বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর ৮০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে। এখন এ সংখ্যা প্রায় ৮২০ কোটিতে পৌঁছে গেছে, যাঁদের প্রায় অর্ধেক শহরে বসবাস করেন।
জীবন–জীবিকার সন্ধানে, শিক্ষার সুবিধাসহ অপেক্ষাকৃত উন্নত নাগরিক সুবিধা পাওয়ার আশা বা কখনো উদ্বাস্তু হিসেবে মানুষ দলে দলে নগরমুখী হচ্ছেন। সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নগরে ভিড় বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেগা সিটির সংখ্যা।
গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরের একটি তালিকায় প্রকাশ করেছে। ওই তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। আগের তালিকায় সবচেয়ে জনবহুল নগর ছিল জাপানের রাজধানী টোকিও।
তবে এবারের তালিকায় সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফন হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসংখ্যার দিক থেকে এখন বিশ্বে ৩৩টি মেগা সিটি রয়েছে। অথচ ১৯৭৫ সালে মেগা সিটি ছিল মাত্র আটটি।
এই মেগা সিটিগুলোর মধ্যে প্রথম ১০টির ৯টিই এশিয়া মহাদেশে। সবচেয়ে জনবহুল নগরের তালিকায় সবার ওপরে থাকা ১০ নগর নিয়ে আজকের আয়োজন।
‘জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টস ২০২৫’ অনুযায়ী, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ৪ কোটি ১৯ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন। দেশটির ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ জাভার পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত জাকার্তা একটি উপকূলীয় নগর।
এর আগে ২০০০ সালে জাতিসংঘ প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকায় জাকার্তা ২ নম্বরে ছিল। তখন ১ নম্বরে ছিল জাপানের রাজধানী টোকিও। গত ২৫ বছরে টোকিওর তুলনায় জাকার্তায় জনসংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি হারে বেড়েছে।
অর্থাৎ জন্মহারের অপেক্ষাকৃত দ্রুত বৃদ্ধি জাকার্তায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। তবে মূল কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনকে দায়ী করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক কার্যক্রম রাজধানীকেন্দ্রিক। এ ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় জাকার্তায় নাগরিক সেবা পাওয়া ও উন্নত অবকাঠামোর সুযোগ বেশি থাকায় গ্রামাঞ্চল থেকে মানুষ জাকার্তা অভিমুখী হচ্ছেন।
তবে এত ঘনবসতিপূর্ণ এই মেগা সিটিতে আবাসন, অবকাঠামো, পরিবহন ও জনসেবার চাহিদা পূরণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত ২৫ বছরে সাত ধাপ এগিয়ে ঢাকা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল নগর। সামনে শুধু জাকার্তা। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২৫ বছর পর জাকার্তাও ঢাকার পেছনে পড়ে যাবে। তেমন আভাসই দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টস ২০২৫–এর প্রতিবেদনে।
যদি তা–ই ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের রাজধানীর জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যদি সংকট এড়াতে হয়, তবে এখন থেকেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ বসবাস করছেন। জাকার্তার মতো ঢাকাতেও অভ্যন্তরীণ অভিবাসন জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ। গত ২৫ বছরে টোকিওর তুলনায় ঢাকায় জনসংখ্যা সাত গুণ বেশি হারে বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা মোট বাসিন্দা ৫ কোটি ২১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
জাপানের রাজধানী টোকিও একসময় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মেগা সিটি ছিল।
অন্যান্য মেগা সিটির মতো টোকিওতেও লোকসংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টোকিও প্রশাসন ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকার উপযোগী পরিপক্ব অবকাঠামো ও অত্যাধুনিক নাগরিক পরিষেবাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে অন্যান্য মেগা সিটির তুলনায় টোকিওতে জনসংখ্যা ধীরগতিতে বাড়ছে।
জাতিসংঘের এবারের তালিকায় টোকিও ৩ নম্বরে, মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ। ২০০০ সালে টোকিওর জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩ লাখ, অর্থাৎ গত ২৫ বছরের জাপানের রাজধানীর জনসংখ্যা ৩১ লাখের মতো বেড়েছে।
ভবিষ্যতেও টোকিও এ ধারা অব্যাহত রাখবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ জনবহুল নগরের তালিকায় টোকিও ৭ নম্বরে নেমে যাবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ প্রকাশিত জনবহুল মেগা সিটির তালিকায় ৪ নম্বরে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। এখানে ৩ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন।
দিল্লির আয়তন প্রায় ১ হাজার ৪৮৪ বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গমাইলে বাস করেন ২৯ হাজার ২৫৯ জনের বেশি মানুষ। বিশ্বের যে কয়টি নগরে জনসংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে, তার একটি দিল্লি। শুধু দিল্লি নয়; বরং পুরো ভারতে গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ।
দিল্লি প্রায় দুই হাজার বছরের বেশি প্রাচীন নগর। ফলে নগরের অবকাঠামো বেশ পুরোনো। তবে এখন দিল্লিতেও অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে এবং অন্যান্য মেগা সিটির মতো এখানেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে দিল্লিতে আসছেন। ফলে সেখানে টেকসই নগরায়ণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সবার জন্য সমান সুযোগ ও সেবা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
দিল্লির প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা নিম্নমানের বাসস্থানে বসবাস করেন বলে ধারণা করা হয়। নগরে শিল্পদূষণ ভয়াবহ মাত্রায়। আশপাশের অঞ্চল থেকে ভেসে আসা কৃষিদূষণও দিল্লির জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। সঙ্গে যানজটের সমস্যাও রয়েছে।
চীনের ইয়াংজি নদীর দক্ষিণ মোহনায় অবস্থিত সাংহাই একসময় ছিল ছোট একটি গ্রাম। তখন এটি জেলেদের গ্রাম হিসেবেই পরিচিত ছিল। পরে চীনের বৃহত্তম নগরে পরিণত হয় সাংহাই। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এটি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ এবং চীনের বৃহত্তম জনবহুল নগর।
বর্তমানে ২ কোটি ৯৬ লাখের বেশি মানুষ সাংহাইয়ে বসবাস করেন। চীনের শহরগুলো ক্রমাগত নগরায়িত হওয়ায় সেখানে মেগা সিটির জনসংখ্যাগত চিত্রও অনেক বদলে গেছে।
কর্মসংস্থান ও সাংস্কৃতিক নানা সুযোগের আশায় চীনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা চীনের নাগরিক ও বিদেশিরা সাংহাইয়ে বসবাস করতে চাইছেন। নগরের মোট বাসিন্দার ৩৯ শতাংশের বেশি দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। ২০৫০ সাল নাগাদ নয়াদিল্লিকে হটিয়ে সাংহাই তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল নগরে পরিণত হবে বলে প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে।
চীনের অর্থনীতিতে সাংহাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নগরে উচ্চ জনসংখ্যার প্রভাব কমাতে কর্তৃপক্ষ পরিবেশ সুরক্ষার বেশ কিছু জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে।
সাংহাইয়ের পরই সবচেয়ে জনবহুল মেগা সিটির তালিকায় ৬ নম্বরে রয়েছে চীনের গুয়াংজু নগর। সেখানে ২ কোটি ৭৬ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এটি চীনের তৃতীয় বৃহৎ নগরী। গুয়াংজু ও এর আশপাশের অঞ্চল ব্যাপকভাবে অভিবাসীপ্রবাহের জন্য পরিচিত।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ছয় মাস বাড়তি আরও প্রায় তিন কোটি অভিবাসী গুয়াংজু ও এর আশপাশের এলাকায় আসেন। বিপুলসংখ্যক এই মানুষকে ‘ফ্লোটিং পপুলেশন’ বলা হয়।
গুয়াংজুর অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে, যে কারণে সেখানে শ্রমের উচ্চ চাহিদা রয়েছে। শ্রমের এই চাহিদা মেটাতেই ফ্লোটিং পপুলেশন গুয়াংজুতে ভিড় করে। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ গুয়াংজু জনবহুল নগরের তালিকায় ৮ নম্বরে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে জনবহুল ১০ মেগা সিটির তালিকায় এশিয়ার বাইরের একমাত্র শহর কায়রো। প্রাচীন নানা স্থাপত্য, বিশেষ করে পিরামিডের জন্য মিসরের রাজধানী কায়রো বিশ্ববিখ্যাত। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যুক্ত দেশটির রাজধানীতে বর্তমান ২ কোটি ৫৫ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, মিসরের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ কায়রোতে বসবাস করেন। দেশটির বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার প্রধান কার্যালয় কায়রোতে অবস্থিত।
এ কারণে অন্যান্য মেগা সিটির মতো জীবিকার প্রয়োজনে বহু মানুষ কায়রোতে বসবাস করেন। নগরের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। অতিরিক্ত জনসংখ্যার পাশাপাশি সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার পর্যটক কায়রোতে আসেন। এ কারণে নগরের সড়কগুলোতে সব সময় যানজট লেগে থাকে।
জনবহুল নগরের তালিকায় ৮ নম্বরে আছে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা। বর্তমানে ২ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ ম্যানিলায় বসবাস করেন। ১৫৭১ সালে গোড়াপত্তন হওয়া এই নগরের লোকসংখ্যা গত শতাব্দীতে দ্রুতগতিতে বেড়েছে, তবে শেষ ১০ বছরে গতি অনেকটা কমে গিয়েছিল।
ঘনবসতিপূর্ণ ম্যানিলায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার পাশাপাশি অপরাধ ও দূষণের মাত্রাও অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রাচীনতম চায়না টাউন ম্যানিলায় অবস্থিত।
ম্যানিলা শত শত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও জাপানের শাসনে ছিল। কিন্তু কেউই এই নগরের উন্নয়নে সত্যিকারের কোনো পরিকল্পনা করেনি।
ভারতের আরেক মেগা সিটি কলকাতা ২০২৫ সালে সবচেয়ে জনবহুল ১০ নগরের তালিকায় স্থান পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন। ভারতের শহরমুখী জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে শুধু রাজধানী নয়াদিল্লিকেন্দ্রিক নয়; বরং অন্যান্য শহরেরও মানুষ বাড়ছে, কলকাতা তার প্রমাণ।
যদিও অন্যান্য নগরের তুলনায় কলকাতায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি খানিকটা হলেও ধীর। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে কলকাতা জনবহুল নগরের তালিকায় ৫ নম্বরে ছিল। এখন কয়েক ধাপ নেমে ৯ নম্বরে গেছে। ২০৫০ সালে আরও এক ধাপ নেমে ১০ নম্বরে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ প্রকাশিত ২০২৫ সালের শীর্ষ ১০ মেগা সিটির তালিকায় সবার শেষে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল। সেখানে প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন। উদ্ভাবন, শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চ জীবনমানের কারণে সিউল বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
সিউল প্রমাণ করেছে, শুধু দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে, এমন দেশগুলোতে মেগা সিটি গড়ে উঠছে না; বরং উন্নত অর্থনীতির দেশেও মেগা সিটি প্রসারিত হতে পারে। সিউলের বৃদ্ধি ও ধারাবাহিক উন্নয়ন মেগা সিটি গড়ে ওঠার একটি ভিন্ন পথ দেখাচ্ছে। আধুনিকীকায়ন, কার্যকর পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের মাধ্যমেও মেগা সিটি গড়ে উঠতে পারে।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড পপুলেশন, ওয়ার্ল্ডোমিটার