লিবিয়ায় বহু প্রতীক্ষার নির্বাচন, শান্তি ফিরবে কি

সশস্ত্র লড়াইয়ে এক পক্ষের যোদ্ধারা।
ছবি: রয়টার্স

সালটা ২০১১। তৎকালীন স্বৈরাচার মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তেতে উঠেছে লিবিয়া। দাবি একটাই, গাদ্দাফি সাম্রাজ্যের পতন। তখন লিবীয়দের চোখেমুখে ছিল পরিবর্তনের রঙিন স্বপ্নও। উন্নত ভবিষ্যতের আশায় স্বৈরাচারী সরকারের গদি ওলটাতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নেমে পড়েন রাজপথে, হাতে তুলে নেন অস্ত্র। সেই ‘গণবিপ্লবে’ কর্তৃত্ববাদের নিপাত গেলেও লিবীয়দের উন্নত জীবনের সেই রঙিন স্বপ্ন আজ পরাভূত। সেই স্বপ্ন শুধু ধূসরেই রূপ নেয়নি, আগের শত অর্জনকেও জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে লিবীয়দের। বিপ্লব পরিবর্তন এনেছে ঠিকই; কিন্তু তার সুফল ভোগ করতে পারেনি সাধারণ লিবীয়রা।

ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নির্বাচন কার্যালয়ে আসেন সাইফ আল–ইসলাম গাদ্দাফি। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নাম নিবন্ধন করেন।
ছবি: রয়টার্স

একনায়ক শাসক গাদ্দাফির পতনের পর উত্তর আফ্রিকার দেশটি শুধু পিছিয়েছে আর পিছিয়েছে। এখন লিবীয়রা এগিয়ে যাওয়ার সাধারণ চিন্তাও করতে ভয় পায়। গাদ্দাফি শাসনের অবসানের পর লিবিয়ার মসনদে বসতে লড়াইয়ে একে অন্যদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু করে দেশটির বিবাদমান গোষ্ঠীগুলো। এই সংঘাত লিবিয়াকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের একেবারে কিনারে। ধ্বংস হয়ে গেছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব কাঠামো। সেই জায়গা থেকে লিবিয়ার জনগণকে রক্ষার আশার প্রদীপ হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২৪ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সেই নির্বাচনের মাধ্যমে লিবিয়ায় শান্তি ফিরবে কি, সেটাই এখন দেখা দিয়েছে বড় প্রশ্ন হিসেবে।

কারাগারে থাকার সময় মামলার শুনানিতে হাজির হন সাইফ আল–ইসলাম। এজলাসকক্ষে সাইফ।
ছবি: রয়টার্স

ওই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন লিবিয়ার প্রয়াত শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির ‘প্রিয়’ ছেলে সাইফ আল-ইসলাম আল-গাদ্দাফি (৪৯)। গত রোববার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সেবহার নির্বাচনী কার্যালয়ে হাজির হয়ে তিনি মনোনয়নপত্রে সই করেন। সেই ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ, গাদ্দাফির পরিবারের কেউ আবার রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন, এমন কেউ কল্পনায়ও আনতে পারতেন না। বিদ্রোহীদের হাতে আটকের পর গাদ্দাফিসহ তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য খুন হন। ২০১১ সালে বিদ্রোহীদের হাতে আটকের পরও একমাত্র সাইফ আল-ইসলামই বেঁচে যান। তখন থেকে ছিলেন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়। গত এক দশক তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু গত জুলাইয়ে নিউইয়র্ক টাইমসকে হঠাৎ সাক্ষাৎকার দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে খবর আসে, বাবার ‘হাতে গড়া’ লিবিয়ার হাল ধরতে প্রস্তুত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাইফ। সাইফের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে সেটাই সত্য হলো।

সাইফ আল-ইসলাম লিবিয়ার পরিচিত এক মুখ। কিন্তু ভোটের মাঠে তিনি কেমন ফল করবেন, সেটা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, সাইফ আল-ইসলাম ভোটের ময়দানে তাঁর বাবার শাসনামলের ভালো দিকগুলো তুলে ধরতে পারেন। একটি সমৃদ্ধিশালী সুখী লিবিয়া গঠনের স্বপ্ন তিনি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যেমনটা তাঁর বাবা দেশটির রাজপরিবারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পক্ষে তুলে ধরেছিলেন। তবে অনেকে মনে করছেন, সাইফ যা-ই করুন না কেন, ভোটের ময়দানে সামনের সারিতে আসতে পারবেন না। কারণ, গাদ্দাফির নিষ্ঠুর শাসনের কথা এখনো অনেক লিবীয়র মনে আছে। সাইফকে ভোটের মাঠে দেখে সেই ক্ষত নতুন করে জেগে উঠতে পারে। তাই ভোটে নিজেদের পক্ষে অনেক বেশি সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীকে একত্র করা সাইফ আল-ইসলাম ও গাদ্দাফি শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পক্ষে সহজ হবে না।

কমান্ডার খলিফা হাফতারের ছবিতে ক্রস চিহ্ন দিয়েছে রেখেছেন প্রতিপক্ষের যোদ্ধারা।
ছবি: এএফপি

সাইফ একসময় পশ্চিমাপন্থী ছিলেন। তাঁকে লিবিয়ার সম্ভাব্য সংস্কারপন্থী হিসেবে ভাবা হতো। ২০১১ সালে তাঁর বাবার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরুর পর তিনি পরিবর্তনের পক্ষে থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কারণ, এর আগে তিনি বাবা গাদ্দাফির নেওয়া অনেক বিষয়ে একমত প্রকাশ করেননি। সেই জন্যই পশ্চিমাদের কাছে ধারণা ছিল, আর কেউ না হোক, গাদ্দাফি পরিবারের একমাত্র সদস্য হিসেবে সাইফ পরিবর্তনের পক্ষ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বাবা গাদ্দাফির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিক্ষোভকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।

