একটি বই ও আরব বিশ্বে যৌনতা নিয়ে ট্যাবু ভাঙার গল্প

শিরিন আল ফেকির বই ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটাডেল: ইনটিমেট লাইফ ইন আ চেঞ্জিং আরব ওয়ার্ল্ড’–এর প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

শিরিন আল ফেকি যুক্তরাজ্যের একজন সাংবাদিক ও লেখক। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আলোচনা বেশি আরব বিশ্বে। ২০১৩ সালে তাঁর ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটাডেল: ইনটিমেট লাইফ ইন আ চেঞ্জিং আরব ওয়ার্ল্ড’ বইটি প্রকাশের পর আলোচনা ও বিতর্ক আরও বেড়ে যায়।

বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগে আমরা এর লেখক সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। শিরিনের জন্ম যুক্তরাজ্যে, বাবা মিসরীয় আর মা ওয়েলসের। তবে শিরিন বেড়ে ওঠেন কানাডায়, যদিও শিকড় থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি।
শিরিন আল ফেকির লেখাপড়া ইমিউনোলজি বা রোগ প্রতিরোধবিদ্যার ওপর। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে বিএসসি, ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ থেকে এমফিল ও পিএইচডি। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৯৮ সালে শিরিন প্রখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে যোগ দেন হেলথকেয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জোড়া বোমা হামলা তাঁর চিন্তায় বড় পরিবর্তন আনে। তিনি আরবি শেখা শুরু করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর গবেষণায় ব্রতী হন। গবেষণার বিষয় ঠিক করেন নানা ধরনের সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি ও নারীদের যৌনতা। এ জন্য তিনি মিসরে তাঁর দাদির কাছে গিয়ে থাকা শুরু করেন।

২০০৫ সালে শিরিন ইকোনমিস্ট ছেড়ে যোগ দেন কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল–জাজিরায়। সেখানে ‘পিপল অ্যান্ড পাওয়ার’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। ২০১০ থেকে ২০১২, এই দুই বছর তিনি কাজ করেছেন এইচআইভি–বিষয়ক জাতিসংঘের গ্লোবাল কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে। এসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাঁর গবেষণা চলতে থাকে। এই গবেষণার ফল হিসেবে বের হয় তাঁর ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটাডেল: ইনটিমেট লাইফ ইন আ চেঞ্জিং আরব ওয়ার্ল্ড’ বইটি।

বইটি প্রকাশের পর যৌনতার মতো একটি ট্যাবু ইস্যুতে রক্ষণশীল আরব সমাজে আলাপ-আলোচনার দরজা খুলে যায়। বিবিসিসহ প্রভাবশালী অনেক গণমাধ্যম নানা আঙ্গিক থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অনেক বৈশ্বিক সংস্থা গবেষণায় আগ্রহ দেখায়।

কী আছে বইটিতে

বইটির পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে আসা যাক। কী আছে বইটিতে? বইটির মোদ্দাকথা হচ্ছে, তুমি যদি কোনো ব্যক্তিকে ভালো করে জানতে চাও, তোমাকে তাঁর বেডরুম থেকে শুরু করতে হবে। বলা যেতে পারে, আরব বিশ্বের যৌনতার ইতিহাস নতুন করে সামনে এনেছে বইটি। মিসরসহ আরব বিশ্বের নারী ও পুরুষদের যৌন আচরণ লেখক তুলে ধরেছেন টানা পাঁচ বছরের মাঠপর্যায়ের গবেষণার আলোকে। দাম্পত্যজীবনে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌনতাবিষয়ক লেখালেখি থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের এসব দৃশ্য কাটছাঁট, যৌন শিক্ষা বিষয়ে বিতর্ক, গর্ভপাত, বিবাহ ছাড়া মাতৃত্বসহ যৌনতাকেন্দ্রিক যত বাণিজ্য, সব বিষয়ে গবেষণার জায়গা থেকে তথ্য ও তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। তবে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেয়ে সমাধানের পথ নিয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে। তরুণ-তরুণীরা কীভাবে তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধান করছেন, তা বিশেষভাবে আনা হয়েছে।

