তিন অঙ্গরাজ্য ঘুরে ৬০ দিনে ১৮ ধাপে তৈরি হচ্ছে ফাইজারের টিকা

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের কারখানায় করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন কার্যক্রম সরেজমিন দেখে এসে প্রতিবেদন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত ২৮ এপ্রিল।

ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য সিরিঞ্জে ভরছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী। ২৯ এপ্রিল ফ্রান্সের নিসে একটি টিকাকেন্দ্রে
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এখন করোনাভাইরাসের টিকার পেটেন্ট। টিকার বৈশ্বিক চাহিদার জোগান দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো টিকার পেটেন্ট উন্মুক্ত করা নিয়ে আলোচনা করছে। এ ব্যাপারে দেশগুলো একমত হলে হয়তো অচিরেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হবে।

তবে যে টিকা নিয়ে এত আলোচনা, সেই টিকা উৎপাদনের সূত্র ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে উদ্ভাবক ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। টিকা বিপণনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কোম্পানিগুলো চুক্তিবদ্ধ হলেও প্রকাশ করা হয়নি চুক্তির শর্ত। এ পরিস্থিতির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের কারখানায় করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন কার্যক্রম সরেজমিন দেখে এসে প্রতিবেদন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত ২৮ এপ্রিল।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে করোনাভাইরাসের এক শিশি ডিএনএ থেকে তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি ডোজ টিকা। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের তিন অঙ্গরাজ্যে ফাইজারের তিন কারখানায় দিনরাত কাজ করে ৬০ দিনে ১৮টি ধাপে তৈরি হচ্ছে টিকার একটি চালান। সেদিক থেকে হিসাব করলে করোনাভাইরাসের এক শিশি টিকা তৈরিতে ফাইজারের সময় লাগছে ওই ৬০ দিনই। টিকা উৎপাদনের কার্যক্রম কেবল ফাইজারের তিন কারখানায়ই সীমাবদ্ধ নেই; ইউরোপের বাজারে টিকার জোগান দিতে একই প্রক্রিয়ায় জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকও জার্মানি ও বেলজিয়ামের দুটি কারখানায় টিকা উৎপাদন করছে।

ফাইজার ও বায়োএনটেক যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকাটি উদ্ভাবন করেছে। এই টিকাই প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে অনুমোদন পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং চীনের সিনোফার্মের টিকা। ধারণা করা হচ্ছে, চীনের আরেকটি কোম্পানি সিনোভ্যাকের টিকাও অচিরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাবে।

অবশ্য করোনা মোকাবিলায় দেশে দেশে ফাইজার, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্মের টিকা ছাড়াও আরও কয়েকটি টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে আলোচনায় রয়েছে স্পুতনিক–ভি, সিনোভ্যাকের টিকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত শুক্রবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে এখন করোনার ২৮০টি টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। এর মধ্য ৯৭টি টিকা রয়েছে মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে। এই টিকাগুলোর মধ্যে ওপরে উল্লেখ করা টিকাগুলো রয়েছে মানবদেহে পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে।

ফাইজারের একটি কারখানায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ফাইল ছবি: এএফপি

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রস্তুতের প্রথম কাজটি শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের চেস্টারফিল্ডে ফাইজারের কারখানায়। এ কারখানায় মজুত রয়েছে করোনার টিকা উৎপাদনের মূল উপাদান, করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ডিএনএ। ওই মজুতকে বলা হয় মাস্টার সেল ব্যাংক।

ফাইজারের টিকা প্রস্তুতের প্রথম কাজ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের চেস্টারফিল্ডের কারখানায়। এই কারখানায় মজুত রয়েছে করোনার টিকা উৎপাদনের মূল উপাদান, করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ডিএনএ। ওই মজুতকে বলা হয় মাস্টার সেল ব্যাংক।

