কেমন আছে আফগানিস্তান–২
প্রথাগত ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ নয়, আগেই রাজনৈতিক-সামরিক কাঠামোতে ছিল তালেবান
২০২১ সালে ২০ বছরের যুদ্ধে জয়লাভের পর তালেবান আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে। কেউ কেউ একে দ্বিতীয় তালেবানের শাসন নামে অভিহিত করছে। কেমন আছে নতুন আফগানিস্তান, তা দেশটিতে ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী। তিনি গত ৮ অক্টোবর আফগানিস্তানে যান। ফিরেছেন ৫ নভেম্বর। আফগানিস্তান ঘুরে তাঁর লেখা প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে দেশের একেবারে পশ্চিমে হেরাত প্রদেশের দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটারের বেশি। বাসে পৌঁছাতে লাগল প্রায় ১৮ ঘণ্টা। পরের দিন ভোরে (১৮ অক্টোবর) রওনা হলাম আরও ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ইসলাম কালার শরণার্থীশিবিরের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে আলাপ হলো আক্তার জান নামের বছর চল্লিশের এক তালেবান মুজাহিদ ও তাঁর তরুণ ভাইপোর সঙ্গে। তাঁরাও সীমান্তে যাচ্ছিলেন, তুলে নিলাম ট্যাক্সিতে।
আক্তার জানের সঙ্গে আলাপ না হলে তালেবানের রণনীতি নিয়ে অনেক কিছুই জানা যেত না। মাঠপর্যায়ের সৈনিক আক্তার জান। দেশ বাঁচাতে অল্প বয়সে রুশ রাইফেল একে ৪৭ হাতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন। তারপর বিদ্রোহীদের প্রিয় এই বন্দুকই যে ব্যবহার করেছেন, তা বুঝলাম যখন বললেন, ‘ম্যাগাজিনে ৩০টি গুলি ধরে।’
তবে আক্তার জানের কথায় বোঝা যায়, তিনি মুজাহিদদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বিশেষ করে সোভিয়েত জমানার রকেট-চালিত গ্রেনেড (আরপিজি) কাঁধে বসিয়ে মর্টার নিক্ষেপের কারণে। বছর ১৫ প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের পর চাকরি পেয়েছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, পাহাড়ে পাহাড়ে আর ঘুরতে হয় না। রাতে বাড়িতে ঘুমান বা সীমান্তের ছাউনিতে, ভাইপোকেও ঢুকিয়েছেন বাহিনীতে।
তালেবানের প্রথা-বিরুদ্ধ যুদ্ধ
যুদ্ধের সময় কিছু জায়গা বেছে ভয়ংকর আক্রমণ চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক যৌথ নিরাপত্তা বাহিনী (আইএসএএফ)। পাল্টা হামলা চালিয়েছিল মুজাহিদরাও। বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছিল ইরান সীমান্তবর্তী ফারাহ প্রদেশের বালা বুলুক জেলার সিয়ান গ্রামে। পশ্চিমাঞ্চলে এখানেই ছিল মুজাহিদদের বড় ঘাঁটি, ছিলেন আক্তার জানও।
ইসলাম কালা যাওয়ার পথে তিন ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে আক্তার জান সিয়ানে জয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেন। অবাক করে বললেন, প্রথাগত যুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক শর্তই তাঁরা মানেননি। যেমন স্কোয়াড, প্লাটুন, কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন প্রভৃতি ভাগে বাহিনীকে ভাগ করেননি। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারটা ছিল অন্য রকম’।
প্রথাগত ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ তৈরি না করে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার আগেই একটা রাজনৈতিক-সামরিক কাঠামো তৈরি করেছিল। কাউকে প্রদেশের গভর্নর ঘোষণা করেছিল, কেউ–বা ছিলেন গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের দায়িত্বে, ছিলেন সামরিক কমান্ডার এবং পুলিশপ্রধানও।
