইন টাওয়ারের হামলায় প্রায় ৬০ দেশের ২ হাজার ৭৪৯ মানুষ নিহত হন। এঁদের মধ্যে ১২ জন বাংলাদেশিও ছিলেন। ২০ বছর আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের সংখ্যা তেমন ছিল না, ফলে নিহতদের মধ্যে জানাশোনা এমন কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া গেল। কয়েকজন কাজ করতেন নর্থ টাওয়ারের উইন্ডোজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড নামের একটি রেস্তোরাঁয়। এঁদের একজন, সালাহউদ্দিন চৌধুরীর কাজের সময় ছিল সন্ধ্যায়। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, রাতে তাঁর পাশে থাকার জন্য এক বন্ধুর সঙ্গে কাজের সময় বদল করে সকালে এসেছিলেন। দুই দিন পর পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, ততক্ষণে ইথারে মিলিয়ে গেছে সালাহউদ্দিনের প্রাণবায়ু।

আরও ছিলেন এক বছর আগে বিবাহিত দম্পতি, শাকিলা ইয়াসমিন ও নূরুল হক মিয়া। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতেন টুইন টাওয়ারের একই ভবনে, তবে ভিন্ন ভিন্ন তলায়। মৃত্যুর আগে শেষ দেখার সুযোগ মিলল না তাঁদের। পরে ব্রুকলিনের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে শাকিলা ইয়াসমিন অ্যান্ড নূরুল হক মিয়া ৯-১১ মেমোরিয়াল ওয়ে।

একটি টাওয়ারের ১০৩ তলায় কাজ করতেন আবুল কাশেম চৌধুরী। প্রথম বিমানটি হামলার পর দ্রুত নেমে আসার চেষ্টা করেন তিনি। ততক্ষণে সব লিফট বন্ধ হয়ে গেছে, হেঁটে অন্য সবার সঙ্গে ছুটে আসছিলেন। এক ফাঁকে ছোট ভাইকে ফোন করে বিপদের কথাও জানিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় স্ত্রীর সঙ্গে সিনেমায় যাওয়ার কথা ছিল। সে কথা রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না।

নিহতদের একজন, তাঁর নামটি আমার আর মনে নেই, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসার কথা দিয়েছিলেন শিশুপুত্রকে। শুনেছি পিতার প্রতীক্ষায় ছেলেটি অনেক দিন দরজার ঘণ্টি বাজলেই ছুটে যেত, এই বুঝি বাবা এসেছে। আগামীকাল সে ঘটনার ২০ বছর, শিশুটি এখন যুবক। তাঁর প্রতীক্ষার এখনো অবসান হয়নি।

টুইন টাওয়ারে হামলার দিন কয়েক পরেই মধ্য ম্যানহাটনের লেক্সিংটন স্ট্রিটে অবস্থিত আরমারিতে একটি অস্থায়ী মেমোরিয়াল বা স্মারক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। নিহতদের তালিকা তখনো চূড়ান্ত হয়নি। যাঁরা ঘরে ফেরেননি, সেসব নিখোঁজ নিকটজনের খবর জানতে আকুল অনুরোধ জানিয়ে দেয়ালপত্র ও ছবিতে পুরো মেমোরিয়াল ভরা। একটি যুবকের ছবি এখনো চোখে ভাসে। ছবির নিচে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা, ‘উই মিস ইউ বাবা’। সে ছবি ও নাম দেখতে–বুঝতে অসুবিধে হয় না এই যুবক বাংলাদেশের।

যাঁরা সেদিন নিহত হলেন, তাঁদের প্রত্যেকের নাম অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে বিধ্বস্ত টুইন টাওয়ারের স্থলে নির্মিত স্মৃতিসৌধে। একটি জলাধারের চার ধারে নির্মিত উঁচু বেদিতে নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির নাম উৎকীর্ণ করা আছে। প্রতিবছর এখানে নিহতদের স্বজনেরাই প্রতিটি নাম উচ্চারণ করে স্মৃতি ও ভালোবাসায় তাঁদের জীবন্ত করে তোলেন। নাইন-ইলেভেনে সন্ত্রাসী হামলার আশু প্রতিক্রিয়া ছিল আফগানিস্তানে পাল্টা মার্কিন হামলা। আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা এখন শেষ। দেশটি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে মার্কিন সেনা। ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। কিন্তু ২০ বছর পরও সারেনি সেই নাইন-ইলেভেনের ক্ষত।