ধাপ-১: হিমাগার থেকে ডিএনএ সংগ্রহ
মিজৌরির চেস্টারফিল্ডের কারখানায় মাস্টার সেল ব্যাংক থেকে প্রথমে করোনাভাইরাসের ডিএনএর শিশি বের করা হয়। এই শিশিগুলো মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। এসব শিশিতে থাকে ডিএনএর ক্ষুদ্রাকার অংশ, যাকে বলে প্লাজমিড। প্রতিটি প্লাজমিড করোনাভাইরাসের একটি করে বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এই উপাদান মানবশরীরে প্রবেশ করে কোষকে করোনাভাইরাসের প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়। ওই প্রোটিনের উপস্থিতির কারণে শরীরে তৈরি হয় করোনাপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি।

তবে এই উপাদান সরাসরি শরীরে প্রয়োগ করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন ওই ডিএনএর অনুরূপ অনেক ডিএনএ। জৈবপ্রযুক্তির এই ধাপেই এশ্চেরেকিয়া কোলাই, সংক্ষেপে ই. কোলাই বড় ভূমিকা রাখে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়া।

প্রশ্ন জাগতে পারে, ভাইরাসের টিকা তৈরিতে ব্যাকটেরিয়ার কী ভূমিকা? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কিছু পরই।

বিজ্ঞানীরা প্লাজমিডের দ্রবণ তৈরি করেন এবং একগুচ্ছ ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে প্রস্তুত করেন, সেগুলো যেন ওই প্লাজমিড নিজেদের কোষে গ্রহণ করে। মাস্টার সেল ব্যাংকের এক শিশি ডিএনএ থেকে পাঁচ কোটি ডোজ টিকা তৈরি করে ফাইজার।

ধাপ-২: কোষ বৃদ্ধি
জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে রূপান্তরিত ব্যাকটেরিয়াগুলো সবুজাভ হলুদ রঙের একটি ঘূর্ণন ফ্লাস্কে রাখা হয়। সেখানে ব্যাকটেরিয়াগুলোর কোষবিভাজনের জন্য জীবাণুমুক্ত উষ্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়।

ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা দেওয়া হচ্ছে লাটভিয়ায়ও। দেশটির জনগণের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও নিচ্ছেন এই টিকা। ৭ মে দেশটির আদাজি শহরে
ছবি: রয়টার্স

ধাপ-৩: গাঁজন প্রক্রিয়া
ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বড় একটি গাঁজন পাত্রে নেওয়া হয়, যা ৩০০ লিটার পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ ধারণ করতে পারে। সেখানে ব্যাকটেরিয়াগুলো চার দিন থাকে এবং প্রতি ২০ মিনিটে এগুলো বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এভাবে তারা কোটি কোটি করোনার ডিএনএ প্লাজমিড তৈরি করতে থাকে।

ধাপ-৪: ডিএনএ সংগ্রহ ও বিশুদ্ধকরণ
বিজ্ঞানীরা এরপর ব্যাকটেরিয়াগুলো সংগ্রহ করে বিশেষ রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। এতে ব্যাকটেরিয়াগুলোর কোষ ভেঙে প্লাজমিড আলাদা হয়ে যায়। এরপর শুধু প্লাজমিড সংগ্রহে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ে যায় ব্যাকটেরিয়াগুলো।

মিজৌরির চেস্টারফিল্ডের কারখানায় মাস্টার সেল ব্যাংক থেকে প্রথমে করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ডিএনএর শিশি বের করে আনা হয়। এই শিশিগুলো মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। এসব শিশিতে থাকে ডিএনএর ক্ষুদ্রাকার অংশ, যাকে বলে প্লাজমিড।

ধাপ-৫: গুণগত মান পরীক্ষা
প্লাজমিডগুলো বিশুদ্ধ কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। মাস্টার সেল ব্যাংকের প্লাজমিডগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, নতুন প্লাজমিডে করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য একই রকম রয়েছে কি না।

ধাপ-৬: প্লাজমিড কাটা
গুণগত মান পরীক্ষায় উতরে গেলে প্লাজমিডের মিশ্রণে বিশেষ এনজাইম প্রয়োগ করা হয়। এসব এনজাইম প্লাজমিড থেকে শুধু করোনাভাইরাসের ডিএনএটুকু কেটে আলাদা করে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুদিন সময় লাগে।