আক্তার জান বলেন, ‘গুরুত্ব অনুসারে তাঁদের অধীনে ছেলে বা যোদ্ধা দেওয়া হয়েছিল। কারও অধীনে ছিল ৫০, কারও ১০০, ২০০ বা ৩০০ বন্দুকধারী। তাঁর জানামতে, সিয়ানে সবচেয়ে বেশি ফৌজ ছিল দুই কমান্ডার ভাইয়ের হাতে। দুই ভাই হলেন হাজি সুলতান সাব্বির ও হাজি তৈয়াব।
আক্তার জান বলেন, ‘একেকজনের অধীনে মোটামুটিভাবে ৬০০-৬৫০ যোদ্ধা ছিল, অর্থাৎ মোট ১২০০-১৩০০ যোদ্ধা। প্রয়োজনমতো তাঁরা এই যোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করতেন। কখনো ৫০ জনকে পাঠাতেন, কখনো ৪০০-৫০০ ছেলেও পাঠানো হতো।’
‘বোসকা’
আরও একটা কৌশলের কথা বললেন আক্তার জান। এই কৌশলের নাম ‘বোসকা’। শব্দটির সুনির্দিষ্ট অর্থ জানা গেল না। তবে এটি একটি ইম্প্রভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সম্ভবত একটি চামড়ার ব্যাগে ভরে শক্তিশালী বিস্ফোরক বানিয়ে তার নাম দেওয়া হয়েছে বোসকা। এক-দুই কিলোমিটার দূরে আইএসএএফের সাঁজোয়া গাড়ি দেখতে পেলে মুজাহিদরা রাস্তার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা বোসকার সার্কিট চালু করতেন।
সাবেক সরকারের আমলে হেরাতে একটা সংগ্রহশালা বানানো হয়েছিল বাজেয়াপ্ত সোভিয়েত গোলাবারুদ-ট্যাংক-বিমান দিয়ে। এর নাম ‘মনজর-এ-জিহাদ’।
আক্তার জান বলেন, ‘বোসকার সার্কিট থেকে একটা জীবন্ত তার (লাইভ ইলেকট্রিক ওয়্যার) বার করে মাঠ বা পাহাড়ের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হতো। সেই তারে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হতো বাহিনীর গাড়ি কাছে এলে।’ ঠিক সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানো বিশেষজ্ঞের কাজ, সাধারণ মুজাহিদ পারবে না। আক্তার জান বললেন, ‘বোসকা বানানো আমরা শিখেছিলাম সোভিয়েত যুদ্ধের (১৯৭৯-৮৯) সময়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই সঠিক সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানো গেছে।’ ২০ বছরের লড়াইয়ে বোসকার ভূমিকা কী ছিল, তা বোঝা যায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সোভিয়েত সেনাবাহিনীর ট্যাংক দেখে।
‘ট্রফি প্রদর্শন’
আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধস্মারক হিসেবে ট্যাংক ও সামরিক সরঞ্জাম দেখা যাবে, যা বিজয়ের প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। ফুটবল ক্লাব যেমন ট্রফি দিয়ে তাদের ক্লাবের চত্বর সাজায়। কিছু জায়গায়-যেমন কাবুল থেকে লোগার যাওয়ার পথে বা বামিয়ান বুদ্ধের প্রায় পাদদেশে—সারি সারি ট্যাংক ছড়িয়ে রেখেছেন মুজাহিদরা। বিশ্বশক্তির পতনের চিহ্ন হিসেবে!
সাবেক সরকারের আমলে হেরাতে এমনকি একটা সংগ্রহশালাও বানানো হয়েছিল, বাজেয়াপ্ত সোভিয়েত গোলাবারুদ-ট্যাংক-বিমান দিয়ে। এর নাম ‘মনজর-এ-জিহাদ’। জিহাদ মিউজিয়াম। সংগ্রহশালার পুস্তিকায় দারি ভাষায় লেখা আছে, ‘আফগানিস্তানের মানুষের বিজয় যেভাবে সুমহান শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে, তা প্রমাণ করছে আফগানদের শৈল্পিক সত্তাকে।’
কিন্তু যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী, সেটা হলো প্রকাশ্যে যেসব সমর-সরঞ্জাম রাখা হয়েছে, তার মধ্যে শুধুই সোভিয়েত যুদ্ধাস্ত্র কেন? মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর বিরুদ্ধে এই যে দীর্ঘ লড়াই, তার চিহ্নমাত্র রাস্তাঘাটে নেই কেন?
