‘সুইসাইড নোট’ লিখে ফেলা মানুষটিই এখন অন্যের জীবন বাঁচান

ক্যাম অ্যাডায়ার এখন ইন্টারনেটে আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে কথা বলেন
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

৩২ বছর বয়সী ক্যাম অ্যাডায়ার নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এমন বিধ্বংসী চিন্তা মাথায় আসার পর ক্যাম বুঝতে পারেন, তিনি ভিডিও গেমসে আসক্ত। আর এই আসক্তি একদম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

ক্যাম বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে এ সমস্যায় ভুগেছি। হাইস্কুল থেকে ঝরে পড়েছি। কখনো কলেজে যাওয়া হয়নি। চাকরি করছি, এমন ভান করে পরিবারকে ধোঁকা দিয়েছি। একপর্যায়ে আমি একটি সুইসাইড নোটও লিখে ফেলি। সে রাতেই আমি বুঝতে পারি, বাঁচার জন্য আমার সাহায্য দরকার। এখন আমি গেমসের আসক্তি ছাড়া ৩ হাজার ৮৬০ দিন পার করে দিয়েছি।’

কানাডার নাগরিক ক্যাম ভিডিও গেমসের আসক্তি থেকে বেরিয়ে চমৎকার একটি উদ্যোগ নেন। যেসব মানুষ ভিডিও গেমসের আসক্তিতে ভুগছে, তাদের সাহায্যের জন্য ক্যাম ‘গেম কুইটারস’ নামের অনলাইনভিত্তিক একটি সহায়ক গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বজুড়ে এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি।

ক্যামের ভিডিও গেমসে আসক্ত হওয়া, দুর্বিষহ জীবন কাটানো, আত্মহত্যার ভাবনা, আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা ও আসক্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় উদ্যোগী হওয়ার গল্প তুলে ধরেছে বিবিসি অনলাইন।

ক্যাম জানান, ভিডিও গেমসের প্রতি ভয়াবহ আসক্তি তাঁর জীবন থেকে বেশ কয়েকটি বছর কেড়ে নিয়েছে। অনেক চেষ্টায় আসক্তিমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর তাঁর মধ্যে সহায়তামূলক একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গড়ার তাড়না কাজ করে। এ তাড়না থেকেই তিনি গড়ে তোলেন ‘গেম কুইটারস’।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে জারি হয় লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ। এতে বিশ্বজুড়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এই কঠিন সময়ে প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইন্টারনেট বিশ্বকে ভার্চ্যুয়ালি সচল রাখে। এমন পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা ক্যামের মতো মানুষের জন্য অনেক কঠিন বলে মনে করেন তিনি।

ক্যাম বলেন, ‘আমি স্বাভাবিক সময়ে টুইচ ও ইউটিউবে যতটা সময় কাটাই, মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে তার চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এখন গেমসের ওপর নির্ভরতাকে ইন্টারনেটে আসক্তির অংশ বলে বর্ণনা করছে। তাদের ভাষ্যমতে, অত্যন্ত নিবিষ্টভাবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে গেম খেলতে খেলতে আসক্তি তৈরি হয়। যা পরবর্তী সময়ে বৈকল্যের জন্ম দেয়।

অনেকে বলে থাকেন, এই আসক্তি অ্যালকোহল বা মাদকাসক্তির মতো অতটা গুরুতর নয়। তবে তা ভুক্তভোগীদের প্রাণশক্তি হ্রাস করে দিতে পারে।

স্নায়ুরোগ ও ডিজিটাল আসক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ডোয়ান এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন যে করোনা মহামারির কারণে জারি হওয়া লকডাউন ভিডিও গেমসের আসক্তির সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়েছে।

অ্যান্ড্রু ডোয়ান বলেন, মহামারি পরিস্থিতি জনজীবনের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। চাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে গেমিং ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো বিনোদনমূলক ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। চাপমুক্ত হওয়ার জন্য ডিজিটাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার আসক্তির ঝুঁকি তৈরি করছে।

ডোয়ানও একসময় ভিডিও গেমসে আসক্ত ছিলেন। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনে পড়ার সময়, আবাসিক প্রশিক্ষণের সময় তিনি সপ্তাহে ৮০ থেকে ১০০ ঘণ্টা ভিডিও গেমস খেলতেন। এভাবে ১০ বছর চলেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এ আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তিনি।

ডোয়ানের আশঙ্কা, মানুষ এখন অনলাইনে যে পরিমাণ সময় কাটায়, তাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের আসক্তি আরও বাড়তে পারে।

ইন্টারনেটে আসক্তি রোধে বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তারা এ-সংক্রান্ত কিছু টুল বা উপকরণ তৈরি করেছে। এগুলো দিয়ে গেমিং ওয়েবসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশগম্যতা ব্লক করা যায় কিংবা প্রবেশ সীমিত করা যায়।