ধাপ-৭: ডিএনএ ছাঁকন
সংগৃহীত ডিএনএর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া বা প্লাজমিডের ভাঙা কোনো অংশ থাকলে তা এই ছাঁকন প্রক্রিয়ায় দূর হয়ে যায়। এভাবে মাত্র এক বোতল বিশুদ্ধ ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ডিএনএগুলো পরীক্ষা করা হয়। প্রতি বোতল ডিএনএ থেকে ১৫ লাখ ডোজ টিকা তৈরি হয়।

এ ধাপে ফাইজারের মিজৌরিতে চেস্টারফিল্ডের কারখানার কাজ শেষ হয়।

ধাপ-৮: মিজৌরি থেকে ম্যাসাচুসেটস ও জার্মানিতে
ডিএনএভর্তি প্রতিটা বোতল হিমায়িত করে সিল করা কনটেইনারে ভরা হয়। কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, পরিবহনের সময় তাপমাত্রার কোনো হেরফের হচ্ছে কি না। এ জন্য প্রতিটি কনটেইনারে একটি করে ছোট তাপ পরিমাপক স্থাপন করা হয়।

টিকা নিচ্ছেন এক নারী। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি টিকাকেন্দ্রে
ছবি: এএফপি

প্রতিটি কনটেইনারে ৪৮টি করে বোতল থাকে। এসব কনটেইনারে এমন পরিমাণ ড্রাই আইস থাকে, যা পরিবহনের সময় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে রাখে। কনটেইনারগুলো বায়ু ও তাপনিরোধক। এ অবস্থায় এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যান্ডোভারে ফাইজারের আরেকটি গবেষণা ও উৎপাদন কারখানায় নেওয়া হয়।

ম্যাসাচুসেটসের অ্যান্ডোভারে ফাইজারের গবেষণা ও উৎপাদন কারখানায় পুরো এক দিন সময় নিয়ে ডিএনএগুলোর দ্রবণ তৈরি করা হয়। এরপর এগুলোকে এমআরএনএতে রূপান্তর করতে প্রয়োজনীয় উপাদানের মিশ্রণ যোগ করা হয়।

এ কারখানায় ডিএনএগুলোকে মেসেঞ্জার আরএনএ বা এমআরএনএতে রূপান্তর করা হয়। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার সক্রিয় উপাদান এই এমআরএনএ।

ম্যাসাচুসেটসের অ্যান্ডোভারের পাশাপাশি কিছু কনটেইনার চলে যায় জার্মানির মেইনজে বায়োএনটেকের কারখানায়। সেখান থেকে তৈরি টিকা ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের বাজারে ছাড়া হয়।

ধাপ-৯: ডিএনএকে এমআরএনএতে রূপান্তর
ম্যাসাচুসেটসের অ্যান্ডোভারে ফাইজারের গবেষণা ও উৎপাদন কারখানায় পুরো এক দিন সময় নিয়ে ডিএনএগুলোর দ্রবণ তৈরি করা হয়। এরপর এগুলোকে এমআরএনএতে রূপান্তর করতে প্রয়োজনীয় উপাদানের মিশ্রণ যোগ করা হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে এনজাইমের প্রভাবে ডিএনএগুলো এমআরএনএতে রূপান্তরিত হয়। মানবদেহে ফাইজারের যে টিকা প্রয়োগ করা হয়, তা মূলত এই এমআরএনএ। এগুলো মানবকোষে ঢুকে করোনাভাইরাসের জিনের নির্দেশনা অনুসারে এই ভাইরাসের প্রোটিন তৈরি করে।


এমআরএনএ তৈরির পর ওই মিশ্রণ একটি ট্যাংকে থিতানো হয়। সেখানে ছাঁকন প্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত ডিএনএ, এনজাইম বা অন্য কোনো উপাদান থাকলে, সেগুলো অপসারণ করা হয়। এভাবে সংগৃহীত এক ব্যাচ এমআরএনএ থেকে ৭৫ লাখ ডোজ টিকা তৈরি হয়।

