সায়গন থেকে কাবুল: যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে সেই পরাজয়ের সুর

আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অভিযান
ফাইল ছবি: এএফপি

আলাদা দুটি দেশ, আলাদা সময়, আলাদা প্রেক্ষাপট। কিন্তু বিদায়ের ধরন অনেকটা একই। অর্ধশতকের বেশি সময় পর এসে কাবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে যাওয়া অনেককেই মনে করিয়ে দিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়াকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই আফগানিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের পরাজয়ের কথা বললেন।

দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কর্তৃত্বের আসনে চলে আসে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে তারা যে কয়টি যুদ্ধে জড়িয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ছিল ভিয়েতনাম ও সদ্য সমাপ্ত আফগান যুদ্ধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয় গত শতকে। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়। পরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে দেশটি থেকে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট তত্কালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের পতন হয়। অপর দিকে আফগান যুদ্ধ শুরু হয় বেশ ২০০১ সালে। ৩১ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি থেকে সব সেনা ফিরিয়ে নেয় মার্কিন সরকার।

ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় ঘটেছিল প্রতিপক্ষ উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে, সেই একই পরিণতি দেখা গেছে আফগানিস্তানে। অভিযানের মধ্য দিয়ে যে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেই বিদায় নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাদের বিদায়ের মধ্যেই আবার আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে তালেবান।

তত্কালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের একটি ভবনের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যেভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র

ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির স্নায়ুযুদ্ধের ফসল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণ যায় ফ্রান্সের হাতে।

তবে দেশটির স্বাধীনতাকামী নেতারা ঔপনিবেশিক এই শাসন মেনে নিতে পারেননি। দেশটিতে শুরু হয় স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ। আট বছরের যুদ্ধ শেষে ফ্রান্সের শাসন থেকে মুক্তি মেলে ভিয়েতনামের বাসিন্দাদের। দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায় দেশটি—উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম। উত্তর ভিয়েতনামে শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে কমিউনিস্ট সরকার। আর দক্ষিণ ভিয়েতনামের শাসনক্ষমতা যায় মার্কিনপন্থী পুঁজিবাদী সরকারের হাতে।

তবে একই জাতি হয়ে আলাদা দুটি দেশ মেনে নিতে পারেনি উত্তর ভিয়েতনাম। অভিন্ন দেশের লক্ষ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। ছিল পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বও। এ নিয়ে সংঘাত চরমে ওঠে। পুঁজিবাদী দক্ষিণ ভিয়েতনামকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র। অপর দিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কারণে উত্তর ভিয়েতনাম পাশে পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনকে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ নেয় ১৯৬৫ সালে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে লড়তে দেশটিতে পাঠানো হয় লাখ লাখ মার্কিন সেনা এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সদস্যদের। তবে দেশটিতে সুবিধা করে উঠতে পারেনি মার্কিনরা। দীর্ঘ এ যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটে ৫৮ হাজারের বেশি মার্কিন সেনার।

ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের কারণ

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করা। তাদের এমনভাবে ঘায়েল করা যেন বিরোধীরা প্রতি আক্রমণের জন্য পিঠ তুলে না দাঁড়াতে পারে। তবে এ কৌশল কাজে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে উত্তর ভিয়েতনামের ভিয়েত কং নামে পরিচিত পিপলস আর্মির কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের মৃত্যু হলেও এর থেকেও বেশি যোদ্ধা নতুন করে যোগ দিয়েছিল। পাশাপাশি যুদ্ধের ফলে অবকাঠামোগত ক্ষতিও দ্রুত পুষিয়ে নিয়েছিল তারা।

এদিকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে ভিয়েত কংদের কৌশল ছিল যুদ্ধের সময় বাড়িয়ে শত্রুপক্ষের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া। যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যাপকভাবে গেরিলা হামলা চালানো শুরু করে তারা। উত্তর ভিয়েতনামের জন্য এসব কৌশল খুবই কার্যকর হয়ে ওঠে। অতর্কিত চালানো হামলায় হাজারে হাজারে মাকিন সেনা মারা যেতে থাকে।

