এআই নিয়ে কেন বিশ্বজুড়ে এত আলোচনা, কেনই–বা এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত। মার্কিন বিশ্লেষকদের মতে, এআই বাজারের আকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১ হাজার ৩৪৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। ২০২৩ সালে এআই বাজার ছিল মাত্র ১৫০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
শিল্প খাতে এআইয়ের দ্রুত বিস্তার ইতিমধ্যে চোখে পড়ছে। আইবিএমের ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ৪২ শতাংশ বড় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রমে এআই যুক্ত করেছে, আর অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ সংস্থা এই প্রযুক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনায় করছে।
এই প্রযুক্তি গ্রহণের ঢেউ এখন জেনারেটিভ এআইয়ের ক্ষেত্রেও প্রবাহিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, জেনারেটিভ এআই হলো একধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা কোনো নির্দেশ মেনে জেনারেটিভ মডেল ব্যবহার করে পাঠ্য, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য ডেটা তৈরি করতে সক্ষম। বর্তমানে ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের অংশ হিসেবে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট কর্মীর ৪৯ শতাংশের প্রায় অর্ধেক কাজেই কোনো না কোনোভাবে এআই জড়িত থাকবে, যা কর্মপরিবেশ ও মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের ধরন আমূল বদলে দেবে।
২০৩০ সালে এআইয়ের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস
এই দশকের শেষে এআইয়ের সক্ষমতা কোথায় পৌঁছাবে? প্রযুক্তিবিদদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন কিছু যুগান্তকারী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাবে, যা বর্তমান ব্যবস্থার পরিধিকে ছাড়িয়ে যাবে। শুধু বিদ্যমান এআইকে আরও কার্যকর করা নয়—এই অগ্রগতি শিল্প খাতজুড়ে এক মৌলিক পরিবর্তন আনবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং শতগুণ দ্রুত কর্মক্ষমতা অর্জন করবে
কোয়ান্টাম এআই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক শক্তিশালী সমন্বয়। এই প্রযুক্তিতথ্য প্রক্রিয়াকরণের এমন গতি এনে দেয়, যা আজকের সর্বাধুনিক কম্পিউটারগুলোকেও প্রাচীন মনে হয়।
এর মূল রহস্য হলো কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট, যা একই সময়ে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে—এটিকে বলা হয় সুপারপজিশন। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিছু গণনা প্রচলিত সিস্টেমের তুলনায় বহু গুণ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে।
প্রাথমিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, কোয়ান্টাম এআইয়ের মাধ্যমে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি পারফরম্যান্স অর্জন সম্ভব। ইতিমধ্যে মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগল ও আইবিএমের মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অ্যাজ–এ সার্ভিস হিসেবে এটি চালু করেছে।
কোয়ান্টাম এআই প্রযুক্তি ওষুধ উদ্ভাবন, বাজার বিশ্লেষণ আরও গভীরভাবে করে ঝুঁকি মূল্যায়ন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় দক্ষতা বাড়ানোসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তবে এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
কোয়ান্টাম সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের কোয়ান্টাম ট্রান্সফরমার কাজ করলেও চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির মতো সিস্টেমের সক্ষমতা অর্জনে কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের শত শত কিউবিট ব্যবহার করে নতুন কোড তৈরি করতে হবে।
বৃহৎ ভাষা মডেলের বিকল্প হবে ছোট এআই মডেল
বৃহৎ ভাষা মডেল বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) নিয়ে যত আকর্ষণই থাকুক না কেন, এখন শিল্প খাতে এক বিপরীত ধারা দেখা যাচ্ছে। আইবিএম, গুগল, মাইক্রোসফট এবং ওপেনএআই—সবাই সম্প্রতি এমন কিছু ছোট ভাষা মডেল (স্মল ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এসএলএম) প্রকাশ করেছে, যেগুলো মাত্র কয়েক বিলিয়ন প্যারামিটারে চলে, বৃহৎ মডেলগুলোর তুলনায় অনেক ছোট আকারে।
এসব ক্ষুদ্র মডেল নির্দিষ্ট ও সীমিত কাজের ক্ষেত্রেই অসাধারণ ফল দেখাচ্ছে—যেমন কথোপকথন সংক্ষেপ করা, চিকিৎসা-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হেলথকেয়ার চ্যাটবট হিসেবে কাজ করা কিংবা স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা। এগুলো ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে সরাসরি চলতে পারে, বিশাল ডেটা সেন্টারের প্রয়োজন হয় না। ফলে খরচ কমে, পরিবেশের ওপর প্রভাবও হ্রাস পায় এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আরও সুরক্ষিত থাকে।
গবেষকেরা এই ছোট মডেলগুলোকে আরও কার্যকর করতে নলেজ ডিস্টিলেশন ও প্রুনিংয়ের মতো কৌশল ব্যবহার করছেন। নলেজ ডিস্টিলেশনে বড় মডেল থেকে শেখা তথ্য ছোট মডেলে স্থানান্তর করা হয়, আর প্রুনিং প্রক্রিয়ায় নিউরাল নেটওয়ার্কের অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেওয়া হয়। ফলে নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী এই ছোট মডেলগুলো সহজেই কাস্টমাইজ করা যায়।