ধাপ-১০: পরীক্ষা
বিজ্ঞানীরা বারবার এমআরএনএগুলো পরীক্ষা করতে থাকেন। তাঁরা মূলত মিশ্রণে কোনো ভেজাল রয়েছে কি না এবং এমআরএনএগুলোয় করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্যের গুণগত মান ও প্রকৃতি অটুট রয়েছে কি না, তা যাচাই করেন। এভাবে ১০ ব্যাগ করোনাভাইরাস এমআরএনএ পাওয়া যায়। প্রতি ব্যাগে এমআরএনএ থাকে ১৬ লিটার করে।

ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিচ্ছেন দক্ষিণ কোরিয়ার ভলিবল দলের এক সদস্য। ২৯ এপ্রিল রাজধানী সিউলে ন্যাশনাল মেডিকেল সেন্টারে
ছবি: রয়টার্স

ধাপ-১১: ম্যাসাচুসেটস থেকে মিশিগানে, জার্মানি থেকে বেলজিয়ামে
এমআরএনএর ব্যাগগুলো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হিমায়িত করা হয় এবং সেগুলো এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কালামাজুতে ফাইজারের আরেকটি কারখানায় নেওয়া হয়। সেখানেই মূলত প্রয়োগযোগ্য টিকা তৈরি হয়। কালামাজুতে পরিবহনের পাশাপাশি এমআরএনএর নমুনা মিজৌরির চেস্টারফিল্ডে ফাইজারের কারখানাতেও পাঠানো হয়। সেখানে এগুলো আবার পরীক্ষা করা হয়। জার্মানির মেইনজে বায়োএনটেকের কারখানা থেকে তৈরি এমআরএনএর নমুনাও চেস্টারফিল্ডে যায় পরীক্ষার জন্য। আর টিকা উৎপাদনের জন্য সেখান থেকে এমআরএনএর ব্যাগগুলো নেওয়া হয় বেলজিয়ামের পুরসে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এই নাগরিকেরা কমপক্ষে এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ মিলিয়ে ফাইজার এ পর্যন্ত ১০০ কোটি ডোজের বেশি টিকা সরবরাহ করেছে।

ম্যাসাচুসেটসের অ্যান্ডোভারের কারখানায় প্রতি এক সপ্তাহে দুই ব্যাচ করে এমআরএনএ প্রস্তুত হয়। প্রতি ব্যাচে ১০ ব্যাগ করে এমআরএনএ তৈরি হয়। এই কারখানা তাদের প্রথম এমআরএনএ ব্যাচ তৈরি করেছে গত বছরের ‍জুলাইয়ে। সম্প্রতি এখানকার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

ধাপ-১২: এমআরএনএ প্রস্তুতকরণ
মিশিগানের কালামাজুতে ফাইজারের কারখানায় এমআরএনএগুলো পৌঁছানোর পর সেগুলো প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত হিমায়িত অবস্থায় রাখা হয়। এরপর এগুলোর দ্রবণ তৈরি করা হয়। প্রতি দফার দ্রবণে ৩৬ লাখ ডোজ টিকা বা ৬ লাখ শিশি টিকা তৈরি হয়। প্রতি এক শিশি থেকে ছয়জনকে টিকা দেওয়া যায়।

এমআরএনএর দ্রবণ থেকে টিকা তৈরির জন্য এতে পানি যোগ করা হয়।

ধাপ-১৩: লিপিড প্রস্তুতকরণ
পৃথক এক প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা তৈলাক্ত লিপিড তৈরি করেন। এগুলো এমআরএনএকে সুরক্ষিত রাখে এবং মানবকোষে প্রবেশে সাহায্য করে। লিপিড তৈরি ও পরিমাপ শেষে এতে ইথানল যোগ করা হয়। তবে প্রয়োগযোগ্য টিকায় কোনো ইথানল থাকে না। প্রস্তুত প্রণালির একপর্যায়ে এই ইথানল অপসারণ করা হয়।

