করোনার টিকার অনুমোদন চায় মডার্নাও

মডার্নার টিকাটি মানবদেহে পরীক্ষায় ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকর বলে আজ সোমবার দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে তারা জানিয়েছিল, এই টিকার কার্যকারিতা ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

মডার্নার সম্ভাব্য টিকা
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মডার্না তাদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার অনুমোদন চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টিকাটি জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আজ সোমবারই আবেদন করার কথা প্রতিষ্ঠানটির।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার দেশটিতে তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন চেয়েছে। জার্মান ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক এই টিকা উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেছে। টিকাটির অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ১০ ডিসেম্বর বৈঠক করার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ)। ওই বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হলে আগামী ১২ ডিসেম্বর থেকে টিকাটি প্রয়োগ শুরু হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। মানবদেহে পরীক্ষায় ফাইজারের টিকাটি ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, মডার্নার টিকাটি মানবদেহে পরীক্ষায় ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে। আজ এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ কর্তৃপক্ষের কাছে করোনার টিকা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করার পরিকল্পনা করেছে মডার্না। আজই (সোমবার) এই আবেদন করা হতে পারে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইউরোপীয় ওষুধ সংস্থার (ইএমএ) কাছে টিকাটি শর্ত সাপেক্ষে বাজারজাতকরণের আবেদনও করা হবে। এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের টিকা এই মহামারির গতিপথ পাল্টে দিতে নতুন ও শক্তিশালী এক উপকরণ হবে। (করোনার সংক্রমণে) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু প্রতিরোধে টিকাটি সহায়ক হবে।’

ফাইজারের টিকার অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ১০ ডিসেম্বর বৈঠক করার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ)। ওই বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হলে আগামী ১২ ডিসেম্বর থেকে টিকাটি প্রয়োগ শুরু হতে পারে।

বিবিসি জানায়, আবেদনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো টিকাটির মানবদেহে পরীক্ষার ফলাফলের তথ্যগুলো যাচাই–বাছাই করবে। এতে টিকাটি কার্যকর ও নিরাপদ বলে প্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল তা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হবে।

এএফপি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন যদি মডার্নার টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর বলে মনে করে, তাহলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে তা প্রয়োগ শুরু হতে পারে। এই টিকা উদ্ভাবনে মডার্নাকে সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ। দেশটিতে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর টিকার পরীক্ষা চালানো হয়েছে, যাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

অক্সফোর্ডের টিকাটি রেফ্রিজারেটরের সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। ফাইজারের টিকাটি সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আর মডার্নার টিকা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।

চলতি মাসের শুরুর দিকে মডার্না দাবি করেছিল, পরীক্ষার অন্তর্বর্তী ফলাফলে দেখা গেছে, টিকাটি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শরীরে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর। করোনা সংক্রমিত ৯৫ জন রোগীর ওপর টিকাটি প্রয়োগের পর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছিল। এবার প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের ফলাফলের এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত বিশ্লেষণটি দাঁড় করানো হয়েছে ১৯৬ জন রোগীর তথ্যের ভিত্তিতে। এর মধ্যে ১৮৫ জনকে টিকাটি প্রয়োগ না করে নকল টিকা (স্বাস্থ্যের ওপর যার সরাসরি কোনো ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকে না) প্রয়োগ করা হয়। বাকি ১১ জনকে মডার্নার টিকাটি প্রয়োগ করা হয়।

এটি খুবই ভালো খবর। টিকা পরীক্ষার যত তথ্য পাব, ততই আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে যে করোনায় মৃত্যু প্রতিরোধে আমরা টিকার ব্যবহার শুরু করতে পারব।
আলেক্সান্ডার এডওয়ার্ডস, সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব রিডিং