মাল্টিমোডাল এআই টেক্সট ও ছবির সীমা পেরিয়ে যাবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ কেবল লেখা বা টেক্সট বোঝাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে মাল্টিমোডাল এআই সিস্টেম একসঙ্গে টেক্সট, ছবি, অডিও, ভিডিও ও ডকুমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, যা প্রধান ধারার প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এগুলোর শক্তি কোথায়? বর্তমান এআই সাধারণত একধরনের তথ্য নিয়ে কাজ করে, কিন্তু মাল্টিমোডাল সিস্টেম একাধিক তথ্যধারা একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে পারে—মানুষের যোগাযোগের ধরনকে অনেক বেশি বাস্তবভাবে অনুকরণ করে।
এক শিল্পবিশেষজ্ঞের ভাষায়, ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মাল্টিমোডাল যোগাযোগকারী, তাই এআই-ও এখন টেক্সটভিত্তিক সীমিত যোগাযোগ থেকে জটিল, বহুমাত্রিক যোগাযোগের দিকে এগোচ্ছে।’ এই পদ্ধতির ফলে এআই এখন দৃশ্য, শব্দ ও অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্য মিলিয়ে আরও প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবসম্মত দ্বিমুখী কথোপকথন চালাতে পারবে, যা সত্যিকার অর্থে ‘মানুষসদৃশ’ যোগাযোগের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।
শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট কিছু শিল্প খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন শিল্প ও আর্থিক খাত—এই তিন ক্ষেত্রের পরিবর্তন হবে সবচেয়ে গভীর ও বিস্তৃত।
২০২৮ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ রোগ নির্ণয়প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হবে। বর্তমানে ভুল রোগনির্ণয়ের কারণে প্রায় ১০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু ও ১৭ শতাংশ জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে স্বাস্থ্যসেবা খাত দ্রুত এআই প্রযুক্তি গ্রহণ করছে।
চিকিৎসায় রোগনির্ণয়ে এআইয়ের বৈশ্বিক বাজার ২০২৩ সালের ১৩০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২৮ সালে ৩৭০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রথম দিকে এআই চিকিৎসকদের সহায়ক সরঞ্জাম হিসেবেই কাজ করবে, প্রতিস্থাপক নয়। তবে সময়ের সঙ্গে চিকিৎসক-এআই সহযোগিতা আরও নির্ভুলতা আনবে এবং শেষ পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় এআইয়ের প্রতি আস্থা তৈরি হবে।
উৎপাদন শিল্পে প্রভাব রাখবে
বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে এআই প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার নতুন অর্থনৈতিক কার্যক্রম সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা বর্তমানে বৈশ্বিক জিডিপির তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে উৎপাদন খাত একাই পাবে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত মূল্য।
যেসব প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই এআইয়ে বিনিয়োগ করবে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাবে। বিশ্লেষকদের মতে, আগে এআই ব্যবহার করা প্রতিষ্ঠানগুলো দশকের শেষে তাদের নগদ প্রবাহ দ্বিগুণ করতে পারে এবং বার্ষিক গড় ৬ শতাংশ অতিরিক্ত বৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হবে।
কর্মসংস্থানে এআইয়ের প্রভাব
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও শিল্পপ্রয়োগ ছাড়াও এখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে এআই কীভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান কাঠামো বদলে দেবে। নতুন গবেষণা বলছে, এতে যেমন বিশাল বদল আসবে, তেমনি নতুন সুযোগও তৈরি হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এআই বৈশ্বিকভাবে ৪০ শতাংশের বেশি চাকরিকে প্রভাবিত করতে পারে, যাকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন ‘ডিসরাপশন থ্রেশহোল্ড’। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০৩০ সালের মধ্যে মোট কর্মঘণ্টার ৩০ শতাংশ স্বয়ংক্রিয় হতে পারে, বিশেষ করে জেনারেটিভ এআইয়ের কারণে। এতে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ মানুষকে সম্পূর্ণ নতুন পেশায় যেতে হতে পারে। এই প্রভাব অবশ্য সবার জন্য সমান নয়।
নারীরা তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিতে—তাঁদের ৩৬ শতাংশ এমন পেশায়, যেখানে জেনারেটিভ এআই কাজের সময় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারে, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ। কম আয়ের কর্মীরা (যাঁদের বার্ষিক আয় ৩৮ হাজার ২০০ ডলারের নিচে) সর্বোচ্চ আয়কারীদের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি হারে পেশা পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
নতুন পেশার উত্থান ঘটবে
যদিও কর্মক্ষেত্রে চাকরি হারানো নিয়ে বেশি উদ্বেগ রয়েছে। তবে বাস্তবে এআই তৈরি করছে একদম নতুন পেশার দিগন্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতভিত্তিক চাকরির চাহিদা ২৩ শতাংশ বাড়বে, আর এআই ও মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞদের চাহিদা ২০২৭ সাল পর্যন্ত ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বেশি চাহিদা বাড়বে ডেটা অ্যানালিস্ট ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন বিশেষজ্ঞ (৩০-৩৫ শতাংশ), স্বাস্থ্যসেবা টেকনিশিয়ান ও পেশাজীবী (প্রায় ৩৫ লাখ ও ২০ লাখ নতুন চাকরি), এআই ট্রেইনার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ও প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারের।
কর্মী প্রশিক্ষণসংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে ৪২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এআইভিত্তিক প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দেবে, আর ৩৬ শতাংশ সংস্থা বিদ্যমান কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে—এআইয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য।