ক্যাপশন–৫: ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা নিচ্ছেন এক ব্যক্তি। ৫ মে কানাডার অন্টারোওর টরন্টোয়
ছবি: রয়টার্স

ধাপ-১৪: এমআরএনএ থেকে টিকা প্রস্তুত
এমআরএনএ ও লিপিডের মিশ্রণ থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে লিপিড ক্ষুদ্র কণিকা বা লিপিড ন্যানোপার্টিকেল তৈরি করা হয়। লিপিড যখন নগ্ন এমআরএনএর সংস্পর্শে আসে, বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে তা এক সেকেন্ডের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ে এমআরএনএর সঙ্গে জড়িয়ে যায়। লিপিড কয়েক স্তরে এমআরএনএকে মুড়িয়ে ফেলে। এর মাধ্যমে তৈরি হয় তৈলাক্ত সুরক্ষিত টিকা উপাদান।

এরপর এই টিকা থেকে ইথানল অপসারণ করা হয়। ঘণীভূত করে তার থেকে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দ্রব্য থাকলে তা অপসারণ করা হয়। সবশেষে এ মিশ্রণ জীবাণুমুক্ত করা হয়

টিকার শিশি প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ার শুরুতে লাখ লাখ খালি শিশি ধোয়া ও জীবাণুমুক্ত করা হয়। এ কাজে কড়া নজরদারি করা হয় স্বয়ংক্রিয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১৩টি ক্যামেরার মাধ্যমে। বিভিন্ন কোণ থেকে প্রতিটি শিশির ১০০টি করে ছবি তোলা হয়।

ধাপ-১৫: টিকার শিশি প্রস্তুতকরণ
এদিকে লাখ লাখ খালি শিশি ধোয়া ও জীবাণুমুক্ত করা হয়। এ কাজে কড়া নজরদারি করা হয় স্বয়ংক্রিয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১৩টি ক্যামেরার মাধ্যমে। বিভিন্ন কোণ থেকে প্রতিটা শিশির ১০০টি করে ছবি তোলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো শিশিতে সামান্য ফাটা কিংবা কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে তা ধরা পড়ে যায়। ত্রুটিযুক্ত শিশিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর পৃথক একটি যন্ত্রের মাধ্যমে বাছাইকৃত শিশিগুলো ভ্যাকিউম কনটেইনারে নেওয়া হয় কোনো ছিদ্র রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করতে।

ধাপ-১৬: শিশি ভর্তি করা
এক সারিতে শিশিগুলো নির্দিষ্ট যন্ত্রের নিচে চলে যায়। প্রতিটিশিশিতে শূন্য দশমিক ৪৫ মিলিলিটার করে টিকার তরল ভরা হয়। এই পরিমাণ এক শিশি টিকা ছয় ডোজের জন্য যথেষ্ট। এরপর ফয়েল ও গোলাপি রঙের ঢাকনা দিয়ে শিশিগুলোর মুখ বন্ধ করা হয়। প্রতি মিনিটে এভাবে টিকাভর্তি ৫৭৫টি শিশি প্রস্তুত হয়।

টিকার তরল শীতল হলেও বোতলজাত করার সময় দ্রুতই তা উষ্ণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় এভাবে উষ্ণ থাকলে এমআরএনএ নষ্ট হওয়া শুরু হয়। কাজেই কালামাজু কারখানায় তড়িঘড়িই সব করতে হয়। এখানে ৪৬ ঘণ্টার মধ্যে তরল টিকা প্রস্তুত করে তা শিশিতে ভর্তি করা হয় এবং এর পরপরই শিশিগুলো ডিপ ফ্রিজে রাখা হয়।

ধাপ-১৭: প্যাকেটে ভরে হিমায়িতকরণ ও পরীক্ষা
শিশিগুলো আবার পরীক্ষা করা হয়। এরপর সেগুলোয় লেবেল লাগিয়ে ছোট প্লাস্টিকের ট্রেতে সাজানো হয়। একেকটি ট্রেতে ১৯৫টি শিশি রাখা যায়। পাঁচটি করে ট্রে একসঙ্গে করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্রিজারে রাখা হয়। কালামাজুতে ফাইজারের ওই কারখানায় এমন ফ্রিজার রয়েছে ৩৫০টি। একেকটি ফ্রিজারে ৩০০টি করে ট্রে রাখা যায়।

