বিশ্বে প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একটি খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে: জাতিসংঘ

খাদ্য সহায়তা গ্রহণ করছে নাইজেরিয়ার বাস্তুহারা লোকজন।
ছবি : রয়টার্স

করোনা মহামারিতে অপুষ্টি চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এর ফলে বিশ্বে প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে এক শিশু খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত সোমবার জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায়, সারা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ করোনা মহামারিতে খাদ্যসংকটে ভুগছে।

জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যকর খাদ্যসুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা গত বছর প্রায় ৩২ কোটি বেড়েছে। এ সময়ে মোট খাদ্যসুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩৭ কোটিতে, যা বিগত পাঁচ বছরে মোট বৃদ্ধির চেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এর আগের বছর প্রায় ১৬ কোটি বেড়ে ৮১ কোটিতে দাঁড়িয়েছিল।

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সংস্থাগুলো বলছে, পুষ্টির ওপর মহামারির প্রভাব প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারিতে শিশুদের প্রতিবন্ধী হওয়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। পাঁচ বছরের নিচে প্রায় ২২ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে বা খর্বাকৃতি হয়ে যাচ্ছে।

ইফাদের প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট হাংবো বলেন, সবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বর্তমান সংকটের কারণে খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে দুর্ভাগ্যজনক হলেও মহামারি আমাদের খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতির দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছে। ফলে সারা বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক বৈষম্য, সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে দরিদ্র দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হাংবো বলেন, পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হলেও মহামারিসহ নানা সংকট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। আমদানিনির্ভর দেশগুলো এর ফলে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতির নিয়মগুলো আমাদের সংস্কার করা প্রয়োজন। যেমন কীভাবে শস্য উৎপাদন করা উচিত, মোড়ক কীভাবে তৈরি করতে হয়, পরিবহন ও খাদ্যের বাজার নিশ্চিত করা, যাতে এসব খাদ্য স্বাস্থ্যকর হয় এবং উৎপাদনসংশ্লিষ্টরা পর্যাপ্ত দাম পান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন কারণে খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্য। আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানে এই উপাদানগুলো বেশি দেখা গেছে। ১০ বছর আগে স্বাধীন হওয়া দেশটি বর্তমানে সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হয়েছে বলে সতর্ক করেছে সাহায্যকারী সংস্থাগুলো। গত কয়েক বছরে এসব দেশে অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও বন্যার কারণে মানবাধিকার সংস্থাগুলো খাদ্য সরবরাহ করতে গিয়ে লড়াই করছে।

সোমালিয়ার অ্যাকশন এগেইনস্ট হাঙ্গারসের পরিচালক সুলাইমান কেন সিসে বলেন, ‘এটা একটা প্রজন্মের মানুষের স্থানচ্যুত হওয়ার গল্প, জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম ধ্বংস হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, পঙ্গপাল, প্লেগ এবং কোভিড-১৯-এর কারণে ইতিমধ্যে সামাজিক কাঠামো ভঙ্গুর হয়ে গেছে।

হাংবো বলেন, চলমান মহামারি গ্রামীণ অঞ্চলগুলাতে বিনিয়োগের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব অঞ্চল দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলা করেছে। এ ছাড়া ক্ষুধার কারণে নানা ধরনের সংঘাতও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, মাঝারি মানের কৃষকেরা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খাদ্য সরবরাহ করে থাকেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে তাঁদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মহামারির কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সব পূর্বপরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেছে।

হাংবো জানান, স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন করতে আফ্রিকার অনেক দেশে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে কৃষি একটি সফল খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে নাগরিকদের খাদ্যসুবিধা নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান তৈরি করা, অর্থনৈতিক সহায়তা ও জীবিকা নির্বাহের সুবিধা করে দেয়। এটি একটি স্থিতিস্থাপক ক্ষেত্র, যেটি বর্তমান ও ভবিষ্যতে জলবায়ু ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করবে।