মডার্না জানায়, যে ১৮৫ জনকে নকল টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ৩০ জনই করোনার সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। বয়স, বর্ণ, জাতিগত ও লিঙ্গ পরিচয়—যা–ই হোক না কেন, টিকাটির কার্যকারিতা সবার ক্ষেত্রে একই পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তাদের ওই ১৯৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে ৩৩ জন প্রবীণ ব্যক্তির বয়স ৬৫ বছরের বেশি। এ ছাড়া ওই ১৯৬ জনের মধ্যে ২৯ জন হিস্পানিক, ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ, চারজন এশীয় আমেরিকান এবং তিনজন মিশ্র বর্ণের অংশগ্রহণকারীও ছিলেন।

ফাইজারের টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মডার্না দাবি করেছে, তাদের টিকা ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকর। আর অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে দাবি করেছে তারা।

টিকাটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে মডার্না জানিয়েছে, এটি বেশ সহনীয়। প্রথম ডোজ প্রয়োগের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবসাদ, মাংসপেশিতে ব্যথা, গিঁটে ব্যথা, মাথাব্যথা এবং ইনজেকশন যে জায়গায় প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ব্যথা ও লালচে ভাব দেখা গেছে। টিকাটির দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের পর এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া গুরুতর কিংবা নতুন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

মডার্না বলেছে, অনুমোদন পেলে যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা প্রায় ২ কোটি টিকা সরবরাহ করার প্রত্যাশা করছে। আর ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের প্রত্যাশায়ও রয়েছে তারা।

বিবিসি জানায়, যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা অবশ্য এরই মধ্যে ফাইজারের টিকাটির মানবদেহে পরীক্ষার ফলাফলের তথ্য যাচাই–বাছাই শুরু করে দিয়েছে। তারা যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তথ্যগুলোও দেখছে। এই টিকা মানবদেহে পরীক্ষায় ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে তারা। এ ক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রায় দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ করে কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৬২ থেকে ৭০ শতাংশ। তবে প্রথম ডোজ অর্ধেক মাত্রায় এবং পরের ডোজ পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

যুক্তরাজ্য অবশ্য মডার্না, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা—তিন প্রতিষ্ঠানেরই টিকা পেতে আগাম ফরমাশ দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে মডার্নার কাছে দেশটির সরকার ৭০ লাখ ডোজ টিকার ফরমাশ দিয়েছে। ফাইজার ও বায়োএনটেকের টিকা চেয়েছে তারা চার কোটি ডোজ। এ ছাড়া অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১০ কোটি ডোজ টিকার ফরমাশও দিয়ে রেখেছে ব্রিটিশ সরকার।

অক্সফোর্ডের টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়বে ৪ মার্কিন ডলার। ফাইজারের টিকার দাম হবে ২০ ডলার। আর মডার্নার টিকার দাম পড়বে ৩৩ মার্কিন ডলার।

এই তিন টিকার মধ্যে অবশ্য অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি সাশ্রয়ী। অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, তাদের টিকাটির প্রতি ডোজের জন্য খরচ করতে হবে ৪ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৪০ টাকা)। এ ক্ষেত্রে ফাইজারের টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়বে ২০ মার্কিন ডলার (দেড় হাজার টাকার বেশি)। আর মডার্নার টিকার দাম পড়বে ৩৩ মার্কিন ডলার (প্রায় ২ হাজার ৮০০ টাকা)। এই তিন টিকার মধ্যে অক্সফোর্ডের টিকাটি সংরক্ষণও সহজ। রেফ্রিজারেটরের সাধারণ তাপমাত্রায় এটি রাখা যাবে। ফাইজারের টিকাটি সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আর মডার্নার টিকা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।

মডার্নার টিকার পরীক্ষার সর্বশেষ ফলাফলের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের জৈব চিকিৎসাপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলেক্সান্ডার এডওয়ার্ডস বিবিসিকে বলেন, ‘এটি খুবই ভালো খবর। টিকা পরীক্ষার যত তথ্য পাব, ততই আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে যে করোনায় মৃত্যু প্রতিরোধে আমরা টিকার ব্যবহার শুরু করতে পারব।’