সমীকরণে নতুন মাত্রা গিন্সবার্গের মৃত্যু

রুথ গিন্সবার্গ

মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের উদারনৈতিক বিচারপতি রুথ বেইডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর ফলে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন উভয়েই একে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারে উঠেপড়ে লেগেছেন।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত শুক্রবার ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে গিন্সবার্গের। জনমতে পিছিয়ে থাকা ট্রাম্প নিজের নির্বাচনী ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এত দিন যে ‘রুপালি আলোকরেখা’র সন্ধান করছিলেন, গিন্সবার্গের মৃত্যু তেমন একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। অন্তত তিনি ও তাঁর নির্বাচনী শিবির তেমনটাই ভাবছে। রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে ট্রাম্পের প্রধান আকর্ষণ, তিনি দেশের বিচারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছেন, তাকে একটি দীর্ঘস্থায়ী রক্ষণশীল চেহারা দিয়েছেন। তাঁর সময়ে দুজন রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের গঠন ৫: ৪ অনুপাতে রক্ষণশীলদের পক্ষে দাঁড়ায়। এখন গিন্সবার্গের মৃত্যুর ফলে এই সর্বোচ্চ আদালতের সবচেয়ে জনপ্রিয় উদারনৈতিক সদস্যের স্থলে আরও একজন রক্ষণশীল বিচারকের নিযুক্তি নিশ্চিত করার সুযোগ পেয়েছেন ট্রাম্প। প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস মাঝেমধ্যে উদারপন্থীদের সঙ্গ দিয়েছেন, যা রক্ষণশীলদের ক্ষিপ্ত করেছে। এখন একজন ‘যথার্থ’ রক্ষণশীলকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য জেগে উঠেছে।

গিন্সবার্গের মৃত্যুর খবর শোনার পর কালবিলম্ব না করেই ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি একজন রক্ষণশীল নারী বিচারপতিকে মনোনয়ন দেবেন। ইতিমধ্যে এই তালিকার শীর্ষে কারা রয়েছেন, তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় জল্পনা–কল্পনা শুরু হয়েছে। ট্রাম্পের নির্ভরশীল মিত্র সিনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনের জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন না, তার আগেই বিচারপতি প্রশ্নে সিনেটে ভোটের ব্যবস্থা করবেন। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শেষ বছরে আসন্ন নির্বাচনের দোহাই দিয়ে ম্যাককনেল পুরো এক বছর তাঁর মনোনীত প্রার্থীর ব্যাপারে শুনানি ঝুলিয়ে রাখেন। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর বিলম্ব করেননি, একজন রক্ষণশীল বিচারপতির প্রার্থিতা সিনেটে পাস করিয়ে নিয়েছিলেন।

এখন নিজের ঘোষিত নীতি ভেঙে পরবর্তী নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বিচারপতির নিয়োগ নিশ্চিত করতে চাইছেন ম্যাককনেল। ডেমোক্র্যাটরা তাঁর এই ডিগবাজিকে ভন্ডামি বলে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছে। ট্রাম্পের ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন বলেছেন, শুধু পরবর্তী প্রেসিডেন্ট—তা সে যে–ই হোক—গিন্সবার্গের শূন্যস্থানে মনোনয়ন দেবেন। কিন্তু সে জন্য ভোটারদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। সিনেটে ডেমোক্রেটিক নেতা চাক শুমারও একই কথা বলেছেন, কিন্তু মুখে দাবি করা ছাড়া আর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাঁদের কারোরই নেই।

এ মুহূর্তে মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকানদের ৫৩: ৪৭ অনুপাতে সংখ্যাধিক্য রয়েছে। নামমাত্র সংখ্যাধিক্য ভোটে বিচারপতির নিয়োগ নিশ্চিত করার নিয়ম রয়েছে, ফলে দলীয় সিনেটরদের মধ্যে কেউ বিগড়ে না গেলে ট্রাম্প আরও একজন রক্ষণশীল বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিতে সক্ষম হবেন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা একজন রিপাবলিকান উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রতিটি রিপাবলিকান ভোটার এখন এতটাই উদ্দীপ্ত যে তারা সবাই ট্রাম্পের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হবে। যেসব রিপাবলিকান ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করেন তাঁরাও ট্রাম্পের ‘ম্যাগা’ (অর্থাৎ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’) এই ছাতির নিচে শামিল হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিষয়টি ডেমোক্র্যাটদেরও একইভাবে প্রণোদিত করবে। রক্ষণশীল নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন নাগরিক অধিকার প্রশ্নে, যেমন গর্ভপাত, লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণ প্রশ্নে বহু আইন ও নিয়ম-কানুন বাতিল করেছে। এটি ডেমোক্র্যাটদের খেপিয়ে তুলেছে। রক্ষণশীলেরা, বিশেষত ইভানজেলিক্যাল নামে পরিচিত ধর্মীয় ভোটাররা, দীর্ঘদিন গর্ভপাতের অধিকার রদের দাবি তুলে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নারী গর্ভপাতের অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে। এখন সেই অধিকারের ওপর নতুন আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় তাঁরা ভীত। ২০১৮ সালে নারী ভোটারদের শক্তিতে ভর করেই ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছিল। জো বাইডেন আশা করছেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নটি এই সব নারী ভোটারকে আরও অধিক সংখ্যায় তাঁর শিবিরে টেনে আনবে।

হিসাবটা হয়তো একদম অমূলক নয়। গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর বাইডেনের নির্বাচনী শিবির রেকর্ড পরিমাণ চাঁদা তুলতে পেরেছে। এক হিসাবে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ৯টার মধ্যে তারা ৩০ মিলিয়ন ডলার তুলতে পেরেছে, যা একটি রেকর্ড। দিন শেষে এই চাঁদার পরিমাণ ৪৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

গিন্সবার্গের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া সিনেট নির্বাচনের ওপরও প্রভাব ফেলবে। রিপাবলিকানদের তিনজন সিনেট সদস্য, যাঁরা পুনর্নির্বাচনের জন্য লড়ছেন, ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় জনমত জরিপে পিছিয়ে আছেন। গিন্সবার্গের শূন্যস্থান পূরণের প্রশ্নে উভয় দলের প্রার্থীদেরই ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হচ্ছে। তাঁদের একজন, অঙ্গরাজ্য মেইনের সিনেটর সুসান কলিন্স বলেছেন, তিনি চান না নির্বাচনের আগে বিচারপতির প্রশ্নে ভোট হোক। আলাস্কার মধ্যপন্থী সিনেটর লিসা মুরকাউস্কি-ও একই কথা বলেছেন। এঁদের আপত্তির মুখে ম্যাককনেল সিনেটে ভোটের ব্যবস্থা করলে নিজের দলের ভেতরেই বিরোধিতার মুখে পড়তে পারেন।

জল যেদিকেই গড়াক, একটা বিষয় স্পষ্ট। পরবর্তী নির্বাচনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আগে থেকেই তপ্ত হয়ে ছিলেন। গিন্সবার্গের মৃত্যুর ফলে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।