উত্তর পাওয়া গেল বাগরাম বিমানঘাঁটিতে গিয়ে। প্রায় ছোটখাটো একটা শহরের আয়তনের এই ঘাঁটিতে বিপুল পরিমাণ মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র রাখা আছে। বস্তুত কী যে রাখা আছে, তা কেউই জানে না; কারণ, সেখানে কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঢুকতে না পারার দুঃখ নিয়ে যখন কাবুলে ফেরার গাড়ি ধরার চেষ্টা করছি, তখন ঘাঁটির সামনের বাজার ‘দহন ময়দান মার্কেটে’ দেখা হলো দুই মুজাহিদের সঙ্গে, তাঁরা সাবান কিনতে বেরিয়েছিলেন। একসময় তাঁরা লড়াই করতেন, এখন ঘাঁটি পাহারা দেন। তাঁদের একজন শের খান ইসমাইল অল্পবিস্তর উর্দু বলতে পারেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘাঁটিতে রাখা যুদ্ধাস্ত্র তালেবান প্রকাশ্যে আনে না কেন?
ইসমাইলের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ওগুলো এখনো সক্রিয়। কবে কাজে লেগে যায়, বলা যায় না। একে ৪৭ ছাড়া রাশিয়ার সরঞ্জাম অকেজো হয়ে গেছে।
পাকিস্তানসহ অন্য দেশের ভূমিকা
আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাঠানদের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে পাকিস্তানের (বেলুচিস্তান প্রদেশের) কোয়েটায় অথবা (খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের) পেশোয়ার এবং সংলগ্ন অঞ্চলে। আক্তার জান ছিলেন কোয়েটায়। বললেন, ‘যখনই অসুস্থ হয়েছি বা আহত হয়েছি, তখনই গিয়েছি। কোয়েটার কেন্দ্রে বাজার অঞ্চল মিট্টা চকে এক মাদ্রাসায় আমার আস্তানা ছিল। তীব্র শীতেও আমরা মিট্টায় চলে যেতাম। বিশ্রাম নিতাম।’
যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘বেস এরিয়া’ স্থাপন, যেখানে যোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতে পারবে, যন্ত্রপাতি সারাতে পারবে, রসদ সংগ্রহ করবে এবং বিশ্রাম নেবে। যুদ্ধ চলাকালীন আফগানরা অনেক জায়গায় তাদের ‘বেস এরিয়া’ স্থাপন করেছিল, যার মধ্যে মধ্য এশিয়ার দেশ রয়েছে, ইরান রয়েছে, রয়েছে পাকিস্তানও। জাতিগত ও ঐতিহাসিক কারণে পাঠানরা পাকিস্তানের পাঠান অঞ্চল খাইবার পাখতুনখাওয়া বা বেলুচিস্তানের মতো পাঠান-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। বর্তমানে সম্পর্ক খারাপ হলেও যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাই পাকিস্তানের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য তাঁদের দেশে অভ্যন্তরীণ কলহই হোক বা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ, অন্য দেশের ভূমিকা একটা বরাবরই ছিল। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনবুদ্ধিজীবী ফয়েজ জালান্দের মতে, ১৯ শতকে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সময় থেকেই এটা চলে আসছে। সে সময় আফগানদের পাশে পরোক্ষভাবে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়ার রাজপরিবার ইংরেজদের কোণঠাসা করতে।
আফগানিস্তানে যখনই ৩-৪ জন প্রভাবশালী লোক একটা ‘হেজব’ বা দল গঠন করে, তখনই কোনো একটা দেশ তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। যেমন তাজিক নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের পেছনে ছিল ফ্রান্স, হেরাতি ইসমাইল খানের সঙ্গে ইরান, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের পেছনে পাকিস্তান বা উজবেক নেতা রশিদ দোস্তামের পাশে রাশিয়া ও তুরস্ক।
কিছুটা নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তার কারণে এবং কিছুটা অন্য দেশের সাহায্যে এঁরা গৃহযুদ্ধের সময় কখনো নিজেদের মধ্যে লড়েছেন, কখনো লড়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠানদের বিরুদ্ধে, আবার যখন বাইরের শত্রু আক্রমণ করেছে, তখন সবাই মিলে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
তাজিক নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের পেছনে ছিল ফ্রান্স, হেরাতি ইসমাইল খানের সঙ্গে ইরান, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের পেছনে পাকিস্তান বা উজবেক নেতা রশিদ দোস্তামের পাশে রাশিয়া ও তুরস্ক।
যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আইএএসএফের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়, গোষ্ঠী এবং তাদের নেতারা অনেক ক্ষেত্রেই পাঠানদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছেন, যে কারণে বর্তমান মন্ত্রিসভায় তাজিক ও হাজারাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। অতীতে তালেবানের উত্থানের পেছনে পাকিস্তানেরও বড় ভূমিকা ছিল।
আসহাদুল্লাহ নাদিমের যুক্তি
আসহাদুল্লাহ নাদিম একজন অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক, যিনি ইউক্রেনের সামরিক স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। লেখালেখি করতেন মূলত যুদ্ধ নিয়ে, বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। চলে গেছেন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ফারইয়াবের গারজিয়ান অঞ্চলে, কাবুল থেকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরে। শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। ফারসি অনুবাদকের সাহায্যে তাঁকে টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম তালেবানের জয়ের প্রধান কারণ সম্পর্কে। সালাম জানিয়ে এই উজবেক সাংবাদিক তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিলেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা ও দুর্নীতি
তালেবানদের একটা নির্দিষ্ট ধরনের ‘মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত’ হওয়াটাকে একটা বড় কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন নাদিম। বললেন, ‘আপনি দেখবেন, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তালেবানদের সবাই একই মতামত দেবেন। এঁদের মধ্যে প্রবল একতা, মতবিরোধ প্রায় নেই। এর কারণ, এঁরা ছোট থেকে একই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত। যেকোনো লড়াইয়ে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা যেহেতু অত্যন্ত জরুরি, তাই এঁদের একটা স্বাভাবিক সুবিধা বরাবরই ছিল।’
যখন আমেরিকা তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইল, তখন গনি সরকারের ওপর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর আস্থা পুরোপুরি চলে গেল। এরপর সরকারের পতন ছিল সময়ের অপেক্ষাআসহাদুল্লাহ নাদিম, অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক, আফগানিস্তান
অপরদিকে আশরাফ গনির নেতৃত্বাধীন সাবেক আফগান সরকারের মধ্যে কার্যত সব বিষয়ই ছিল মতপার্থক্য। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বললেন, একটি ‘সার্বিক আফগান জাতীয় স্বার্থ বলে গনি সরকারে কিছু ছিল না।’ এর একটি কারণ দুর্নীতি। প্রধানত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিপুল অর্থ গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রবেশ করছিল। এর অনেকটাই উধাও হয়ে যায়।
আফগানিস্তান পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে বিপুল অর্থ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে তদন্ত করছে। তদন্তকারী সংস্থা ‘স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন (শিগার)’ ধারাবাহিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখাচ্ছে কীভাবে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মিলেমিশে আফগানিস্তানের প্রভাবশালীরা অর্থ তছরুপ করেছেন। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।
নাদিম বলেন, ‘এসবের ফলে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছিল। এরপর ২০১৯-২০ সালে যখন আমেরিকা তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইল, তখন গনি সরকারের ওপর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর আস্থা পুরোপুরি চলে গেল। এরপর সরকারের পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা।’