কয়েক দিন এভাবে ফ্রিজারে রাখার পর টিকার তরল মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। এতে টিকা দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণের ‍উপযোগী হয়ে ওঠে। প্রতিটি ফ্রিজার বারবার পরীক্ষা করা হয়। ফ্রিজারগুলোর প্রতিটি তাক একই তাপমাত্রায় রয়েছে কি না, তা যাচাই করা হয়।

রোমানিয়ায় একটি টিকাকেন্দ্রে ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা নিতে মানুষের সারি। ৭ মে বুখারেস্টে
ছবি: এএফপি

হিমায়িত হওয়ার পর টিকার তরলভর্তি শিশিগুলো সরবরাহের আগে চার সপ্তাহ অপেক্ষা করা হয়। এই চার সপ্তাহে চলে পরীক্ষা কার্যক্রম। নমুনা পাঠানো হয় ম্যাসাচুসেটসের অ্যান্ডোভারের কারখানায়, যেখানে এমআরএনএ প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ছাড়া মিজৌরির চেস্টারফিল্ডের কারখানায়ও নমুনা পাঠানো হয়, যেখানে করোনাভাইরাসের জিন সংরক্ষিত আছে।

ধাপ-১৮: টিকা সরবরাহ
কয়েক সপ্তাহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এবার টিকা সরবরাহের জন্য প্রস্তুত। ফ্রিজার থেকে টিকার শিশিভর্তি ট্রেগুলো কর্মীরা বের করেন এবং সেগুলো প্যাকেট করে বাক্সে ভরেন। এসব বাক্সে তাপমাত্রা ও অবস্থান নির্ণায়ক সেন্সর থাকে। প্রতিটি বাক্সে পাঁচটি করে ট্রে থাকে। হিমাঙ্কের নিচে উপযোগী তাপমাত্রা ধরে রাখতে প্রতিটি বাক্সে ৪৫ পাউন্ড করে ড্রাই আইস ভরা হয়।

বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের অনেক ধরন (স্ট্রেইন) ছড়িয়েছে। এসব ধরনের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন আসায় এগুলো টিকা প্রয়োগ বা করোনার সংক্রমিত হয়ে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ফাঁকি দিতে পারছে। নতুন এই ধরনগুলো মোকাবিলায় ফাইজার ও বায়োএনটেক এখন নতুন ধরনের টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে।

ফাইজারের এই টিকার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৫ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে। মে মাসের শেষ নাগাদ তারা যুক্তরাষ্ট্রে মোটের ওপর ২২ কোটি এবং জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ ৩০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের প্রত্যাশা করছে।

শেষ ধাপ: টিকা কর্মসূচি
যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। এই সংখ্যা দেশটির প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি। তাঁরা কমপক্ষে এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ মিলিয়ে ফাইজার এ পর্যন্ত ১০০ কোটি ডোজের বেশি টিকা সরবরাহ করেছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরেক টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মডার্নার টিকা উৎপাদনের প্রক্রিয়াও তুলে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু মডার্না এই উদ্যোগে রাজি হয়নি। তারাও অবশ্য ফাইজারের মতো এমআরএনএ টিকা উৎপাদন করছে।

পরবর্তী ধাপ: টিকা হালনাগাদকরণ
বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের অনেক ধরন (স্ট্রেইন) ছড়িয়েছে। এসব ধরনের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন আসায় এগুলো টিকা প্রয়োগ বা করোনার সংক্রমিত হয়ে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ফাঁকি দিতে পারছে। নতুন এই ধরনগুলো মোকাবিলায় ফাইজার ও বায়োএনটেক এখন নতুন ধরনের টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে। তার অংশ হিসেবে তারা করোনাভাইরাসের নতুন ধরনগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে।

* ভাষান্তর: রাজিউল হাসান