সড়কে ট্রাফিক জ্যাম, রক্ষণাবেক্ষণের কাজসহ নানা ধরনের ঝক্কি গাড়িচালকদের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। এরপরও থেমে থাকার ফুরসত নেই। সব প্রতিবন্ধকতা সামলে প্রতিদিন ছুটে যেতে হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু বিশ্বের নানা প্রান্তে এমন কিছু সড়ক আছে, যেগুলো পাড়ি দিতে গিয়ে এই গতিময়তায় ছেদ পড়তে পারে। মনে বেজে উঠতে পারে ভয়াবহ বিপদের অশনিসংকেত। ২০২৪ সালের জন্য এমনই বিপজ্জনক ১০টি সড়কের তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন। পাঠকদের জন্য এসব সড়কের খুঁটিনাটি তুলে ধরা হলো।
কেলং কিশ্তওয়ার সড়কের অবস্থান ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশের মধ্যবর্তী সীমান্তে। এটির দৈর্ঘ্য ২৩৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের খাঁজ কেটে নির্মাণ করা সড়কটি এতই সরু যে একই সময়ে পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলতে পারে না। পাথর ও মাটির টুকরা দিয়ে ভরা এই সড়কের এক পাশে সুবিশাল পাহাড়ের সারি আর অন্য পাশে প্রায় এক হাজার ফিট নিচ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। সেখানে সুরক্ষার জন্য নেই কোনো প্রতিবন্ধক পিলার। ফলে গাড়ি চালানোর সময় সামান্য এদিক-সেদিক হলে এই সড়ক ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। কেলং কিশওয়ার সড়ক বিশ্বের বিপজ্জনক সড়কগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সার্বিয়ায় স্থানীয়ভাবে এ সড়ক ‘ব্ল্যাক হাইওয়ে’, ‘স্টেট রোড ২২’ বা ‘ইবার হাইওয়ে’ নামে পরিচিত। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বিপজ্জনক সড়কগুলোর একটি। পাশাপাশি দেশটির ব্যস্ততম সড়কও এটি। মহাসড়কটি সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের সঙ্গে দেশটির অন্যান্য বৃহৎ শহর, মন্টেনেগ্রোসহ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশকে সংযুক্ত করেছে। সড়কটির দৈর্ঘ্য ২৯৮ কিলোমিটার। প্রশস্ত এই সড়কের অনেক স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে, যার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। রাতে দুর্ঘটনা বেশি হয়। বিশেষ করে মদ্যপান করে দ্রুতগতিতে গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন অনেকে।
রোমানিয়ার ট্রান্সফাগারাসান মহাসড়ক ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর সড়কগুলোর একটি। তবে ইউরোপের অন্যতম বিপজ্জনক সড়কও এটি।
উঁচু–নিচু এবং আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি সড়ক কোথাও কোথাও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় উঠে গেছে। ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি দিয়ে যেতে চোখে পড়বে অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিশাল উচ্চতা, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এবং সুড়ঙ্গের কারণে প্রতিবছরই পর্যটকেরা এই সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েন। স্থানীয় মেষপালকরা ভেড়া চারণভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পথটি ব্যবহার করে। সড়কের মাঝখানে ভেড়ার পালের কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হন গাড়িচালকেরা। সুতরাং কারও কোথাও যাওয়ার তাড়া থাকলে এই সড়ক এড়িয়ে চলা ভালো।
স্কিপারস ক্যানিয়ন নিউজিল্যান্ডের একটি গিরিখাত। এটির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে শটওভার নদী। ১৮৬২ সালে এই এলাকায় সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল। তখন খনিতে যাওয়ার জন্য গিরিখাতের মধ্য দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এ কারণে খনি০শ্রমিকেরা পাথর খোদাই করে স্কিপারস ক্যানিয়ন সড়ক নির্মাণ করেন।
