আরামের মূল্য: এসি যেভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করছে

গরম থেকে স্বস্তি পেতে এসির ব্যবহার এখন বিশ্বজুড়ে, কিন্তু এই এসিই বৈষ্ণিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

গরম থেকে আরাম পেতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। তবে এই আরামের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে ধরণিকে। বৈষ্ণিক উষ্ণায়ন নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন দুশ্চিন্তা–উৎকণ্ঠা, সেই সময়ে এসির রাসায়নিক উপাদান কীভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলছে, তার ওপর আলোকপাত করেছেন মার্কিন অধ্যাপক এরিক ডিন উইলসন।

‘আফটার কুলিং: অন ফ্রেয়ন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অ্যান্ড দ্য টেরিবল কস্ট অব কমফোর্ট’ শিরোনামের বইয়ে ঠান্ডা পাওয়ার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বহুল ব্যবহার এবং এটা জলবায়ু–সংকটে কী প্রভাব ফেলছে, সে আলোচনা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান।

শীতলীকরণের জন্য ফ্রিজ, এসিতে যে আধুনিক রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস ব্যবহার করা হয়, সেটি প্রথম আসে ১৯৩০–এর দশকে। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) নামের এই রাসায়নিক ফ্রেয়ন নামে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। এই রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে ওজোন স্তরের ক্ষতি করে। ১৯৮৭ সালের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সিএফসি গ্যাস উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এরপরও প্রতিবছর অক্টোবরে অ্যান্টার্কটিকার ওপরে ওজোন স্তরে ক্ষত দেখা যায়।

বর্তমানে নিষিদ্ধ সিএফসির বদলে হাইড্রোফ্লোরো কার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার করা হচ্ছে। এই গ্যাস ওজোন স্তরের ক্ষতি না করলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কার্বন ডাই–অক্সাইডের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি ভূমিকা রাখছে তা। এখন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের পাশাপাশি গাড়িতে এইচসিএফসির বহুল ব্যবহার করা হচ্ছে।

উইলসনের বইয়ে এসির ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়নি। তিনি স্বীকার করেছেন, দাবদাহের মধ্যে রেফ্রিজারেন্ট জীবন রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে। এই অধ্যাপক বলেছেন, দীর্ঘ সময় উষ্ণ তাপমাত্রা মানুষের মানসিক ও শারীরিক দক্ষতা কমিয়ে দেয়।

শ্রেণিকক্ষে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও এয়ারকন্ডিশনার একটি কার্যকর যন্ত্র। তবে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক এসির ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে আমাদের পৃথিবী আরও শীতল ছিল। নিজেদের আরামের জন্য আমরা নিজ গ্রহকে উষ্ণ করে ফেলেছি।

অধ্যাপক এরিক ডিন উইলসন বলেন, এসি সরাসরি রেফ্রিজারেন্ট শোষণ বা নির্গত করে না। কিন্তু এসি প্রস্তুতকারক রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে, তাদের তৈরি পণ্য বায়ুমণ্ডলে সরাসরি ফ্রেয়ন ত্যাগ করে না। তাদের দাবি, এই প্রযুক্তি পুরোপুরি নিরাপদ।

কারণ, এটা থেকে গ্যাস নিঃসরিত হয় না। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। আসলে কী ঘটে? বিশেষত গাড়ির এসির ক্ষেত্রে, যখন একটি রেফ্রিজারেন্ট কোনো একটি সিস্টেমের মধ্যে চার্জ হয়, একটি এয়ারকন্ডিশনারের মধ্যে, তখন এটা থেকে খুব ধীরে ধীরে গ্যাসের নিঃসরণ ঘটে।

এমনকি এমনটি না ঘটলেও যখন গাড়ির এসি নষ্ট হয়, তখন বিপুলসংখ্যক মানুষ তা রাস্তায় ফেলে দেন। আবার স্তূপ করে রাখা হয় বা এমন কিছু একটা করা হয়, যেটা টেকনিক্যালি অবৈধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। আজকে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, দুটি এসি ভাঙা অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ এগিয়ে সেটা সেগুলোর ঠিকমতো বন্দোবস্ত করবেন, সে সম্ভাবনা কম।

এসির বিকল্প হিসেবে বেশি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন অধ্যাপক এরিক ডিন উইলসন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে নিউইয়র্কে বিপুল পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরেকটি সমাধান হচ্ছে, মৌচাক, উঁইয়ের ঢিবির মতো প্রাকৃতিক উপাদান, যেগুলো তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সহায়ক, সেগুলোকে ব্যবহার করা।

সরাসরি সূর্যের আলো পড়বে না, এমন ব্যবস্থা রেখেই কক্ষে আলো–বাতাস যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। শীতলীকরণের এ কৌশল খুব ব্যয়বহুল নয়।