চীন-রাশিয়ার টিকায় আস্থা রাখার এখনই সময়

চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকাগুলোও কার্যকর। বিশ্বজুড়ে টিকাস্বল্পতার বর্তমান সংকটে এই টিকাগুলো কাজে আসতে পারে।

বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কপালে যখন করোনাভাইরাসের টিকার স্বল্পতা নিয়ে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে, তখন কিছু দরিদ্র দেশ টিকা পাবে কি না, তা নিয়েই চিন্তিত। তবে এই সমস্যার একটি সাধারণ সমাধান সবার সামনেই রয়েছে। আর তা হলো, চীন, রাশিয়া এবং সম্ভবত ভারতের তৈরি করোনার টিকা।

পশ্চিমা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রথম দিকে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকাকে পাত্তা দিতে চায়নি। এর একটি কারণ হলো, তাদের ধারণা ছিল মডার্না, ফাইজার-বায়োএনটেক অথবা অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার তুলনায় ওই টিকাগুলো নিম্নমানের। চীন ও রাশিয়া কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ায় এমন ধারণা জন্মে থাকতে পারে।

কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এই দুই রাষ্ট্রের উদ্ভাবিত করোনার টিকাও বেশ কার্যকর। রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক-ভি-এর মানবদেহে পরীক্ষার অন্তর্বর্তী ফলাফল প্রকাশ করেছে শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট। এতে দেখা গেছে, টিকাটি ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর। টিকাটির উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই তাদের টিকার কার্যকারিতা নিয়ে এ রকম দাবি করেছিল।

যেসব দেশে অনুমোদন পেয়েছে চীন-রাশিয়ার টিকা

চীনের সিনোফার্মের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, ইরাক, সার্বিয়া, মরক্কো, হাঙ্গেরি ও পাকিস্তান। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৮ লাখ মানুষকে এই টিকা দেওয়া হয়েছে। বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল ও চিলি অনুমোদন দিয়েছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাকের টিকা। দেশগুলো এই টিকার ব্যবহারও শুরু করেছে। আর ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক-ভির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

টিকাগুলো অনুমোদন দেওয়ার সময় ওই দেশগুলো তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানের তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই করেছে এগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা। এসব তথ্যের বেশির ভাগই দ্য ল্যানসেটদ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর (জেএএমএ) মতো বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে, অথবা স্বাধীনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেছে। অনুমোদন দেওয়া ওই দেশগুলোর কয়েকটির স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের দেশগুলোর সমমানের।

টিকার বড় ধরনের স্বল্পতা ও সরবরাহে বিলম্বের কারণে সৃষ্ট সংকটে ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানি এখন বিকল্প হিসেবে চীন ও রাশিয়ার টিকাগুলো নেওয়ার জন্য কথাবার্তা বলছে। কার্যত কোনো উপায় না পেয়েই তারা পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরের টিকা নেওয়ার গরিমা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

তাই বলে সংশয় কিন্তু কাটেনি। ইরানে রাশিয়ার টিকা নিয়ে এবং পাকিস্তানে চীনের টিকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কেনিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকায় চীন, রাশিয়া—উভয়ের টিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ইউগভ (যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান) সম্প্রতি ১৭টি দেশে একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে অংশ নেন ১৯ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। তাঁদের আস্থার তালিকায় রাশিয়া, চীন ও ভারতে উদ্ভাবিত করোনার টিকা তলানিতে রয়েছে।

এই বিষয়েরও এক রকম ব্যাখ্যা আছে। চীন ও রাশিয়ার নিজেদের টিকা নিয়ে স্বপ্রণোদিত প্রচারণামূলক কার্যক্রমই এগুলোর ব্যাপারে মানুষকে আরও বেশি সতর্ক করেছে। আস্থার এই সংকট বেশি তৈরি হয়েছে বিদেশে।

চীন ও রাশিয়া গত বছর থেকেই নিজেদের নাগরিকদের টিকা দেওয়া শুরু করে। তখনো তাদের টিকাগুলোর ব্যাপারে মানবদেহে শেষ ধাপ তথা তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়নি (ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পেয়েছে মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার অন্তর্বর্তী ফলাফল প্রকাশের পর)। ভারতও তাদের উদ্ভাবিত কোভ্যাক্সিন নিয়ে একই কাজ করেছে। এই টিকা উদ্ভাবন করেছে দেশটির প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক। এভাবে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই টিকা প্রয়োগ শুরু করায় ভারতজুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

রাশিয়া, চীন ও ভারতের সরকার অবশ্য নিজেদের গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাখ্যায় বলেছে, তারা টিকাগুলোর অনুমোদন দিয়েছে জরুরি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এবং টিকার উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে। এই ব্যাখ্যা যথাযথ মনে না হলেও তা বেআইনি নয়। পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও টিকা উদ্ভাবন ও অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কাটছাঁট করেছে একই কারণে (যদিও আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে)।

টিকার কার্যকারিতা

চীন ও রাশিয়ার টিকার নির্ভরযোগ্যতার পক্ষে এখন আরও অনেক তথ্য রয়েছে। (কোভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে এমনটা দাবি করার সময় অবশ্য আসেনি)। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের সিনোফার্মের টিকা ৮৬ শতাংশ কার্যকর। আর চীনের অন্য টিকাগুলো ৭৯ শতাংশ কার্যকর।

এখন প্রশ্ন হলো, কার্যকারিতার এই শতকরা হিসাব আসলে কী? এক টিকার কার্যকারিতা অন্য টিকার তুলনায় কম বা বেশি হওয়ায় কিংবা একই টিকার ক্ষেত্রে এক জায়গার তুলনায় অন্য জায়গায় কার্যকারিতার হারে ভিন্নতার কারণে এ নিয়ে আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

চীনের সিনোভ্যাকের কথাই ধরা যাক। এই টিকা নিয়ে একেক জায়গায় একেক ফল পাওয়া গেছে। যেমন তুরস্কে এই টিকার কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৯১ শতাংশ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় ও ব্রাজিলে যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। ব্রাজিলের পরীক্ষার ফলাফল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। দেশটিতে এই পরীক্ষা পরিচালনা করেছে সাও পাওলোর বুটানটান ইনস্টিটিউট। তারা আরও বলেছে, সিনোভ্যাকের এই টিকা করোনার সংক্রমণে মৃদু থেকে গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে ৭৮ শতাংশ কার্যকর। এই কথা খবরে আসেনি।

বুটানটান ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল রিসার্চ মেডিকেল ডিরেক্টর রিকার্ডো পালাসিওস বলেন, সিনোভ্যাকের টিকার পরীক্ষা চালানো হয়েছে সেসব স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর, যাঁরা সরাসরি করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন। (ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকার পরীক্ষায়ও কিছু স্বাস্থ্যকর্মী অংশ নিয়েছেন। তবে এই টিকাগুলোর পরীক্ষায় তাঁরা কেবল একটি অংশ ছিলেন। বাকি স্বেচ্ছাসেবীদের বাছাই করা হয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে)। তা ছাড়া সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা অনেকসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর ওপর পরীক্ষা চালালে টিকার কার্যকারিতা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যান্য পরীক্ষার তুলনায় বুটানটান ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় করোনার উপসর্গে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল।

টিকার পরীক্ষার প্রক্রিয়া ও ক্রম ভিন্ন ভিন্ন হয়। এমনকি একটি টিকার ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো ভিন্ন হতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে সহজেই বোঝা যায়, কেন টিকার পরীক্ষার ফলাফলগুলোয় ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি একটি টিকার ভিন্ন জায়গায় পরীক্ষার ফলাফলেও ভিন্নতা কেন পাওয়া গেছে, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

তবে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকাগুলোর বিষয়ে আরও তথ্য যে প্রকাশ করা উচিত, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোয় উদ্ভাবিত করোনার টিকার বিষয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। যেমন ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার বিস্তারিত তথ্য এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি তা গবেষকদেরও সরবরাহ করা হয়নি।

বাস্তবতা হলো, করোনাভাইরাসের কোনো টিকাই পুরোপুরি স্বচ্ছতার সঙ্গে উদ্ভাবন ও সরবরাহ করা হয়নি, যা হওয়া উচিত ছিল। আর চীন ও রাশিয়া পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর মতো টিকা সরবরাহ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি বলে এই নয় যে এগুলো যেনতেন করে তৈরি করা হয়েছে। বরং চীন ও রাশিয়ার টিকার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে যে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। বিশ্বজুড়ে টিকার স্বল্পতাজনিত সংকটের এই সময় আরও দ্রুত এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

পশ্চিমা দেশগুলোয় উদ্ভাবিত করোনার টিকাগুলোর সিংহভাগই ধনী দেশগুলো কিনে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে সমহারে টিকার বণ্টন নিশ্চিতে কাজ করা জোট পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই মডার্নার সব টিকা বিক্রি হয়ে গেছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের ৯৬ শতাংশ টিকাও বিক্রি হয়ে গেছে।

টিকার সরবরাহ ও বণ্টনবিষয়ক বৈশ্বিক জোট গ্যাভির কাছে অবশ্য পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর কিছু টিকা মজুত রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তাদের ১১ কোটি থেকে ১২ কোটি ২০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহ করার কথা ছিল। আর ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা সরবরাহের কথা ছিল ১২ লাখ ডোজ। এই সরবরাহ যাওয়ার কথা ছিল ১৪৫টি দেশে।

আরেকটি বিষয় হলো, পশ্চিমা দেশগুলোয় বেশির ভাগ বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টিকা উৎপাদনকারী অপশ্চিমা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছে। এমনকি কয়েকটি ধনী দেশ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রস্তাবও আটকে দিয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাব ছিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট টিকা ও চিকিৎসাসংক্রান্ত মেধাস্বত্বের কিছু শর্ত সাময়িক স্থগিত করুক।

অপরদিকে তথ্য বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এয়ারফিনিটির সাম্প্রতিকতম তথ্যমতে, সিনোভ্যাক এরই মধ্যে চলতি বছর ১২টি দেশে ৩৫ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি করেছে। সিনোফার্ম ১১টি দেশে ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি করেছে। আর স্পুতনিক-ভি-এর ৪০ কোটি ডোজ পেতে ১৭টি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। টিকা তিনটির উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, তাদের প্রত্যেকের ২০২১ সালের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হবে। তিন টিকার উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানই কিছু দেশের স্থানীয় উৎপাদকদের টিকা তৈরির সুযোগ দিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে ভূমিকা প্রয়োজন

এখন প্রশ্ন হলো, আরও বেশিসংখ্যক মানুষ বা দেশকে এই টিকাগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী করতে কী করা যায়? একটা উপায় হতে পারে, সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার এগুলোর ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন করা। সমস্যা হলো, টিকা অনুমোদনের বিষয়ে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মনীতি ধনী দেশ বিশেষ করে পশ্চিমাবান্ধব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তার আস্থাভাজন কিছু ‘কঠোর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের’ ওপর নির্ভর করে। এসব নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সিংহভাগই ইউরোপীয় দেশগুলোর। বাকিগুলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের। বাকি বিশ্বের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সেবা পরিচালনা করে, যার নাম ‘প্রাকযোগ্যতা’। তাত্ত্বিকভাবে এটি একটি উপায়, যার মাধ্যমে চীন বা রাশিয়ার টিকাগুলোকে পশ্চিমা টিকাগুলোর সমপর্যায়ে আনা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রক্রিয়াটি কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আস্থাভাজন কোনো দেশ যখন একটি টিকা উদ্ভাবন ও অনুমোদন দেয়, সংস্থাটি স্বাভাবিকভাবেই ওই দেশের মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে দ্রুত অনুমোদন দেয়। কিন্তু অন্য কোনো দেশের কোনো টিকা উদ্ভাবক যখন প্রাকযোগ্যতার জন্য আবেদন করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তখন মূল্যায়নের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শনও।

ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয় ২০২০ সালের শেষ দিকে। এই টিকার উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের আবেদনের দুই মাসের কম সময়েই চলে আসে এই অনুমোদন। এই টিকার পর মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকারও অনুমোদন দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার টিকাগুলো এখনো অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও এই টিকাগুলোর পর্যালোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ আগেই।

ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার কার্যকারিতা পর্যালোচনার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপীয় ওষুধ সংস্থার (ইএমএ) সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। ইএমএ এই টিকা অনুমোদন দেওয়ার ১০ দিনের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তা অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নিজের মানদণ্ড অনুসরণ করে অন্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজ না করার কোনো কারণ নেই। কাজেই এই সংস্থার উচিত, টিকা উৎপাদক সব দেশের প্রতিই মনোযোগী হওয়া, যা তাদের প্রাপ্য।

কিছু চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মী বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা দেশগুলোয় উৎপাদিত টিকার সরবরাহ বাড়ানোর প্রস্তাব করছেন। সৎ উদ্দেশ্যেই এই আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু এমন আহ্বানে একটাই বার্তা যায়, পশ্চিমা দেশগুলোর টিকাই কেবল নির্ভরযোগ্য এবং এর অপেক্ষাতেই আছে সবাই।

এ ক্ষেত্রে একটি সহজ সমাধান রয়েছে। তা হলো, অন্য দেশগুলোর টিকায় আস্থা রাখা। আর আস্থা রাখার সেই সময় এখনই।

** আচল প্রভালা, বিশ্বজুড়ে টিকা ও ওষুধ সরবরাহের পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যাকসেসআইবিএসএ প্রজেক্টের সমন্বয়ক এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শাটলওর্থ ফাউন্ডেশনের ফেলো। ভারতের এই জনস্বাস্থ্য অধিকারকর্মী করোনার টিকার ব্যাপক বণ্টনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

** চি ইয়োক লিং, মালয়েশিয়ার জনস্বার্থ আইনজীবী এবং মালয়েশিয়ার পেনাংভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থার্ডওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। তিনি চীনে সবার জন্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিতে এক দশক কাজ করেছেন।

** নিউইয়র্ক টাইমসে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি থেকে অনুবাদ রাজিউল হাসান