কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বর্ণযুগ, আছে ঝুঁকিও

২০২১ সালে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে প্রথম আলো অনলাইন। এ আয়োজনের ষষ্ঠ লেখাটি এখন প্রকাশিত হলো।

কৃত্রিম বুদ্ধিমান রোবট
প্রতীকী ছবি রয়টার্স

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) মানুষের জন্য যেমন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, তেমনি হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর হুমকি। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বহুদিন আগেই এ সতর্কবার্তা দিয়ে গেছেন। সে কথাই আবার নতুন করে শোনালেন গুগলের সাবেক চেয়ারম্যান এরিক স্মিড। গুগলের মূল প্রতিষ্ঠানের নাম এখন অ্যালফাবেট। এ প্রতিষ্ঠানটি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উন্নত গবেষণা চালাচ্ছে। এরিক শুরু থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান খুব ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তাঁর চোখে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগের স্বর্ণযুগ এখন। এখনকার কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র রোগ নিরাময়ে সাহায্য করার পাশাপাশি মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। তবে মানুষের ধ্বংস ডেকে আনার হাতিয়ারও হতে পারে এরা। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র নিয়ে নীতিমালা করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

গত বছরের গুগলের ডিপ মাইন্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রকল্পের সাফল্য বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। গবেষণায় ডিপ মাইন্ড এআই প্রোগ্রামের এক প্রকল্পে দুটি রোবটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। রোবট দুটি তাদের গেম জিততে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ ফলাফল থেকে কিছুটা হলেও ধারণা করা যেতে পারে, পরবর্তীতে রোবট তৈরিতে আগেই চিন্তা করতে হবে। এমনটাও হতে পারে নিজের বানানো রোবট নিজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। গুগল টিম যত বেশি জটিলভাবে ডিপ মাইন্ডকে তৈরি করছে ততই এটার মধ্যে লোভ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখতে পেয়েছে। গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, যত বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোবটগুলোর মধ্যে সংযোজন করা হবে এটা ততই পরিবেশ থেকে শিখবে এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। ২০১৭ সালের অ্যালফাবেটের তৈরি আলফাগো নামের একটি প্রোগ্রাম মানুষকে হারিয়ে এ খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়।

গত বছর গুগলের এই প্রোগ্রাম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গো প্লেয়ারের মুখোমুখি হয়ে পাঁচটির মধ্যে চারটি গেইমই জিতে নেয়। শুধু তাই নয়, এতে যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিরও পরিচয় দেয় প্রোগ্রামটি। বিজ্ঞানীরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, যন্ত্র বা রোবট তৈরি করে তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করলে তা কি আমাদের কথামতো চলবে? সুইচ কি মানুষের হাতে থাকবে, নাকি যন্ত্র নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে? যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা মানুষকে ছাড়িয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হুমকির কারণ হবে না তো?

বিজ্ঞানীরা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যন্ত্রকে মানুষের মতো আচরণ করতে সক্ষম করে। মেশিন লার্নিং নামের পদ্ধতি ব্যবহার করে আরও উন্নত পূর্বাভাসসহ ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে উঠছে যন্ত্র। এর পাশাপাশি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক নামের ডিপ লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে যন্ত্র। এতে সিদ্ধান্ত নিতে মানুষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ছে না।

যন্ত্র মানবী সোফিয়াকে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এ ধরনের যন্ত্র তৈরির পেছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এনভিডিয়া তৈরি করছে উন্নত চিপসেট। দ্রুত বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউবিএস জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এআই খাতের রাজস্ব ২০ শতাংশ বেড়ে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে আমাজন, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট এ বাজারের সুবিধা পেতে শুরু করেছে।

এরিক স্মিডের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগ যেমন আছে তেমনি আছে সম্ভাবনাও। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যৎদ্বাণী করেছেন যে, রোবট ২০৫০ সালের মধ্যে সমস্ত মানবিক কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে রোবট। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে নানা ব্যবসায়িক কাজে এর ব্যবহার বাড়ছে। এর বাইরে বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিরক্ষা। বিভিন্ন দেশ তাদের প্রতিরক্ষাকাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। আমরা আগেই আধা স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের (চালকবিহীন বিমান) ব্যবহার দেখেছি। এখন এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করে তোলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার নাম আসবে সবার আগে। গুগলের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিরক্ষার পাশাপাশি অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর ঘটনা ঘটছে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ছাড়া হচ্ছে। স্মিডের চোখে সেটি অনেক বেশি উদ্বেগের। তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাছ থেকে শিখতে পারে। ভাবুন, যদি এটি কিছু ভুল শেখে এবং ভুল সুপারিশ করে তবে যেকোনো সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ’ স্মিড তাই চীন ও রাশিয়াকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হওয়া পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