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে আসক্তি থেকে একপর্যায়ে জুয়ার আসক্তি তৈরি হতে পারে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘লাইনওয়াইজ’ হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা শিশুদের, বিশেষ করে তাদের মা-বাবার কথা বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

এ ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ব্যবহার করে মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা দূর থেকেই শিশুদের গেমিং সাইটে শিশুদের প্রবেশের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এসব সাইটে শিশুদের সময় কাটানোর পরিমাণ সীমিত করে দিতে পারেন। স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে এটি ব্যবহার করা যায়। লাইনওয়াইজে ‘প্যারেন্টাল লক’ আছে। এর মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি বা সহিংস উপকরণ ঠেকানো যায়।

সান ডিয়েগোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লাইনওয়াইজের ডিজিটাল সুস্থতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী তেওডোরা পাভকেভিচ বলেন, যাদের বয়স কম, তাদের মধ্যে অনলাইনে অনেক বেশি সময় কাটানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর এতে কিশোর-কিশোরীদের মা-বাবাদেরও সায় দিতে দেখা যায়।

তেওডোরা পাভকেভিচ মনে করেন, অনলাইনে ঠিক কতটুকু সময় কাটালে তা স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে, তা নির্ধারণের উপায় আছে। তবে তা নির্ধারণের জন্য যে পর্যায়ের মানসিক পরিপক্বতা দরকার, তা ২৫ বছর বয়সের আগে অর্জিত হয় না।

লাইনওয়াইজের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন আমরা সেখানে অনেক বেশি সময় দিই, মনোযোগ দিই, তথ্য–উপাত্ত দিই। অনলাইনে অনেক গোপন ফাঁদ থাকে। সে কারণে শিশুদের পক্ষে পরিমিত, নিরাপদ উপায়ে ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে অনলাইন ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে।’

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে আসক্তি থেকে একপর্যায়ে জুয়ার আসক্তি তৈরি হতে পারে। ব্যবহারকারী বাজির বিভিন্ন অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে প্রবেশের মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন।

‘বেটব্লকার’ নামের অ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ হাজারো জুয়ার ওয়েবসাইট বা অ্যাপ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্লক করে রাখতে পারে। একবার এই ব্লক কার্যকর হলে তার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জুয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোতে আর ঢুকতে পারবে না।

বেটব্লকার অ্যাপ বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারী নিজে তো বটেই, তার সঙ্গী, বন্ধু বা অভিভাবকেরা এই অ্যাপ ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণের কাজটি করতে পারেন।

বেটব্লকারের প্রতিষ্ঠাতা ডানকান গার্ভি মনে করেন, ভার্চ্যুয়ালি বাজি খেলার যে সুযোগ, তা এড়িয়ে চলাটা এখনকার বাজিতে আসক্ত ব্যক্তিদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।

এ প্রসঙ্গে ডানকান গার্ভি বলেন, ‘সবাই তাদের পকেটে ক্যাসিনো বা বুকি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। দূর থেকেই খুব সহজে এটা খেলা যায়।’

ব্যবহারকারীরা কয়েক ঘণ্টা, দিন বা সপ্তাহ হিসাবে জুয়ার সাইটগুলো ব্লক করে রাখতে পারে। এ ছাড়া গেমিং–জাতীয় ওয়েবসাইট বন্ধ করতেও এই অ্যাপ ব্যবহার করা যায়।

জুয়ার ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশ ঠেকানোর আরেকটি অ্যাপ হলো ‘গ্যামব্লক’। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি কোম্পানি এ অ্যাপ তৈরি করেছে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ডেভিড ওয়ার বলেন, তাঁরা জুয়াতে আসক্তির সমস্যা সমাধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

লাইনওয়াইজ, বেটব্লকার, গ্যামব্লকের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের আসক্তির সমস্যা হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন ক্যাম। তিনি বলেন, কেউ যদি কোনো ধরনের আসক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে তাঁর উচিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। আসক্তি থেকে বাঁচতে অন্যের সহায়তা চেয়েছিলেন বলেই নিজের জীবন রক্ষা পেয়েছে বলে বিশ্বাস করেন ক্যাম।

ক্যাম বলেন, ‘আসক্তকালে আমি ধোঁকাবাজ ছিলাম। সবকিছু এড়িয়ে চলতাম। বিচ্ছিন্ন থাকতাম। বৈরী আচরণ করতাম। ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলাম। কিন্তু এখন আমি সুখী, সন্তুষ্ট। আমি স্বাভাবিক জীবনের চাপ সামলাতে পারি।’

ভিডিও গেমসে আসক্তি নিয়ে ক্যাম যে কাজ করছেন, তার আলোকে ‘সাইকিয়াট্রি রিসার্চ’ সাময়িকীতে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একসময়ের তিনি যাতে আসক্ত ছিলেন, এখন সেই বিষয়ের একজন আন্তর্জাতিক বক্তা তিনি। আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে কথা বলেন। সহায়তার মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচান।