সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শিশুদের দূরে রাখতে পারবেন কি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুদের প্রবেশ নিষেধ করে আইন পাস করে বিশ্বে নজির গড়েছে অস্ট্রেলিয়া। তবে এই নিষেধাজ্ঞাকে বোকা বানিয়ে স্ন্যাপচ্যাটে ঢুকে পড়তে ১৩ বছর বয়সী ইসোবেলের ৫ মিনিট সময়ও লাগেনি।
ইসোবেলের মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ন্যাপচ্যাট থেকে একটি সতর্কবার্তা (নোটিফিকেশন) এসেছিল। বার্তাটি ছিল, তাকে প্রমাণ দিতে হবে যে তার বয়স ১৬ বছরের বেশি। না দিলে এই সপ্তাহে নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর তাকে স্ন্যাপচ্যাট থেকে বের করে দেওয়া হবে।
১০ ডিসেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় নতুন আইন কার্যকর হতে চলেছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১০টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি হচ্ছে স্ন্যাপচ্যাট।
ইসোবেল বিবিসিকে বলে, ‘আমি আমার মায়ের একটি ছবি নিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে ধরতেই স্ন্যাপচ্যাট আমাকে ঢুকতে দিল। সে বলল, ‘আপনার বয়স যাচাই করার জন্য ধন্যবাদ।’
এই কিশোরী আরও বলে, ‘আমি শুনেছি, কেউ একজন বিয়ন্সের ছবি ব্যবহার করেছে।’
মা মেলকে দেখিয়ে ইসোবেল বলে, ‘আমি ওকে টেক্সট করি। বলি যে “এই মা, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে গেছি। মা শুধু বলল “পাজি মেয়ে”।’
মেল বলেন, তিনি ইসোবেলকে কড়া নজরে রেখে টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করতে দেন। তিনি মনে করেন, লুকিয়ে ব্যবহার করার চেয়ে এটা ভালো। তবে নিষেধাজ্ঞাটি বাবা–মায়েদের অনলাইনজগতের ঝুঁকি থেকে ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে সাহায্য করবে বলে তাঁর আশা জেগেছিল।
আর মেল বললেন, মেয়ের কাণ্ডে তাঁর খুব হাসি পেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি যা ভেবেছিলাম, ঠিক সেটাই ঘটেছে।’
মেল বলেন, তিনি ইসোবেলকে কড়া নজরে রেখে টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করতে দেন। তিনি মনে করেন, লুকিয়ে ব্যবহার করার চেয়ে এটা ভালো। তবে নিষেধাজ্ঞাটি বাবা–মায়েদের অনলাইনজগতের ঝুঁকি থেকে ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে সাহায্য করবে বলে তাঁর আশা জেগেছিল।
সে আশা এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। কারণ, অনেক বিশেষজ্ঞ এই নীতিমালার বাস্তবায়নের যোগ্যতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। এমনকি শিশুরাও এমন কথা বলছে।
নিষেধাজ্ঞা কাজে প্রয়োগ করবে যে প্রযুক্তি, তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ আছে। পাশাপাশি ভয় আছে, এটা নাজুক শিশুদের কোণঠাসা, একাকী করে ফেলতে পারে। অন্যদেরও অনলাইনের অন্ধকার এবং কম নিয়ন্ত্রিত অংশের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
রাজধানী ক্যানবেরার নীতিনির্ধারণী মহলে, দেশজুড়ে ঘরে ঘরে এবং দুনিয়াজুড়ে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বোর্ডরুমে একটি উদ্বিগ্ন প্রশ্ন ঘুরছে—এটা কি সত্যিই কাজ করতে চলেছে?
‘অনলাইনে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে বাবা–মায়েরা খুবই উদ্বিগ্ন’
অস্ট্রেলিয়ায় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীদের—বিশেষ করে শিশুদের—সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে; বরং ব্যবহারকারীদের প্রতিবাদে কেউই কান দেয় না।
পাঁচ সন্তানের বাবা এবং স্মার্টফোনবিরোধী আন্দোলনকর্মী ড্যানি এলাচি বিবিসিকে বলেন, ‘প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের মুনাফা বাঁচানোর বাইরে আর কিছু করবে—এ বিশ্বাস আমাদের বিন্দুমাত্র নেই। শিশুদের কল্যাণকে তারা গুরুত্ব দেয়—এমনটা দেখিয়ে দেওয়ার অনেক সুযোগ তাদের ছিল। কিন্তু তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।’
এমা মেসন গত মাসে জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের কাছে বিস্তারিত বলেছেন, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা বা বুলিংয়ের শিকার হয়ে তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী বুলিং।
আমি শুনেছি, কেউ একজন বিয়ন্সের ছবি ব্যবহার করেছে।ইসোবেল
এমা বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আর কত টিলিকে মরতে হবে?’
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তাসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করাটা কোনো সমাধান নয়।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এ আইন প্রণয়নের ঘোষণা দেন। সে সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, শিশুদের কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে না।
ব্যবহারকারীর বয়স অন্তত ১৬ বছর—এটা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তিসংগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মের। এ কাজে সবচেয়ে গুরুতর বিচ্যুতির জন্য তাদের সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৪৯ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার (৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার) জরিমানা দিতে হবে।
অ্যান্থনি অ্যালবানিজ সেদিন বলেন, ‘এটি (আইনটি) বাবা–মায়েদের জন্য...আমার মতো তাঁরাও অনলাইনে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।’
নীতিটির সমর্থকেরা বলছেন, এটি শিশুদের আসক্তিকর অ্যালগরিদমের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে, যে অ্যালগরিদম সহিংসতা, পর্নোগ্রাফি ও ভুল তথ্যের মতো ক্ষতিকর কনটেন্ট তাদের সামনে এনে দেয়।
নিষেধাজ্ঞা কাজে প্রয়োগ করবে যে প্রযুক্তি, তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ আছে। পাশাপাশি ভয় আছে, এটা নাজুক শিশুদের কোণঠাসা, একাকী করে ফেলতে পারে। অন্যদেরও অনলাইনের অন্ধকার এবং কম নিয়ন্ত্রিত অংশের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
একই ধারার ছোটখাটো নীতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেসব চেষ্টা খুব কম সফল হয়েছে।
এমনও বলা হচ্ছে, এটি সাইবার হেনস্তা (বুলিং) এবং অনলাইনে শিশুদের যৌন ও অন্যান্য শোষণ কমাবে। এ ছাড়া এটি শিশুদের বাইরে খেলতে বাধ্য করবে, তাদের ঘুম ভালো হবে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হবে।
অ্যান্থনি অ্যালবানিজ যখন এ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন তিনি কীভাবে কাজটা করবেন, সে পরিকল্পনা জানাননি। অস্ট্রেলিয়া সরকার এ জন্য এক বছর সময় নিয়েছিল।
ঘোষণার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার দ্রুত পার্লামেন্টে একটি সংক্ষিপ্ত বিল পাস করার উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে মতামত দিতে জনসাধারণকে ৪৮ ঘণ্টার কম সময় দেওয়া হয়েছিল।
কীভাবে এটির প্রয়োগ হবে
এক বছর পর আইনটি জারি হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগেও প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
সরকারি অর্থায়নে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বয়স যাচাইয়ের প্রধান পদ্ধতিগুলো পরীক্ষা করেছে। তারা চলতি বছর এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রযুক্তিগতভাবে এটা করা সম্ভব। কিন্তু কোনো পদ্ধতিই নিখুঁত নয় এবং সব কটিতে ঝুঁকি রয়েছে।
পরিচয়পত্র ব্যবহার করে যাচাই করা সবচেয়ে নির্ভুল পদ্ধতি, তবে এতে ব্যবহারকারীদের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ নথি জমা দিতে হবে। জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ অস্ট্রেলীয়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর ওপর ভরসা করে না।
অনলাইনে ব্যবহারকারীর কর্মকাণ্ড দেখে এবং মুখাবয়ব বিশ্লেষণ করে তার বয়স অনুমান করা যায়। দুটি পদ্ধতিই কিশোর বয়সীদের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ফল পাওয়ার মতো যথেষ্ট নিখুঁত নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬ বছরের ২-৩ বছর আগে বা পিছে বয়স হলে ‘ফেস স্ক্যান’ পদ্ধতির নির্ভুলতা কমে যায়। মেটা ও স্ন্যাপচ্যাট অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্দেহভাজন ব্যবহারকারীদের শনাক্ত করতে ইতিমধ্যে ‘ফেস স্ক্যান’ পদ্ধতি চালু করেছে।