লড়াই এশিয়া বনাম যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের চিত্রে অঞ্চলভেদে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি ও বিনিয়োগের ধারা দেখা যাচ্ছে, যা ২০৩০ সাল পর্যন্ত এআইয়ের গতিপথ নির্ধারণ করবে। প্রযুক্তিগত অগ্রাধিকারের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন অঞ্চলে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব ও কৌশল গড়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এআইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনকে পেছনে ফেলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
এই নেতৃত্ব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় বেসরকারি বিনিয়োগে, যেখানে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এআই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭২০ কোটি ডলার, আর চীনে ছিল ৭৮০ কোটি ডলার। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্র ৬১টি গুরুত্বপূর্ণ মেশিন লার্নিং মডেল তৈরি করেছে, যা চীনের ১৫টির তুলনায় অনেক বেশি।
তবু চীন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগামী। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটি ৪৪ হাজারের বেশি এআই পেটেন্ট অনুমোদন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ হাজারের প্রায় তিন গুণ।
বৃহত্তর আঞ্চলিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কে কী বলছেন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এ খাতের উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা নতুন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই ভবিষ্যৎ এখনো বহু দূরে, আবার কারও কাছে তা যেন একেবারে দোরগোড়ায়। এআইয়ের সবচেয়ে পরিচিত নাম ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান সম্প্রতি বলেছেন, মানুষ এআইয়ের সঙ্গে ক্রমেই বেশি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলছে এবং এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও গভীর হবে।
এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং বলেন, ‘আমরা এখনো এআই বিপ্লবের শুরুতেই আছি।’ তাঁর মতে, এআই মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং নতুন নতুন ধারণা অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
মেটার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মতে, সুপারইন্টেলিজেন্স এখন নাগালের মধ্যে বা দোরগোড়ায়। তাঁর ভাষায়, ‘এআই আমাদের বিদ্যমান প্রতিটি ব্যবস্থাকে উন্নত করবে এবং এমন সবকিছু তৈরি করবে, যা আজ কল্পনাতেও নেই।’
অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এআইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। তিনি মনে করেন, এটি এমন এক যুগ নিয়ে আসবে, যেখানে মানুষ কম কাজ করবে, আর রোবট ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ভার বহন করবে।
অ্যানথ্রপিকের প্রধান নির্বাহী ডারিও আমোডেই মনে করেন, হোয়াইট-কলার বা অফিসভিত্তিক চাকরিজীবীদের এখন থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এআই আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় অর্ধেক এন্ট্রি-লেভেল চাকরি প্রতিস্থাপন করতে পারে এবং ১০-২০ শতাংশ বেকারত্ব তৈরি হতে পারে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন ভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়, এটি একদিকে বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে অনিশ্চয়তার এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে এ নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রস্তুতিতে গত বছর বিশ্বের ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩তম। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এআই প্রস্তুতি সূচকে (এআইপিআই) এসব তথ্য উঠে আসে।
এআই কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন আকার দিতে প্রস্তুত, তা আইএমএফের গবেষণায় ইতিমধ্যে উঠে এসেছে। গবেষণা অনুযায়ী এআই উন্নত অর্থনীতির দেশের ৩৩ শতাংশ, উদীয়মান অর্থনীতির দেশের ২৪ শতাংশ ও নিম্ন আয়ের দেশে ১৮ শতাংশ চাকরিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অন্যদিকে এআই বিদ্যমান চাকরির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এআই নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। ইতিমধ্যে এআই নিয়ে তৈরি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে। এর বাইরে আগামী ব নির্বাচনে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে এক নতুন উদ্বেগের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে এর আগে যেহেতু নির্বাচনে এআইয়ের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায়নি এবং নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে এখনো তেমন দক্ষতা গড়ে ওঠেনি, কাজেই নির্বাচনে এর অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে দ্রুত মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ দক্ষ মানবসম্পদ ও ডিজিটাল অবকাঠামোয় অনেক পিছিয়ে। শুধু কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট দিয়ে কাজ হবে না। এআইয়ের জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি লাগবে। সবার আগে মনোযোগ দিতে হবে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। তা না হলে এআইয়ের সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্ভাবনসহ তা কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগও কমবে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, কোয়ার্টজ ম্যাগাজিন, নেটগুরু, টেকনোলজি ম্যাগাজিন