বইয়ের উপসংহারে এসে ১৯৬৭ সালে জন্ম নেওয়া শিরিন আল ফেকি বলেছেন, যৌনতাকে ঘিরে যে ট্যাবু আরব সমাজে রয়েছে, তা ভাঙতে শুরু করেছে। আর এটা খুব জরুরি যে ব্যক্তিগত জীবনে এসব নিয়ে আলোচনা করা না গেলে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বৃহত্তর গণ্ডিতে কোনো পরিবর্তন আনা কঠিন।

বইটি প্রকাশের পর আরব বিশ্বের তরুণ-তরুণীদের যৌন আচরণ নিয়ে নানাভাবে কাজ করার সুযোগ আসে শিরিনের কাছে। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি প্রতিবেদন লেখেন বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। এ রকমই একটি প্রতিবেদন লেখেন ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই বিবিসিতে, ‘যৌনতা নিয়ে কথা বলা আরব বিশ্বে এখন আর কোনো ট্যাবু ইস্যু নয়’ শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনে ১০টি আরব দেশ ও ফিলিস্তিনে বিবিসি পরিচালিত একটি মতামত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরদাতাদের একটি বড় অংশ একজন নারীর একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকারকে মেনে নিতে সম্মতির কথা জানান। কিন্তু যৌনতা ও লিঙ্গ বিষয়ে সামগ্রিক চিত্র ছিল রক্ষণশীল। উত্তরদাতাদের অধিকাংশ এখনো মনে করেন, পারিবারিক বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত পরিবারের কর্তা বা স্বামীর হাতেই থাকা উচিত। তাঁরা অনার কিলিংকে মেনে নেবেন, কিন্তু সমকামিতাকে নয়।

আবার আরবের সবখানেই যে এত রক্ষণশীলতা আছে, তা নয়। মুনতাদা আল-জেনসানিয়া নামের একটি সংগঠন কাজ করছে ফিলিস্তিন অঞ্চলে। ফিলিস্তিনি সমাজে যৌনতার অধিকার এবং যৌন শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবনার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। সাফা তামিশ নামের এক নারী এই সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ইসরায়েলে বসবাসরত আরবদের মধ্যে কাজ শুরু করার পর এখন পশ্চিম তীরেও শাখা খুলেছে তারা। সংগঠনটি বলছে, আরবিতে ‘সেক্স’ শব্দটি অনেকের কাছেই গালির সমতুল্য। আরবিতে না বলে বরং ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় যৌনতা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাঁরা। ফিলিস্তিনিরা যেন তাঁদের শরীর ও যৌনতা নিয়ে মাতৃভাষা আরবিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, সংগঠন হিসেবে মুনতাদার লক্ষ্য এটাই।

আরেকটি চিত্র

যৌনতা নিয়ে আলোচনা করতে আরব তরুণেরা দ্বিধান্বিত হলেও গত বছরের জুলাইয়ে বিবিসির আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা যৌন শক্তি বাড়ানোর ওষুধের দিকে ঝুঁকছেন। ভেষজ ওষুধের ব্যবহার তো আছেই, বরং সিলডানাফিল (বাণিজ্যিকভাবে ‘ভায়াগ্রা’ নামে পরিচিত), ভারডেনাফিল এবং টাডালাফিলের মতো ওষুধ ব্যবহার করছেন। প্রতিবেদনে ২০১২ সালের এক গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, আরব বিশ্বে কামোদ্দীপক ও ধ্বজভঙ্গের ওষুধের মাথাপিছু ব্যবহারের দিক থেকে মিসরের অবস্থান দ্বিতীয়। শীর্ষে আছে সৌদি আরব। ওই গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে খবর বেরিয়েছিল সৌদি সংবাদপত্র আল-রিয়াদে। তাতে বলা হয়েছিল, সৌদিরা তখন যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধের পেছনে বছরে খরচ করতেন দেড় শ কোটি ডলার। সম্প্রতি ‘আরব জার্নাল অব ইউরোলজি’র এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা তরুণ সৌদি পুরুষ তাঁদের জীবনে কোনো না কোনো সময় ভায়াগ্রার মতো ওষুধ ব্যবহার করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। ছোট্ট ধনী দেশ বাহরাইন, যুদ্ধবিধস্ত ইয়েমেন, উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়াও এসব ওষুধ ব্যবহারে পিছিয়ে নেই।

