বিশ্বের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে কিছু শিল্পী এমন অসাধারণ কাজ করেছেন, যা আজও চিত্রশিল্পের অনুরাগীদের মুগ্ধ করে। কেউ কেউ সেখান থেকে শিল্পের দিশা পান।
চিত্রশিল্পীদের কেউ কেউ তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও মানসিক যন্ত্রণাকে রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁদের সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতিকে ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন।
লেওনার্দো দা ভিঞ্চি থেকে শুরু করে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, অমৃতা শেরগিল, পাবলো পিকাসোর মতো শিল্পীদের প্রতিটি কাজের পেছনে যেন লুকিয়ে আছে তাঁদের জীবনের গল্প, প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার ছাপ। চলুন, জেনে নিই বিশ্বের খ্যাতনামা ১০ চিত্রশিল্পী সম্পর্কে।
ইতালীয় চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি মূলত তাঁর শিল্পকর্মের জন্য খ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে এর বাইরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল। তিনি একজন নকশাকার ও ভাস্কর ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ‘মোনালিসা’ ও ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্ম।
প্রাকৃতিক জগৎ নিয়ে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মধ্যে বেশ কৌতূহল ছিল। তিনি অনেক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর ভাবনাচিন্তাগুলো সময়ের তুলনায় এগিয়ে ছিল। ভিঞ্চির নোটবুকগুলো শারীরবিদ্যাবিষয়ক গবেষণা বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন নিয়ে অধ্যয়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, যন্ত্রপ্রকৌশল ও জ্যোতির্বিজ্ঞান–সম্পর্কিত অঙ্কন ও ধারণায় ভরা। এমনকি তিনি একটি উড়োজাহাজের প্রাথমিক নকশাও করেছিলেন।
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ হলেন আরেকজন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। তিনি ‘স্টারি নাইট’ নামের বিখ্যাত চিত্রকর্মের স্রষ্টা। জীবনের একটা বড় সময় ধরে মানসিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছেন। তবে তাঁর চিত্রকর্মগুলো আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। এসব চিত্রকর্ম যেন দুঃখী মনকেও আনন্দ দিতে পারে।
‘স্টারি নাইট’ থেকে শুরু করে ‘সানফ্লাওয়ারস’ ও ‘পপিজ’–সহ অন্যান্য কাজ আজও তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করছে।
ক্লদ মোনে ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী। তিনি তাঁর ছবিতে আলো নিয়ে খেলা করতেন। আলো ও রঙের ব্যবহার তাঁর কাজকে বিশেষ করেছে। তাঁর আঁকা ‘ইমপ্রেশন সানরাইজ’ চিত্রকর্মটির নাম থেকেই ইমপ্রেশনিজম ধারণাটি এসেছে।
মোনে জাপানি শিল্প, বিশেষ করে কাঠের ছাপচিত্রে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ছবির বিন্যাস আর রঙের ব্যবহারেও সেই প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর বিখ্যাত কাজ ‘ওয়াটার লিলিস’ সেই অনুপ্রেরণারই এক অসাধারণ উদাহরণ।
পাবলো পিকাসোর কর্মজীবন প্রায় আট দশক ধরে বিস্তৃত ছিল। তাঁর শিল্পকর্মগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায়, তাঁর শিল্পভাবনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাত। ২০ শতকের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলনও দেখা যায় তাঁর শিল্পকর্মে।
পিকাসোর কাজগুলো আফ্রিকান ও আইবেরিয়ান শিল্প দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। ২০ শতকে ফ্রান্স উত্তর আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করার পর সে সংস্কৃতির প্রভাব ইউরোপের ওপর পড়ে। আর তা পিকাসোর শিল্পকর্মেও জায়গা করে নেয়।
পিকাসোর আঁকা চিত্রকর্মে মুখোশ আর বিমূর্ত আকারের ব্যবহার সেই প্রভাবেরই নিদর্শন। শিল্পজগতে পিকাসোর প্রভাব অপরিসীম। তিনি কিউবিজম নামের নতুন ধারা গড়ে তোলেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
অমৃতা শেরগিল ২০ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় চিত্রশিল্পী। তিনি পশ্চিমা ও ভারতীয় শিল্পশৈলীর মিশ্রণ করতে পারতেন। ভারতে আধুনিক শিল্পকর্মের অগ্রদূত তিনি।