বর্তমান বিশ্বে বড় দুশ্চিন্তার নাম ডিপফেক। এতে কম্পিউটারে কারসাজি করা ছবিতে এক ব্যক্তির সাদৃশ্য অন্যের ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আশঙ্কার কথা, ছবি বা ভিডিওকে বিকৃত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নিখুঁতভাবে তৈরি করে হুবহু আসলের মতো বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি প্রযুক্তিজগতে ডিপফেক নামে ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেছে। ফাইভ-জি প্রযুক্তির বিকাশ আইওটি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিপ ফেক তৈরির টুল অনলাইনে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। স্মিড বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ভিডিও এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যা বিশ্বাসযোগ্য করে ফলা হচ্ছে। ভুয়া ভিডিও তৈরি করার পর তা যদি মানুষের সামনে তুলে আনা হয়, এমনকি তা ভুয়া বলে প্রচার করা হয় তারপরও কমবেশি মানুষ তা বিশ্বাস করে বসে।

বিশ্বজুড়ে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত ‘ঘাতক রোবট’ নিয়ে তাই উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। কারণ রোবট বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই রোবট তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিনৈতিকতা নির্ধারণ করা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। এ আলোচনা জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক একটি চুক্তির কথাবার্তাও হচ্ছে এ নিয়ে। তবে ঘাতক রোবট নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়লেও রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ এ ধরনের রোবট নির্মাতা দেশগুলো এমন চুক্তি নিয়ে আলোচনার বিরোধিতা করছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত যন্ত্র নিয়ে আলোচনা না এগোনোয় বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে হতাশার কথা বলা হচ্ছে।

বর্তমানে ড্রোনের মতো আধা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার ইতিমধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। তবে ড্রোনের মতো যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থাকে মানুষের হাতে। সে তুলনায় পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে (ঘাতক রোবট) মানুষের হাতে কোনো ‘কিল সুইচ’ বা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকে না। এর পরিবর্তে যন্ত্রটি নিজেই তার সেন্সর, সফটওয়্যার ও কারিগরি প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, গত মার্চে জাতিসংঘের একটি প্যানেলের প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে এই শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি হওয়ার বিষয় সামনে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম স্বয়ংক্রিয় ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছিল লিবিয়ায়।

এ সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কনভেনশন অন সার্টেইন কনভেনশনাল উইপনস (সিসিডব্লিউ) সম্মেলনে ১২৫টি পক্ষকে নতুন নীতিমালা তৈরিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে সম্মেলনে লেথাল অটোনোমাস উইপন সিস্টেমস (এলএডব্লিউএস) তৈরি ও এর ব্যবহার ঠেকানো নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। জেনেভায় পাঁচ দিনের সম্মেলনে উপস্থিত এলএডব্লিউএসের নির্মাতা দেশগুলো অনেক শর্ত দিয়ে তাদের অসম্মতি জানিয়েছে। বিশেষ করে যন্ত্রচালিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে তারা এ অসম্মতি জানায়।

রাশিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এলএডব্লিউএস চুক্তির বিষয়ে আপত্তি এসেছে সবচেয়ে বেশি। তবে ৬৮টি রাষ্ট্র জাতিসংঘে এ বিষয়ে আইন করার আহ্বান জানিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এ তথ্য জানায়।

সম্মেলনের ফলাফলে হতাশা প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডের নিরস্ত্রীকরণবিষয়ক রাষ্ট্রদূত ফেলিক্স বাউম্যান বলেছেন, ‘বর্তমানে আলোচনায় যে অগ্রগতি, তাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি আমাদের আলোচনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ ও নিউজিল্যান্ডের নিরস্ত্রীকরণবিষয়ক মন্ত্রী ফিল টোয়েফোর্ড উভয়েই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকারী নতুন আন্তর্জাতিক আইন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস আলোচনার ফলাফলে হতাশা প্রকাশ করেছে।

তবে এরিক স্মিড আশাবাদী মানুষ। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বিদ্যুত ও টেলিফোনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য, এর ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আছে। এটি একদিকে যেমন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কার করে লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচাতে পারে তেমনি এটি মন্দ লোকের খপ্পরে গেলে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তবে অনেকে বলেন, রোবট বিশ্ব দখল করতে চলেছে। কিন্তু তা মানুষকে সহসা ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি সত্যিই ভয়ংকর হয়ে ওঠে তবে তার আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে মানুষের হাতেই।