লন্ডনে লেখাপড়া করা সাইফ ক্ষমতার দৃশ্যপটে ফিরতে ব্যাকুল বলেই মনে হচ্ছে। গত ২২ অক্টোবর সিরিয়াভিত্তিক গাদ্দাফিপন্থী একটি টিভি চ্যানেলে সাইফকে দেখা যায়।

সেখানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তেমনটাই উঠে এসেছে। ওই টিভিকে তিনি বলেন, ‘আমি লিবিয়ায়। আমি জীবিত ও মুক্ত আছি। শেষ পর্যন্ত আমি লড়তে চাই এবং প্রতিশোধ নিতে চাই।’ রোববার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম নিবন্ধনের পর দেওয়া সাইফের বক্তব্যে ছিল বিরোধীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইফ যে ভাষায় কথা বলছেন, সেটা ঐক্যের ভাষা নয়। বরং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তিনি হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাঁর পক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ লিবিয়া গঠনের কাজ দুরূহ হবে।

মুয়াম্মার গাদ্দাফি।
ছবি: রয়টার্স

গাদ্দাফি ছাড়া লিবীয়দের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হন বিরোধীরা। গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে বিরোধীরা যেভাবে একসঙ্গে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন, পরে তাঁরা আর সেটা ধরে রাখতে পারেননি। এখন লিবিয়ার গাদ্দাফিবিরোধীরা প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি পক্ষের নেতৃত্বে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার খলিফা হাফতার। দেশটির পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা তাঁর নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) নিয়ন্ত্রণে। তাঁর পক্ষে রয়েছে রাশিয়া, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ। অন্যদিকে দেশটির জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিসহ পশ্চিমাঞ্চল। তুরস্কসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। বিদেশি শক্তি ছাড়াও এই দুটি পক্ষকে সমর্থন করছে লিবিয়ার বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী। ২০১৯ সালে ত্রিপোলি দখলে নিতে হাফতারের বাহিনী জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে।

তখন থেকেই গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াই করা বিরোধীরা বড় দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যদিও হাফতার বাহিনীর ১৪ মাস লড়াইয়ের পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারকে সহায়তা করতে গত বছরের জুনে তুরস্ক সেনা পাঠালে হাফতার বাহিনী রাজধানী দখল থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কাতার ও ইতালিও ওই সরকারকে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন দেয়।

সাইফকে টেক্কা দিতে মাঠে রয়েছেন কমান্ডার খলিফা হাফতার। মঙ্গলবার তিনি প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের জন্য নিবন্ধনও করেছেন। তাঁকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গাদ্দাফি সাম্রাজ্যের পতনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

ওই সময় খলিফা হাফতারের যে সুনাম ছিল, সেটা এখন আর নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক এজেন্ট হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলি দখলে নিতে প্রতিপক্ষের ওপর নৃশংসতা চালায়। পশ্চিমাদের কাছে তিনি এখন ‘কসাই’ হিসেবে পরিচিত। অনেকের রক্ত তাঁর হাতে লেগে রয়েছে। অনেকে মনে করেন, হাফতার লিবিয়ায় গাদ্দাফির মতো আরেকটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাই তিনি ক্ষমতায় এলে দেশটিকে একই সুতোয় গাঁথতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা খুবই কম। পশ্চিমা দেশগুলো তাঁর সঙ্গে কাজ করবে, এমন কথা আগেভাগে বলা যাচ্ছে না।

সাইফ বা হাফতারই নন, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন লিবিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদুলহামিদ আল দিবাহ, পার্লামেন্টের স্পিকার আজুলা সালেহও। জাতিসংঘ, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে নির্বাচনে তাঁরা জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবেন, সেটার নিশ্চয়তা নেই।

লিবিয়ার বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য নির্বাচনকে সেরা উপায় মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সব পক্ষকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এক সম্মেলনে গত শুক্রবার বিশ্বনেতারা একমত হন, যারা লিবিয়ার ভোটকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের সন্দেহ, লিবিয়ার বর্তমান সরকারব্যবস্থায় দেশটিকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। তাই ভোটের আগে নতুন সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে, তার কার্যপ্রণালিবিধি প্রণয়নের দাবি উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। ভোটের ছয় সপ্তাহের কম সময় বাকি। এরপরও সেই কার্যপ্রণালিবিধি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই নির্দিষ্ট সময়ে সেই নির্বাচন হবে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আবার সব পক্ষ ওই নির্বাচনে না এলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়বে।

অবশ্য আশার খবর হচ্ছে, নির্বাচনের আগে লিবিয়ার সব পক্ষের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দারুণ তৎপর। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘ জেনেভায় লিবিয়ার বিবদমান গোষ্ঠী সদস্যদের এক টেবিলে বসাতে সক্ষম হয়। নিজেদের পক্ষে লড়াই করা বিদেশি যোদ্ধা ও দুষ্কৃতকারীদের প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয় গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা। বর্তমানে ২০ হাজারের মতো বিদেশি যোদ্ধা রয়েছেন লিবিয়ায়। তাই সব পক্ষের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে সেই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পারে গোষ্ঠীগুলো। এতে শান্তি ফেরানো কঠিন হবে।
সূত্র: আল-জাজিরা ও বিবিসি