অমৃতার বাবা ছিলের ভারতীয় বংশোদ্ভূত আর মা হাঙ্গেরীয়। সমাজের নানা বিষয় সম্পর্কে অমৃতা শেরগিলের ভালো জানাশোনা ছিল। তিনি এমন সময়ে চিত্রশিল্প শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, যা নারীদের জন্য বিরল ঘটনা ছিল। অমৃতা শেরগিল নিজের ছবিও এঁকেছিলেন। সেগুলোও বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে।
অমৃতার কাজগুলোকে তাঁর নিজস্ব পরিচয়ের জটিলতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। পাশাপাশি এগুলো সাংস্কৃতিক ও লৈঙ্গিক পরিচয়–সম্পর্কিত বৃহত্তর বিষয়ের ওপর মন্তব্য হিসেবেও বিবেচিত।
মিকেলাঞ্জেলো ছিলেন রেনেসাঁ যুগের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রভাবশালী শিল্পী। তিনি ফ্লোরেন্স শহরে বেড়ে উঠেছেন। এ শহর রেনেসাঁ যুগে শিল্প ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে আঁকা ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম। এ চিত্রকর্মে বুক অব জেনেসিস থেকে বিভিন্ন দৃশ্য উপস্থাপন হয়েছে। এটি তৈরি করতে অ্যাঞ্জেলো চার বছর সময় নিয়েছিলেন।
মানবদেহের গঠন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অধ্যয়নে তাঁর অবদানের প্রভাব তাঁর ভাস্কর্যকর্মে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেভিডের মার্বেল মূর্তি। এটিকে রেনেসাঁ যুগের ভাস্কর্যের এক অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সালভাদর দালি ছিলেন স্পেনের একজন খ্যাতনামা পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী। তিনি তাঁর অদ্ভুত ও কল্পনাপ্রসূত কাজের জন্য পরিচিত ছিলেন, যা প্রথাগত শিল্পকর্মের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দালি মনোবিশ্লেষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তাঁর কাজের জন্য অনুপ্রেরণা নিতেন। দালি যেমন তাঁর ছবির জন্য বিখ্যাত, তেমনি তাঁর গোঁফজোড়ার জন্যও যথেষ্ট খ্যাতিমান। উল্টো দিকে ঘোরানো এ গোঁফ আইকনে পরিণত হয়েছিল।
শন স্কালি সমসাময়িক একজন খ্যাতিমান শিল্পী। তিনি বিশেষভাবে বিমূর্ত চিত্রকর্মের জন্য পরিচিত। তিনি তাঁর কাজের মধ্যে জ্যামিতিক আকার ও রং নিয়ে খেলা করেন। তাঁর জন্ম আয়ারল্যান্ডে। তবে জীবনের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণ থেকে কাজের অনুপ্রেরণা নেন।
স্কালি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তাঁর বড় আকারের বিমূর্ত চিত্রকর্মের জন্য। তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য হলো রং ও টেক্সচারের ব্যবহার, যা গভীরতা ও জটিলতার অনুভূতি জাগায়। এ ধরনের চিত্রকর্মের মাধ্যমে তিনি মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও সংবেদনশীলতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
আরনল্ফ রাইনার একজন অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী। তিনি শিল্পকর্মে নতুন উদ্ভাবন ও পরীক্ষা চালিয়েছেন। রাইনার সম্ভবত তাঁর ‘ওভারপেইন্টিংস’ সিরিজের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই ওভারপেইন্টিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ধ্বংস ও সৃষ্টির থিমগুলো নিয়ে কাজ করতেন। পাশাপাশি স্বত্বাধিকার ও শিল্পকর্মের মালিকানা–সংক্রান্ত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
রাইনার বডি আর্ট আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি স্বপ্রতিচ্ছবির একটি সিরিজ তৈরি করেছিলেন। এসব পোট্রেটে মানুষের মুখকে অনেকটাই আগ্রাসীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই স্বপ্রতিচ্ছবিগুলো তাঁর নিজের পরিচয় এবং মানব অবস্থার বিভিন্ন দিক অন্বেষণ করার একটি উপায় ছিল। বর্তমানে এই শিল্পীর বয়স ৯৫ বছর।
নেদারল্যান্ডসের জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী ভারমির। তাঁকে ডাচ স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা চিত্রশিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারমির তাঁর চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর অনেক চিত্রকর্মে দেখা যায়, নারীরা বিভিন্ন ঘরোয়া কাজ করছেন, যেমন দুধ ঢালছেন, চিঠি পড়ছেন বা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন।
ভারমিরের সবচেয়ে পরিচিত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়াররিং’ ও ‘দ্য মিল্কমেড’। এ চিত্রকর্মগুলো এখনো শিল্পপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। বিশ্বের বড় বড় প্রদর্শনী ও জাদুঘরগুলোতে এসব চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়।