সাইকেলপ্রেমী এক প্রধানমন্ত্রী

রাজপ্রাসাদের বাইরে সাইকেল পার্ক করে রাখছেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট। ২০১৭ সালে তাঁর এই ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল
ছবি: টুইটার

২০১৭ সালে প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে, কোনো রকম নিরাপত্তা ছাড়াই নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের খবর দিতে রাজপ্রাসাদে গিয়েছিলেন সাইকেলে করে। সেবার মার্ক রুটের সেই ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছিল। শুক্রবার নিজের মন্ত্রিসভার পদত্যাগের খবর দিতে রাজা উইলিয়াম আলেক্সান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে যান মার্ক রুট। বলার অপেক্ষা রাখে না এবারও তিনি সাইকেলে চড়েই গেলেন।

দেশের প্রধানমন্ত্রী সাইকেলে চেপে তাঁর দপ্তরে যাচ্ছেন, প্রটোকল নেই, নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। উপমহাদেশের বাসিন্দাদের কাছে তো বটেই, বিশ্বে এমন দৃশ্য বিরল হলেও ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে দৃশ্যটি বেশ পরিচিত ও অনেকটা স্বাভাবিক। তাদের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন, এই দৃশ্যের সঙ্গে তারা বেশ পরিচিত।

শুধু প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটই নন। সাইকেল নেদারল্যান্ডসের প্রায় সব মানুষের কাছেই প্রিয়। তাদের সাইকেলপ্রেম এতই বেশি যে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশটির মোট জনসংখ্যার (১ কোটি ৭০ লাখ) চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা (২ কোটি ৩০ লাখ) বেশি হয়ে গিয়েছিল।

সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যায়, নেদারল্যান্ডসের মানুষ মোট ভ্রমণের চার ভাগের এক ভাগ সাইকেলে করে। বাকি ভ্রমণগুলো তারা বাস-ট্রাম, রেল, ব্যক্তিগত গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনে করেন।

বছর দু-এক আগে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্ক রুট বলেন, ‘গত ১০ বছরে আমি খুব বেশি সাইকেল চালাইনি। এখন আবারও আমি একটি সাইকেলের মালিক হয়েছি। আবহাওয়া ঠিকঠাক থাকলে আমি সাইকেলে করেই অফিসে যাই।’

২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর দ্য হেগে তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ‘ব্রেক্সিট ব্রেকফাস্ট’-এ পৌঁছান বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে। আর মার্ক রুট যান তাঁর প্রিয় সাইকেলে চড়ে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ফোর্বস বলছে, এটি কোনো ‘স্টান্ট’ ছিল না। ডাচ প্রধানমন্ত্রী সত্যি সাইকেলপ্রেমী। এর আগেও তাঁর সাইকেলে করে গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। এর আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেদারল্যান্ডস সফরে গেলে তাঁকে সাইকেল উপহার দেন রুট।

ডাচদের সাইকেলপ্রীতির খানিকটা ব্যাখ্যা করেন রুট। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামকে তিনি বলেন, ‘ডাচরা সাইকেল ভালোবাসে। কারণ, আমাদের দেশটা খুব ছোট। এখানে গাড়ি নেওয়াটা অবশ্যই একটা বিকল্প। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনাকে যানজট আর পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অনেক আগে থেকেই, বলতে গেলে ১৯ শতকের শেষ দিক থকেই আমরা সাইকেলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।’

মার্ক রুট দায়িত্বে থাকাকালীন তাঁর সরকার সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে ‘ট্যুর ডি ফোর্সে’ নামে একটা প্রকল্পই চালু করে। যে প্রকল্পের লক্ষ্য ২০১৭ সাল থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের ব্যবহার অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ানো। প্রকল্পের পরিচিতিতে বলা হয়, ‘বাইসাইকেল আমাদের শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ সুগম করে ও শহরকে আরও বাসযোগ্য করে রাখে। অনেক মানুষকে কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখে, মানুষের জীবনে হাসি ও জীবন থেকে অবসাদ দূর করে। গ্রামের দিকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানকার শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতে, কর্মস্থলে যেতে বা কেনাকাটা করতে দোকানে যেতে সাইকেল খুব জরুরি।’

সম্প্রতি দ্য হেগে সাইকেল চালিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে করণীয় নিয়ে আলোচনায় বসতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিতে যান মার্ক রুট
ছবি: এএফপি

সমতল ভূমি হওয়ার কারণে নেদারল্যান্ডসের ভূচিত্রও দুই চাকার যানবাহনের জন্য বেশ উপযোগী। এরপরও তারা সাইকেলের ব্যবহারকে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে সাইকেল চালানোর উপযোগী করে তৈরি করেছে। দেশটিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার কিলোমিটার সাইকেলের লেন তৈরি করা আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্ডারগ্রাউন্ড সাইকেল পার্কিংয়ের জায়গা নেদারল্যান্ডসের উতরেখ শহরে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের তথ্যমতে, ১০ বছর আগের তুলনায় তাঁদের দেশে এখন অনেক বেশি সাইকেলের ট্রাফিক বাতি, লেন আছে। তিনি বলেন, শুধু শহরেই নয়। গ্রামেও এসব সুবিধা রয়েছে, যার ফলে সাইকেল চালানো আরও সহজ ও নিরাপদ হয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য, যখন তারা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে মার্ক রুট সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে টানা দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দেশটিতে এত দিন রুটের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল।

তবে এই দফায় পদত্যাগ করলেও সাম্প্রতিকতম জনমত জরিপগুলো বলছে, মার্চের নির্বাচনে মার্ক রুটই আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন। আর তা হলে ২০১০ সালের পর টানা চতুর্থ দফায় তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী হবেন।