করোনা মোকাবিলা, কোন দেশ কেমন করল

করোনায় মৃতদের জন্য মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা। ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিল, ৩০ নভেম্বর ২০২০
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাস মহামারি থেকে বিশ্বের মুক্তি এখনো মেলেনি। পুরো একটি বছর এই নতুন ভাইরাসের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে কেটে গেল মানুষের। আক্রান্ত হয়ে শারীরিক দুর্ভোগ ও মৃত্যু—দুইই চলছে সমান তালে। মাঝে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কিছুটা নিম্নগামী হলেও আবার তুমুল ভোগান্তির আভাস দিচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।

কোভিড-১৯ রোগ সম্পর্কে এখনো অনেক তথ্যই মানুষের অজানা। আবার নতুন নতুন ধরনও দেখা দিচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ প্রবল আকার ধারণ করার শুরু থেকেই কিছু কিছু দেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে এই সংকট। মৌলিক বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে পেয়েছে সফলতা। ফলে সেসব দেশে করোনা মহামারি মারাত্মক আকার নিতে পারেনি। আবার কোনো কোনো দেশ খাবি খাচ্ছে কোভিডের জোয়ারে। ওসব দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিমাণও বেশি।

দেশে দেশে করোনার গতিবিধিসংক্রান্ত তথ্য জানাচ্ছে বিশ্বখ্যাত জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি। এর হিসাব অনুযায়ী, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মহামারি পরিস্থিতিতেও ভালো অবস্থায় আছে নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, মরিশাস, ব্রুনেই, ভুটান, ফিজি, আইসল্যান্ড, লাওস, সোমালিয়া, মঙ্গোলিয়া। সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫টি দেশ বা অঞ্চল আছে এ তালিকায়। নিউ ইংল্যান্ড কমপ্লেক্স সিস্টেমস ইনস্টিটিউট বা এনইসিএসআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্লেষণ করে বলছে, এই দেশগুলো করোনাকে পরাজিত করতে পেরেছে। এখন এসব দেশের কয়েকটিতে দৈনিক ভিত্তিতে করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি পাওয়াই যাচ্ছে না। নিউজিল্যান্ড, ব্রুনেই, ফিজির মতো গুটিকয়েক দেশে এখন দৈনিক করোনা সংক্রমণ শূন্য। ভিয়েতনামে আবার গড়ে দৈনিক তিনজন করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে। তাইওয়ানে এ সংখ্যাটি ২। অস্ট্রেলিয়াতে অবশ্য দৈনিক ১৫ জনের দেহে নভেল করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ তালিকার কোনো দেশেই দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ২০ জনের বেশি নয়। ওদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের র্যাঙ্কিংয়ে করোনা পরিস্থিতিতে উপযুক্ত সাড়া দিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা পাঁচটি দেশ হলো নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে ও সিঙ্গাপুর।

এমন কিছু দেশ নিয়ে অবশ্য অনেক আগ থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনা চলছে। নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান আছে এ তালিকায়। এসব দেশ কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, তা নিয়েও বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেসব দেশই সফলতা পেয়েছে, যারা শুরুতেই রোগের বিস্তার ঠেকাতে পেরেছে। সঙ্গে ছিল লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায়, পর্যাপ্ত করোনা শনাক্তের পরীক্ষা ও মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মানায় কড়াকড়ি। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও প্রবলভাবে কার্যকর ছিল এসব দেশে। তাইওয়ান যেমন কনটাক্ট ট্রেসিংয়ে জোর দিয়ে এবং আক্রান্তদের দ্রুত বিচ্ছিন্নকরণের মধ্য দিয়ে রোগের বিস্তার ঠেকিয়ে দিয়েছে। মহামারির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দেশটি এ ব্যাপারে সফল। একই অবস্থা নিউজিল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও। রোগ সম্পর্কে হাতে তথ্য কম থাকলেও বা সীমিত সামর্থ্য নিয়েও, শুধু সুপরিকল্পনার জোরে যে নতুন রোগও ঠেকিয়ে রাখা যায়, তা দেশগুলো দেখিয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে করোনায় সবচেয়ে নাজেহাল পরিস্থিতিতে আছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। পরিসংখ্যানবিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মোট আক্রান্তের পরিমাণ প্রায় দুই কোটি মানুষ। এ দেশে করোনায় মৃত্যুও সর্বাধিক, সাড়ে তিন লাখ ছুঁই ছুঁই। এরপরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ভারত। সেখানে মোট আক্রান্ত কোটি ছাড়িয়েছে, মৃত্যু প্রায় দেড় লাখ। মোট আক্রান্তের সংখ্যায় কোটি না ছাড়ালেও ব্রাজিল মৃত্যুতে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। সেই তুলনায় রাশিয়া ও ফ্রান্সে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম। দুটি দেশেই করোনায় মৃত্যুর পরিমাণ লাখের বেশ নিচে, মোট আক্রান্ত ব্রাজিলের তুলনায় অর্ধেকের কম। আর বৈশ্বিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কিছুটা নিচের দিকে থাকলেও, যুক্তরাজ্যে করোনায় মৃত্যুর হার ইউরোপের মধ্যে বেশি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব দেশে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে করোনাভাইরাসকে কম গুরুত্ব দেওয়া ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। আবার আবহাওয়া, জনঘনত্ব, স্বাস্থ্যবিধি ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ মানার বিষয়ে মানুষের অসচেতনতা ইত্যাদিও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

২০২০ সালে করোনা মহামারিকে জয় করতে না পারলেও ২০২১–এ ক্ষেত্রে আশাবাদ দেখাচ্ছে। এর মূলে আছে করোনার কার্যকর টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা। এরই মধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকার জরুরি ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবের মতো কিছু দেশ। অন্য দেশগুলোও এসব টিকা ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। আরও কিছু সম্ভাবনাময় টিকা আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে। অচিরেই হয়তো সেগুলোও ব্যবহারযোগ্য ঘোষিত হতে পারে। সব মিলিয়ে নতুন বছরে মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার স্বপ্ন তাই আর আকাশ-কুসুম কল্পনা থাকছে না।


● অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক