অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রিতে বিশ্বে কোন কোন দেশ সবচেয়ে এগিয়ে

বিশ্বজুড়ে যখন যুদ্ধ, ভূরাজনীতি আর সামরিক প্রতিযোগিতা নতুন করে তীব্র হচ্ছে, তখন অস্ত্র–বাণিজ্যের ছবিটাও বদলে যাচ্ছে দ্রুত। যুদ্ধ, আঞ্চলিক উত্তেজনা আর নিরাপত্তাহুমকির বেড়াজালে দেশগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।

সেই চাহিদার ঢেউয়েই বিশ্বজুড়ে কয়েকটি বড় কোম্পানি গড়ে তুলেছে অটুট এক সামরিক শিল্পসাম্রাজ্য। বিশ্বজুড়ে কোন কোন প্রতিষ্ঠান অস্ত্র উৎপাদনে এগিয়ে আছে? চলুন, সেটিই জেনে নেওয়া যাক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যের আলোকে।

লকহিড মার্টিন

লকহিড মার্টিনের লোগো
ছবি: রয়টার্স

লকহিড মার্টিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিরক্ষা ও মহাকাশপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহকারী সংস্থা হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৫ সালে লকহিড করপোরেশন ও মার্টিন মেরিল কোম্পানি একীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে।

এই প্রতিষ্ঠান এফ–৩৫ ও এফ–২২ যুদ্ধবিমান, সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবহন বিমান, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করে। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি ডলার আয় করেছে।

আরটিএক্স

আরটিএক্সের লোগো
ছবি: রয়টার্স

আরটিএক্সও একটি শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বহুজাতিক মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা কোম্পানি। এটির আগের নাম ছিল রেথিয়ন টেকনোলজিস। ২০২০ সালে রেথিয়ন কোম্পানি ও ইউনাইটেড টেকনোলজিস করপোরেশন একীভূত হয়ে আরটিএক্স প্রতিষ্ঠিত হয়।

কোম্পানিটি উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, রাডার প্রযুক্তি, ইঞ্জিন ও মহাকাশপ্রযুক্তি নির্মাণের জন্য পরিচিত। প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, জ্যাভেলিন অ্যান্টিট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরও অনেক আধুনিক অস্ত্রের পেছনে রয়েছে আরটিএক্সের প্রযুক্তি। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার আয় করেছে।

নরথ্রপ গ্রুম্যান

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় নরথ্রপ গ্রুম্যানের একটি কার্যালয়
রয়টার্স

নরথ্রপ গ্রুম্যান যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা ও মহাকাশপ্রযুক্তি কোম্পানি। স্টেলথ প্রযুক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা এবং মানববিহীন নজরদারিব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বিখ্যাত বি–২ স্পিরিট স্টেলথ বোমারু বিমান এবং নতুন প্রজন্মের বি–২১ রেইডার বোম্বার তৈরির দায়িত্বও এদের হাতে।

পাশাপাশি গ্লোবাল হক ড্রোন, স্যাটেলাইট সিস্টেম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তি উন্নয়নে কোম্পানিটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান অংশীদার। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি ডলার আয় করেছে।

বিএই সিস্টেমস

বিএই সিস্টেমসের লোগো
ছবি: রয়টার্স

বিএই সিস্টেমস যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বড় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ইউরোপের সবচেয়ে বড় সামরিক শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, সাঁজোয়া যান, আর্টিলারি সিস্টেম এবং উন্নত অ্যাভিওনিকস—এসব ক্ষেত্রে বিএই সিস্টেমসের সুনাম দীর্ঘদিনের।

ইউরোফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর আধুনিক সাবমেরিন প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৩ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার আয় করেছে।

জেনারেল ডায়নামিকস

সৌদি আরবের একটি প্রদর্শনীতে জেনারেল ডায়নামিকস ট্যাংক
ছবি: রয়টার্স

জেনারেল ডায়নামিকস যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ প্রতিরক্ষাশিল্প প্রতিষ্ঠান। স্থল, সমুদ্র ও সাইবার—তিন ক্ষেত্রেই অস্ত্র তৈরিতে কোম্পানিটির রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এম১ আব্রামস ট্যাংক, স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যান, ভার্জিনিয়া শ্রেণির উন্নত সাবমেরিন এবং উন্নত সামরিক যোগাযোগব্যবস্থা—সবই জেনারেল ডায়নামিকসের তৈরি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থলযুদ্ধ ও নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৩ হাজার ৩৬৩ কোটি ডলার আয় করেছে।

বোয়িং

বোয়িংয়ের লোগো
ছবি: রয়টার্স

বোয়িং বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ নির্মাতা হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও সামরিক খাতেও এটি সমানভাবে প্রভাবশালী। এফ–১৫ ও এফ–১৮ যুদ্ধবিমান, এএইচ–৬৪ অ্যাপাচি হেলিকপ্টার, সি–১৭ গ্লোবমাস্টার পরিবহন বিমান এবং বিভিন্ন স্যাটেলাইটভিত্তিক প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তি বোয়িংয়ের তৈরি।

যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর বিভিন্ন দেশের কাছে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে বোয়িং। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ৩ হাজার ৫৫ কোটি ডলার আয় করেছে।

রোসটেক

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোসটেক। দেশটির সামরিক শিল্পের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এই প্রতিষ্ঠান। সু–৩৫ ও সু–৫৭ যুদ্ধবিমান, কামভ ও মিল সিরিজের হেলিকপ্টার, টি–৯০ ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্যান্টসির—এসব বিখ্যাত রুশ সামরিক সরঞ্জামের পেছনে রয়েছে রোসটেকের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা রপ্তানির বড় অংশই এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ২ হাজার ৭১২ কোটি ডলার আয় করেছে।

এভিআইসি

চীনা বিমান শিল্প করপোরেশন (এভিআইসি) চীনের সবচেয়ে বড় সামরিক বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। জে-২০ স্টেলথ যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ বিমান, পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার এবং উন্নত অ্যাভিওনিকসসহ বিমান-সম্পর্কিত প্রায় সব ধরনের সামরিক প্রযুক্তিতেই প্রতিষ্ঠানটির প্রভাব রয়েছে।

চীনের আকাশ প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অনেক বেশি। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ২ হাজার ৩২ কোটি ডলার আয় করেছে।

নরিনকো

নরিনকো গ্রুপ চীনের প্রধান প্রতিরক্ষা ঠিকাদার এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিরক্ষা করপোরেশন। এটি বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করে।
ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, রকেট আর্টিলারি, ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ছোট অস্ত্র উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে নরিনকোর পণ্য ব্যাপকভাবে রপ্তানি হয়। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ১ হাজার ৩৯৭ কোটি ডলার আয় করেছে।

১০

সিইটিসি

চীনের ইলেকট্রনিকস টেকনোলজি গ্রুপ করপোরেশন বা সিইটিসি মূলত সামরিক ইলেকট্রনিকস, রাডার, যোগাযোগব্যবস্থা ও সাইবার প্রতিরক্ষাপ্রযুক্তি তৈরি করে। ২০০২ সালে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একাধিক ইলেকট্রনিকস গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানার পুনর্গঠনের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

চীনের আধুনিক যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং নজরদারিপ্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক উপাদান সরবরাহের দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর। চীনের সামরিক বাহিনীর ডিজিটাল রূপান্তরে সিইটিসি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অস্ত্র বিক্রি করে ১ হাজার ৮৯২ কোটি ডলার আয় করেছে।

সূত্র: সিপ্রি ডট ওআরজি