তৃতীয়ত, সরকার ও প্রশাসনের ভেতরেই এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা অর্থ বা তথ্য দিয়ে তালেবানকে সাহায্য করছিলেন। নাদিম বললেন, ‘প্রভাবশালীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে তালেবান ক্ষমতায় আসতে চলেছে। ফলে তাদের রাগাতে চাননি। আবার এটাও ঘটনা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল যৌথ বাহিনী এবং আফগান সরকার।’
অসংখ্য শক্তিশালী নেতা ও আমলাকে তালেবানরা হত্যা করেছিল। ফলে সরকারের ওপর সমাজের প্রভাবশালী অংশ আর আস্থা রাখতে পারছিল না। কিন্তু এরপরও দীর্ঘদিন তারা সরকারকে সমর্থন করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক সরকারের এক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, এর কারণ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, অন্য দেশ বা সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে সমাজের মাথারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করছিলেন। এক একজন তিন-চারটি চাকরি করছিলেন। প্রকাশ্যেই প্রবল দুর্নীতি চলছিল।
সাবেক সাংবাদিক আসহাদুল্লাহ নাদিম বলেন, ‘একটা সময়ের পর অবশ্য সমাজের এই অংশ বুঝতে পারে যে খেলা শেষ হয়ে আসছে। এটা যখন আমেরিকা বুঝতে পারে এবং তালেবানকে আলোচনায় ডাকে, তখন দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া আশরাফ গনির সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।’
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের মূল্যায়ন
আফগানিস্তানের শক্তিশালী পশ্চিমা বাহিনীর পতন নিয়ে ইতিমধ্যে লিখেছেন মূলত পশ্চিমেরই বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা। এর মধ্যে ২০২৩ সালের একটি বই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ‘রিটার্ন অব দ্য তালেবান’, লেখক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পাকিস্তানি-আমেরিকান অধ্যাপক হাসান আব্বাস। তালেবানের জয়ের তিনটি কারণ অধ্যাপক আব্বাস বইটির ভূমিকায় সংক্ষেপে বলেছেন।
অধ্যাপক আব্বাস বলছেন, কাবুল পতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তালেবানদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে কঠোর দর-কষাকষি। ক্ষমতায় ফেরার এটাই প্রধান কৌশল ছিল। আলোচনা চালানোর পাশাপাশি তালেবানরা কাবুলের ওপর চাপ বাড়ায় লাগাতার লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে। মনে রাখতে হবে এই চাপ বাড়ানোর ‘প্রধান কৌশল ছিল একের পর এক আত্মঘাতী হামলা’।
তৃতীয় কারণটিকে ‘চমকপ্রদ’ বলে চিহ্নিত করে আব্বাস লিখেছেন, তালেবানরা গোপনে সারা দেশের প্রভাবশালী উপজাতি ও গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে তাদের বোঝায় যে পরবর্তী সময়ে তালেবানের প্রতিশোধ এড়াতে তাদের ‘শান্তিচুক্তি’ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। প্রয়োজনে তালেবান এদের ঘুষও দেয়। এসব তারা করতে পেরেছিল কারণ তালেবান অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানত কীভাবে আত্মসমর্পণকারীদের নিজের দিকে নিয়ে আসতে হয়।
দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারেনি তালেবান ভেতরে-ভেতরে কীভাবে কাজ করছে। তাদের পতনের সেটা একটা বড় কারণ।
মোল্লা ওমরে আগ্রহ
অনেকেরই বক্তব্য বিশেষত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের, যে তালেবানের জয়ের নায়ক মোল্লা মোহম্মদ ওমর। তাঁকে নিয়ে ইতিমধ্যে বিস্তর লেখাপত্র বেরিয়েছে, বেরিয়েছে বইও। ঠিক কী করেছিলেন তিনি, তা সঠিকভাবে জানা মুশকিল। কারণ, তিনি মারা যাওয়ার আগে (২০১৩) নিজের সম্পর্কে কার্যত কিছুই বলেননি। তবে আফগানিস্তানের ভেতরে-বাইরে তাঁকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রচুর। সেসব গবেষণার ভিত্তিতেই আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনীতির নায়ক মোল্লা ওমরকে নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রইল।