গিরিখাতের নরম পাথরের কারণে বৃষ্টি হলে সড়কটি খুব পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। আবার শুষ্ক মৌসুমে পাথর ভেঙে সড়কে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে। ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি একমুখী যাতায়াতের জন্য বেশ প্রশস্ত। কিন্তু এটি কোথাও কোথাও খাড়াভাবে উঁচু–নিচু, রয়েছে অসংখ্য সর্পিল বাঁক। বাঁকে বাঁকে বিপদ অপেক্ষা করলেও পর্যটকদের কাছে এই এলাকা জনপ্রিয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় জেমস ডাল্টন মহাসড়ক অবস্থিত। ৬৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি আলাস্কার ফেয়ারব্যাংক শহর থেকে শুরু হয়ে ডেডহর্সে শেষ হয়েছে। টেলিভিশন শো ‘আইস রোড ট্রাকার্স’–এর জন্য সড়কটি অনেক জনপ্রিয়। এ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আলাস্কার একজন প্রকৌশলীর নামে। এটি তেল ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য জ্বালানি ও সরবরাহ পরিবহনের জন্য প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সড়কটির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাকা, বাকি অংশ আলগা নুড়ি ও পাথর দিয়ে তৈরি। বরফ, তুষারপাতসহ প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এই সড়কে গাড়িচালকদের প্রায়ই বিপদে পড়তে হয়। এ ছাড়া মেরু ভালুকের আনাগোনাও কখনো কখনো ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতের জোজিলা পাস একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এটি লাদাখ অঞ্চলকে কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে যুক্ত করেছে। হিমালয়ের পর্বতমালার উঁচুতে অবস্থান হওয়ার কারণে সড়কটিতে প্রচুর পরিমাণে বরফ ও তুষারপাত হয়ে থাকে। এ কারণে মাসের পরপর বন্ধও থাকে এই সড়ক। দুটি গাড়ি চলাচলের জন্য সড়কটি যথেষ্ট প্রশস্ত। সড়কের এক পাশে সুউচ্চ পাহাড়, অন্য পাশে গভীর খাত। কিন্তু সুরক্ষার জন্য কোনো প্রতিবন্ধক পিলার নেই এ সড়কে। ফলে সামান্য অসচেতনতার কারণে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।
পাকিস্তানে অবস্থিত ফেইরি মেডোজ সড়ক কারাকোরাম মহাসড়ককে ফেইরি মেডোজ জাতীয় উদ্যানের তাতোর গ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। পাহাড়ের খাঁজ কেটে তৈরি সড়কটি কিছু কিছু জায়গায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় উঠেছে। এটি দিয়ে একই সময়ে পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলতে পারে না। নেই কোনো সুরক্ষা প্রতিবন্ধক। এ সড়কে চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে খাদের নিচে পড়ে যাওয়ার তীব্র ঝুঁকি থাকে। অত্যন্ত বিপজ্জনক হওয়ায় এ সড়কে শুধু স্থানীয় ব্যক্তিদের গাড়ি চালানোর অনুমতি আছে।
বলিভিয়ার উত্তর ইউঙ্গাস সড়কটি ‘মৃত্যু সড়ক’ নামেও পরিচিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সড়কগুলোর মধ্যে একটি। ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ শহরকে দেশটির ইউঙ্গাস অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এটির পার্শ্ববর্তী এলাকায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ একটি বিকল্প সড়ক তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবছর এ সড়কে ২০০-৩০০ প্রাণহানি হতো বলে দাবি করা হয়। পাহাড়ি এই সড়কের পুরোটা নুড়িপাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। কুয়াশা ও বৃষ্টি এ সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
সিচুয়ান-তিব্বত মহাসড়ক বিশ্বের উচ্চতম সড়কগুলোর মধ্যে একটি। এ সড়কে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ উচ্চতা। তিব্বতের কুইর পর্বতের ভেতর দিয়ে নির্মিত ঘূর্ণমান সড়কটি চীনের সিচুয়ান প্রদেশকে তিব্বতের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। একমুখী এই সড়কে তুষারপাত এবং ভূমিধস এড়িয়ে অনেক উচ্চতায় গাড়ি চালানো যেকোনো চালকের জন্য একটি পরীক্ষা। প্রকৃতির বিবেচনায় এটি অত্যন্ত ব্যস্ত সড়ক। ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে কখনো কখনো পুরো মহাসড়ক পার হতে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।
তুরস্কের বেবার্ট ডি৯১৫ সড়কটিকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর সড়ক। অসংখ্য সর্পিল বাঁকযুক্ত সড়কটি তৈরি করা হয়েছে পাহাড় কেটে। এটি উত্তর উপকূলে কৃষ্ণ সাগরকে বেবার্ট শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। একসময় চীন ও ইউরোপের মধ্যে প্রাচীন সিল্ক রোড বাণিজ্য পথের অংশ ছিল এই সড়ক। স্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। সড়কের খারাপ অবস্থা এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।