মার্কিন সেনাদের লাশের সারি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মনে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তৈরি করে। এ ছাড়া যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়া এবং কার্যকরী কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা সে সময় দেখা দেয়নি। এসবের জের ধরে শেষমেশ উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে এক শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৭৩ সালে এসে ভিয়েতনাম ছাড়তে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।

এ গেল ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের পরাস্ত হওয়ার পর্ব। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম ছেড়ে গেলেও রেখে গিয়েছিল তাদের সাজানো শক্তিশালী দক্ষিণ ভিয়েতনাম সেনাবাহিনী। মার্কিন উপস্থিতিতে এ সেনাবাহিনী সাফল্যের দেখা পেলেও পরে উত্তর ভিয়েত কংদের সামনে টিকতে পারেনি। ফলে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে এসে পতন হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের।

দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাদের পতনের পেছনে মূল কারণ ছিল তাদের জনগণ বিমুখিতা। যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া সাফল্য এনে দিলেও তারা দেশটির মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে এই সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা ছিল না দেশটির বাসিন্দাদের। মানুষের আস্থা ছাড়া তাদের টিকে থাকা একপ্রকার অসম্ভব ছিল।

দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাদের ব্যর্থতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, দ্রুত জয় পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, দেশটিতে তাদের মাধ্যমে স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টির ভাবনা তাদের ছিল না।

তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর হুমকির মুখে থাকা আফগানদের দেশটি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানেও একই পরিণতি?

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের পতনের সঙ্গে মেলাচ্ছেন অনেকে। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতনের মুখে এসে সায়গনে অবস্থান করা মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের আগমুহূর্তে এসে সায়গনের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, একটি ভবনের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আফগানিস্তানেও যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের একই পরিণতি হয়েছে।

কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিণতি ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই হতে যাচ্ছে—এমন কথা যাঁরা বলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন রিপাবলিকান দলের শীর্ষস্থানীয় আইনপ্রণেতা মিচ ম্যাককনেল। তালেবানের কাবুল দখলের আগেই তিনি বলেন, মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার খবরে মনে হচ্ছে কাবুল পতনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকটা একই পরিণতি হলেও দুটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কিন্তু আলাদা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মার্কিন পুঁজিবাদ ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে। আর ২০০১ সালে এসে আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হলো সন্ত্রাসবাদ।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদা। সন্ত্রাসী এই সংগঠনটিকে সে সময় আশ্রয় দেওয়ার কারণে আঙুল ওঠে তালেবানের দিকে। আল–কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনও তালেবানের আশ্রয়ে অবস্থান করছিলেন আফগানিস্তানে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলো। উত্খাত করা হয় তালেবান সরকারকে। এরপর ২০১১ সালে পাকিস্তানের একটি শহরে অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয় আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে।

অভিযান শুরুর পর টানা ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করে মার্কিন সেনাবাহিনী। কোটি কোটি ডলার খরচ করে গড়ে তোলে অত্যাধুনিক আফগান সেনাবাহিনী। পশ্চিমা আদলে দেশটিতে বসানো হয় মার্কিন সমর্থিত সরকার। ২০২০ সালে এসে তালেবানের সঙ্গে এক চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার। সেই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগেই অবশ্য তাদের বেশির ভাগ সেনাসদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

এই আগস্টেই তৎপরতা শুরু করে তালেবান। ৬ আগস্ট থেকে আফগানিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখল করা শুরু করে তারা। সে ধারাবাহিকতায় অনেকটা প্রতিরোধহীনভাবে ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। তাদের সামনে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে মার্কিন প্রশিক্ষিত আফগান সেনাবাহিনী। যে তালেবানকে উত্খাতে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তারাই আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। সেদিনই কাবুল ত্যাগ করে উজবেকিস্তানে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। বিলুপ্ত হয় মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকার।

তবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত বাহিনীর পতন ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক দ্রুত হয়েছে। ১৯৭২ সালে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জেমস উইলব্যাংকস এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম ত্যাগের পর উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী ভিয়েত কংদের বিরুদ্ধে আরও দেড় বছর যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। গোলাবারুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। তবে আফগান সেনাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। মার্কিন সহায়তা ছাড়া তারা তালেবানদের সামনে সপ্তাহ দুয়েকের কম সময় টিকতে পেরেছে। তালেবানের আগ্রাসনের মুখে হয় তারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছে অথবা আত্মসমর্পণ করেছে।

দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তান সেনাদের পরিণতির মধ্যে মিল খুঁজেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ শন ম্যাকহেলসহ কয়েকজন ইতিহাসবিদ। তাঁদের মতে, বিরোধী শক্তির চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের সেনাদের। এরপরও তাঁরা টিকতে পারেনি। দুটি যুদ্ধেই তাঁদের পরাজয়ের পেছনে মোটাদাগে মূল কারণ ছিল, দুর্নীতিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা জনগণবিমুখ সরকার ও সেনাবাহিনী এবং সেনাসদস্যদের মধ্যে মনোবলের চরম অভাব।

কাবুলের পতনের মধ্য দিয়ে আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরে তালেবান
ছবি: রয়টার্স

একই শিক্ষা

ভিয়েতনাম যুদ্ধে চরমভাবে অপদস্থ হয় যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৈরি হওয়া দেশটির অপরাজেয় ভাবমূর্তি অনেকটাই নষ্ট হয়। এরপরও বারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে মার্কিনরা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ফলেই আফগানিস্তানে একই পরিণতির শিকার হয়েছে দেশটি।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরিণতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপির অধ্যাপক অ্যান্ড্রু উইয়েস্ট। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তান যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে একই শিক্ষা দিয়েছে। মূল শিক্ষাটা হলো, যে দেশে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং বাইরের হুমকির সঙ্গে নড়বড়ে একটি সরকার লড়ছে, তাদের পক্ষে লড়াই করে যুক্তরাষ্ট্রের জয় পাওয়া সম্ভব না। ভিয়েতনাম থেকে পাওয়া একই শিক্ষা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।

অ্যান্ড্রু উইয়েস্টের ভাষ্য, দুই দেশেই যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি যুদ্ধে জড়িয়েছিল যাতে জনগণের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। যুদ্ধে জয় পাওয়ার জন্য দুই দেশেই এমন একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দরকার ছিল, যারা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি ছাড়াই নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে পারে। আর এমন সরকারের দরকার ছিল, যাদের জন্য দেশের মানুষ আত্মত্যাগ করতে পারে। কিন্তু দুটি দেশেই এই বিষয়গুলোতে ভুল করেছে মার্কিনরা।

যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশে এমন সেনাবাহিনী ও সরকার গড়ে তুলতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এমনটি করতে গেলে মার্কিন রাজনীতিকদের এ নিয়ে আরও গভীর বোঝাপড়া থাকতে হবে। এ ছাড়া এমন সেনা অভিযানের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও জবাবদিহি থাকতে হবে তাদের। অ্যান্ড্রু উইয়েস্ট প্রশ্ন রাখেন, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের মেয়াদ কেন বাড়ানো হয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা কি যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারবে?

আফগানিস্তান ও ভিয়েতনাম দুটি দেশেই মার্কিন মদদপুষ্ট সরকার এবং সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ছাড়া এই সেনাবাহিনী যেমন নিজ দেশের মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারেনি, তেমনই মানুষও তাদের নিজেদের করে নিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা হলো, কোটি কোটি ডলার খরচ করে তাদের শুধু যুদ্ধ করার জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছিল, মানুষের আস্থা অর্জন করতে নয়।

এ ছাড়া দেশের যুদ্ধে জয়ের পাশাপাশি নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সে দেশের মানুষের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকতে হয়। আফগানিস্তান কিংবা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এই ধারণার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি মার্কিন প্রশাসন। এটিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ভুল।

ভবিষ্যতে যদি যুক্তরাষ্ট্র আবারও এমন ধরনের কোনো লড়াইয়ে জড়ায়, তবে আগের ভুলগুলো থেকে তাদের শিক্ষা নিতে হবে। না হলে একই ধরনের পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে তাদের।

তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, পলিটিফ্যাক্ট ডটকম