তবু প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বয়স যাচাইয়ের প্রযুক্তিগুলো গোপনীয়তার সুরক্ষা দিতে পারে, হতে পারে জোরালো এবং কার্যকর, বিশেষ করে যখন একাধিক পদ্ধতি মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘এজ চেক সার্টিফিকেশন স্কিম’-এর প্রধান টনি অ্যালেন বলেন, ‘যখন আপনি কোনো বোতলের (অ্যালকোহল) দোকানে যাবেন, তারা আপনাকে আগাপাছতলা দেখবে; বলবে, “হুম, নিশ্চিত না”, বলে তারা আপনার পরিচয়পত্র চাইবে...এটি ঠিক তেমনই হবে।’
‘এজ চেক সার্টিফিকেশন স্কিম’ অস্ট্রেলিয়া সরকারের পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি পরিচালনা করেছে। তবে এর ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল।
এ বছর মে মাসে সরকারের জন্য পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে সাহায্য করতে চান।
এ ছাড়া মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে ২২ মার্কিন ডলার দামের একটা হ্যালোইন মুখোশ মুখাবয়ব বিশ্লেষণভিত্তিক প্রযুক্তিকে ঘোল খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
তবে বয়স যাচাইয়ের ব্যবস্থার সমর্থকেরা মনে করেন, নিয়ম ফাঁকি দেওয়া ঠেকানোর মতো প্রযুক্তি রয়েছে।
ইসোবেলের মতো একটি ছবি দেখিয়ে যাচাইব্যবস্থাকে বোকা বানাতে পারার কথা নয়।
বিবিসি এ বিষয়ে স্ন্যাপচ্যাটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের এক মুখপাত্র বলেন, প্রতিষ্ঠানটি নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ‘প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ’-এর ব্যাপারে নিয়মিত উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনা (ইসোবেলের) তেমনই একটি চ্যালেঞ্জ।’
ইসোবেল, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছে, সে প্রায় নিশ্চিত, এই নিষেধাজ্ঞা কাজে আসবে না।
‘প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের মুনাফা বাঁচানোর বাইরে আর কিছু করবে—এ বিশ্বাস আমাদের বিন্দুমাত্র নেই। শিশুদের কল্যাণকে তারা গুরুত্ব দেয়—এমনটা দেখিয়ে দেওয়ার অনেক সুযোগ তাদের ছিল। কিন্তু তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।’
এই কিশোরী আরও বলে, ‘স্ক্রিন নিয়ে আমার কোনো নেশা নেই...কিন্তু আমি মনে করি, অ্যান্থনি অ্যালবানিজ আমাদের ঘরের বাইরে বের করতে যে পরিকল্পনা করেছেন, তা বোকামি। যদি শেষ পর্যন্ত আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়, আমি কেবল অন্য কোনো অ্যাপ খুঁজে নিয়ে তা ব্যবহার করব।’
মেল স্পষ্ট করে বলেন, ‘এটা আলোচনার বিষয়।’
তবে তিনি এবং আরও অনেকে ভয় পাচ্ছেন যে প্ল্যাটফর্মগুলো এবং নিয়ন্ত্রকেরা এমন এক খেলায় নামতে যাচ্ছেন, যেখানে একটা ফুটো চিহ্নিত করে সেটা বন্ধ করতে করতে আরও দশটা দেখা দেবে। নিষিদ্ধ প্ল্যাটফর্মের তালিকা করা হবে, কিন্তু শিশুরা দলে দলে অন্য প্ল্যাটফর্ম খুঁজে নেবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নীতিটি অগ্রাহ্য করার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোরও স্বার্থ আছে। অন্যান্য দেশ এই পথ ধরে কি না, তা নিয়ে তারা ভয়ে আছে।
স্টিফেন শিলার বলেন, ‘তারা আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাশ কেটে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করবে।’
এটি (আইনটি) বাবা–মায়েদের জন্য...আমার মতো তাঁরাও অনলাইনে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।অ্যান্থনি অ্যালবানিজ, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী
শিলার ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ফেসবুকের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, জরিমানার ভয়ে কেউ পথে আসবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম। ফেসবুক যেমন বিশ্বপর্যায়ে দুই ঘণ্টার কম সময়ে এই পরিমাণ টাকা আয় করে। এই জরিমানা তাদের কাছে পার্কিং টিকিটের মতো।
আরও আছে আইনগত চ্যালেঞ্জ এবং এটা আসবেই। দুই কিশোর এরই মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছে। তাদের অভিযোগ, আইনটি সংবিধানবিরোধী এবং দমনমূলক।