কিন্তু গবেষণায় এ রকম প্রমাণ মেলার পরও তরুণেরা বিবিসির কাছে যৌন সমস্যার কারণে এ রকম ওষুধ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা এই ওষুধের নামও শোনেননি। গবেষকেরা বলছেন, এতে একেবারেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এটি নিয়ে কথা বলা ‘সমাজের নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে’।

কেন ওষুধের প্রয়োজন পড়ছে

আরব দেশগুলোয় যৌন উত্তেজক ওষুধ ব্যবহারের চাহিদা এত বাড়ছে কেন? এ বিষয়ে শিরিন আল ফেকি ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য নিয়ে বড় সমীক্ষার তথ্য টেনে বলেছেন, আরবের পুরুষত্বের সংস্কৃতিতে যৌন ক্ষমতার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। যৌনতায় কে কত পারদর্শী, সেটার ওপর এখন আরও বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া পর্নোগ্রাফিতে আসক্তিও এর জন্য দায়ী। তাঁর মতে, এসব দেখে যৌনকর্ম সম্পর্কে একধরনের ভুল ধারণা ও প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে। সেটার কারণেই এখন পুরুষদের যৌন সক্ষমতার ওপর অনেক বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। পুরুষত্ব বলতে প্রকৃত অর্থে কী বোঝায়, কোনটা স্বাভাবিক, পর্নোগ্রাফি সেই ধারণাই পাল্টে দিচ্ছে। এসব কারণেই এ রকম ওষুধের ব্যবহার বাড়ছে।

একই কারণে কিছু আরব শেখ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বছরের পর বছর ধরে অতি বিরল হুবারা বাস্টার্ড পাখি শিকার করছেন, যে পাখির মাংস যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে সহায়ক বলে প্রচলিত। পরিবেশ ও প্রকৃতি সংক্ষরণবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন পাখিটিকে লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পরও পাকিস্তান সরকার আরব শেখদের নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

সাংবাদিক ও লেখক শিরিন আল ফেকি
ছবি: সংগৃহীত

পুনশ্চ শিরিনের বই

শিরিন আল ফেকি তাঁর বইয়ে যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য প্রযোজ্য নয়। সব রক্ষণশীল সমাজের জন্যই তাঁর একই বার্তা। তবে গত কয়েক বছরে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান যেসব সংস্কার এনেছেন, বিশেষ করে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, ফুটবল মাঠে বসে খেলা দেখার অধিকার, সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ, তা শিরিন আল ফেকির লড়াইকেই এগিয়ে নেয়। মাসা আমিনির মৃত্যুর পর আন্দোলেনের মুখে ইরানে নীতি পুলিশের তৎপরতা স্থগিত রাখাও একধরনের সাফল্য বলা যেতে পারে।

যৌনতাসহ ট্যাবু ইস্যুগুলো নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, ততই সামাজিক নানা শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে। শিরিন আল ফেকি যেমনটা বলেছেন, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হলে এ বিষয় নিয়ে কথা বলা ও বোঝাপড়া তৈরি করা জরুরি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, শিরিন আল ফেকিকে নিয়ে প্রকাশিত একাধিক নিবন্ধ ও ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটাডেল: ইনটিমেট লাইফ ইন আ চেঞ্জিং আরব ওয়ার্ল্ড’ বই।

কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]