এশিয়ার ৬ দেশসহ যে ১০ দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি শুল্কারোপ করলেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ককেই তাদের নতুন বাণিজ্য কৌশলের মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ২ এপ্রিল একগুচ্ছ দেশের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর বিশ্ববাণিজ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। দেশে দেশে পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। রাতারাতি কোটি কোটি ডলারের সম্পদ হারিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা। চীনসহ কয়েকটি দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। গত বুধবার ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেন। যে ১০ দেশ ও অঞ্চলের ওপর ট্রাম্প সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন, তাদের নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।

লেসেথো (৫০ শতাংশ)

লেসেথোর একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্পের সর্বশেষ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে আফ্রিকার দেশ লেসেথো এবং কানাডা উপকূলে অবস্থিত ফরাসি অঞ্চল সেন্ট পিয়েরে ও মিকেলেনের ওপর। শুল্ক আরোপের ঘোষণার দিন ট্রাম্প লেসেথো সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন একটি জায়গা, কেউ এমনকি এর নামও শোনেনি।’ সেই লেসেথোর ওপরই তিনি রেকর্ড ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। সেদিন আর কোনো দেশের ওপর ট্রাম্প এত শুল্ক আরোপ করেননি। ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপ লেসেথোর দুর্বল অর্থনীতিকে আরও বিপন্ন করে তুলবে। কারণ, দেশটির অর্থনীতি ভীষণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে মূলত টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করে। যেমন ডেনিম জিনস। মাত্র ছয় হাজার মানুষের ছোট্ট দ্বীপাঞ্চল পিয়েরে অ্যান্ড মিকেলনের ওপর ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। কেন করেছেন, তা বুঝতে পারছেন না বাণিজ্য ও রাজনীতি বিশ্লেষকেরা। এখানকার মানুষ মূলত মৎস্যজীবী, সমুদ্র থেকে মাছ এবং সামুদ্রিক খাবার সংগ্রহ করেই তাঁদের জীবন চলে। এখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো পণ্য রপ্তানি হয় না।

কম্বোডিয়া (৪৯ শতাংশ)

কম্বোডিয়ার একটি বন্দরের ছবি। দেশটি থেকে তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়
ফাইল ছবি: এএফপি

ট্রাম্পের সর্বশেষ শুল্ক আরোপের পর চাকরি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন কম্বোডিয়ার পোশাকশ্রমিকেরা। এশিয়ার এই দেশটির ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পোশাক তৈরির কারখানা অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নিতে পারে। কম্বোডিয়ার অর্থনীতি তৈরি পোশাক এবং জুতা রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশটির অর্ধেকের বেশি কারখানার মালিক চীনারা।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার এক দিন পর (৪ এপ্রিল) কম্বোডিয়া সরকার ট্রাম্পকে খুশি করতে দ্রুত ১৯টি পণ্য শ্রেণির ওপর শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয়। যেন দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত। ওই চিঠিতে তিনি ট্রাম্পকে তাঁর দেশের ওপর শুল্ক আরোপ স্থগিত করার অনুরোধ করেছেন।

লাওস (৪৮ শতাংশ)

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসের ওপর ৪৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেশটির ওপর ব্যাপকভাবে বোমা বর্ষণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এডিবির তথ্যানুযায়ী, দুর্বল অর্থনীতির দেশ লাওসে ১৮ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে লাওস।

মাদাগাসকার (৪৭ শতাংশ)

বিশ্বের সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোর একটি আফ্রিকার দেশ মাদাগাসকার। দেশটির ওপর ট্রাম্প ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা দেশটির রপ্তানি খাতের মূল ভিতকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এতে পুরোপুরি ধসে পড়তে পারে আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় থাকা দেশটির অর্থনীতি। মাদাগাসকারের রপ্তানি পণ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গন্তব্যস্থল যুক্তরাষ্ট্র। মাদাগাসকার সরকার থেকে বলা হয়েছে, তারা বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সব উপায় ব্যবহার করে সে দেশের ওপর আরোপ করা শুল্ক পুনর্মূল্যায়ন করতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।

ভিয়েতনাম (৪৬ শতাংশ)

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের বড় সরবরাহকারী দেশের একটি ভিয়েতনাম। এশিয়ার এই দেশটির ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। দেশটির রপ্তানি খাতের ওপর এর বড় প্রভাব পড়বে। তবে খুব সম্ভবত ভিয়েতনাম সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় এসে শুল্কের প্রভাব কমাতে সক্ষম হবে। তবে এ জন্য বিশেষ করে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের আমদানি বাড়াতে হবে এবং সে দেশের বাজারে মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার সহজ করতে সম্মত হতে হবে।

মিয়ানমার (৪৫ শতাংশ)

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মিয়ানমারে এখনো উদ্ধার কাজ চলছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কয়েক দিন আগেই ৭ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে মিয়ানমার। কয়েক বছর ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীর লড়াই চলছে। চীনঘনিষ্ঠ এ দেশটির ওপর ৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নতুন এই শুল্ক পুনঃপর্যালোচনার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বিবেচনা করছে। তবে এখন তারা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্নির্মাণ কাজে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।

শ্রীলঙ্কা (৪৪ শতাংশ)

২০২২ সালে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই এখনো চলছে
ফাইল ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কার মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর দেশটি এই খাত থেকে ১৯০ কোটি ডলার আয় করেছে। যেসব পণ্য রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, সেই তালিকায় ২ নম্বরে তৈরি পোশাক। এ খাতে দেশটির তিন লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এক বিবৃতিতে বলেছেন, নতুন শুল্কের ফলে সম্ভাব্য যেসব বিষয় সামনে আসতে পারে, সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনার জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছে।

ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ (৪২ শতাংশ)

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশ অঞ্চলভুক্ত হলেও এর একটি আলাদা সরকার রয়েছে এবং সেই সরকারই ওই অঞ্চলের বাণিজ্যনীতি নির্ধারণ করে। যুক্তরাজ্য শুধু ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের জিডিপির ৬০ শতাংশ আসে মাছ শিকার থেকে।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ফকল্যান্ড, বেশির ভাগই হিমায়িত মাছ। ট্রাম্প যেসব দেশ ও অঞ্চলের ওপর ৪০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন, তার একটি ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। ফকল্যান্ডের ওপর ৪২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

সিরিয়া (৪১ শতাংশ)

সিরিয়ার হোমস প্রদেশের একটি বাজার
ফাইল ছবি: এএফপি

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়ার ওপরই সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প, দেশটির ওপর ৪১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যদিও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সময় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দরিদ্র দেশ সিরিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছর সিরিয়া থেকে ১ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, সেগুলো মূলত কৃষিপণ্য ও অ্যান্টিক। নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো ব্যাংক লেনদেন হয় না।

১০

মরিশাস (৪০ শতাংশ)

ট্রাম্প আরেকটি দেশের ওপর বিপুল যে শুল্ক আরোপ করেছেন, সেটিকে তিনি পারস্পরিক ও সর্বজনীন বলেছেন। এই পারস্পরিক ও সর্বজনীন শুল্ক আরোপের তালিকায় আফ্রিকার দেশ মরিশাসের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মরিশাসে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে ৮০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস