ডেলটা ধরনের করোনা কীভাবে রোধ করা যায়

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

ইতিমধ্যে বেশ কয়েক ধরনের করোনার অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে ডেলটা ধরন বেশি মারাত্মক। মূলত এই ডেলটা ধরনের করোনা ছড়িয়ে পড়ায় দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে। কোথাও কোথাও ডেলটা প্লাস দেখা দিয়েছে। এটা ডেলটার চেয়েও বেশি দ্রুত ছড়ায় ও সংক্রমণ দ্রুত তীব্র হয়ে ওঠে। এই বিশেষ ধরনের করোনার স্পাইক প্রোটিন বেশি শক্তিশালী বলে সহজেই শ্বাসতন্ত্রের কোষে ঢুকে পড়ে এবং কোষের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে দ্রুতগতিতে করোনার প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগের তীব্রতা বাড়ে।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সিডিসির (সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এখন ডেলটা ধরনের করোনাই প্রধান। জাপানেও সমস্যা।

সেখানে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন হবে ২৩ জুলাই। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে করোনার সংক্রমণ নতুনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ অলিম্পিক গেমস দর্শকবিহীনভাবে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অলিম্পিক গেমস চলার সময় টোকিওতে জরুরি অবস্থা জারি থাকবে। সেখানে ডেলটা ধরনের করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। জাপানের মানুষ অলিম্পিক গেমস বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও করোনার এই নতুন ধরন বিস্তার লাভ করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই নতুন ধরনের করোনা রোধে কি প্রচলিত টিকা কাজ করবে? এ বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ফাইজার–বায়োএনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ অন্য সব টিকাই করোনার ডেলটা ধরনের বিরুদ্ধে সুফল দেয়।

জনসন অ্যান্ড জনসন জানিয়েছে যে তাদের এক ডোজের টিকাও খুব ভালো সুরক্ষা দেয়। বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন টিকা নেওয়ার সুফল হলো, প্রথমত সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা খুব কমে যায়, আর সংক্রমিত হলেও রোগের তীব্রতা খুবই কম থাকে। ফলে মৃত্যুর আশঙ্কা খুব কম।

সুতরাং এখন প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের প্রাপ্তবয়স্ক সব মানুষের টিকার ব্যবস্থা দ্রুততর করা। ৭০–৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি যে করোনার সংক্রমণ রোধ করা যাবে। কিন্তু টিকাপ্রাপ্তির সমস্যা রয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ খুব দ্রুতই টিকা দেওয়ার কাজটি শেষ করে ফেলবে। চীন, রাশিয়াও হয়তো আর মাস দুয়েকের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ মানুষের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বারবার নতুন করে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যাবে। তাই এখন থেকেই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন সমান গতিতে টিকা দেওয়ার সুযোগ পায় সে বিষয়ে বিশ্বের সব দেশের মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।

তবে মনে রাখতে হবে, দেশে টিকা দেওয়ার কাজটি চলবে, পাশাপাশি বাইরে চলাফেরায় মাস্ক ব্যবহার, দূরত্ব বজায় রাখা ও বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখার গুরুত্ব খাটো করে দেখা যাবে না। লকডাউনের বিধিবিধান মেনে চললে ও জরুরি কাজে বাইরে চলাফেরায় সব সময় মাস্ক পরলেও করোনার সংক্রমণ অনেক কমিয়ে আনা যায়।

নতুন নতুন আবিষ্কার
ফিটবিট, অ্যাপল ওয়াচ প্রভৃতি এত দিন আমাদের শরীরের তাপমাত্রা, ঘুমের মাত্রা, হৃৎকম্পনের হার, রক্তচাপ প্রভৃতি তথ্য দিত। এখন করোনার লক্ষণ বা করোনা–উত্তর শারীরিক অবস্থার তথ্যও পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন ফিটবিট পরে চলাফেরা করেন। এর সাহায্যে করোনার সংক্রমণ বিষয়ের তথ্য চট করে পাওয়া যায় ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে হয়তো এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার ব্যয়সাধ্য। কিন্তু এ ধরনের বেশ কিছু নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

‘মেডিকেল নিউজ টু ডে’–এর ২ জুলাই অনলাইন সংস্করণে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় ডোজের ছয় মাসের বেশি সময় পর করোনার টিকার তৃতীয় ডোজ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বাড়ায় এবং বেশি দিন সক্রিয় থাকে। শুধু তা–ই নয়, তৃতীয় ডোজ করোনার আলফা, বেটা ও ডেলটা ধরনের ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। অবশ্য গবেষকদের অনেকে তৃতীয় বুস্টার ডোজের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। এ বিষয়ে গবেষণা এখনো চলছে।

টিকা গ্রহণের সুযোগ বাড়ানো
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে টিকাপ্রাপ্তির বৈষম্যের ফলে সারা বিশ্ব যে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে, তা প্রায় প্রতিদিন করোনার সংক্রমণের হার বৃদ্ধির হিসাব দেখলেই বোঝা যায়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ৪০ লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা গত ৮ জুলাই এক নিবন্ধে দেখিয়েছে, সংক্রমণের হার কী সাংঘাতিক গতিতে বাড়ছে। প্রথম ১০ লাখ মৃত্যু ছাড়িয়ে যেতে ৯ মাস লেগেছিল। এরপর থেকেই মৃত্যুর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় ১০ লাখ মৃত্যু ছাড়িয়ে যেতে লেগেছে সাড়ে তিন মাস, তৃতীয় ১০ লাখ তিন মাসে এবং পরবর্তী আড়াই মাসে চতুর্থ ১০ লাখ মৃত্যু।

এই হিসাব থেকে এটা বলা যায়, উন্নত দেশগুলো শুধু যার যার দেশে সবাইকে টিকা দিলেই সংকটমুক্ত হতে পারবে না। সুতরাং তাদের দেশের উদ্বৃত্ত টিকা কম উন্নত দেশগুলোতে পাঠানোর গুরুত্ব এখন সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের সব দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে যত দ্রুত টিকা দেওয়া যাবে, তব দ্রুত বিশ্ব করোনার অভিশাপমুক্ত হবে।

* আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]