সোয়া লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার

অপরিণত ও অসুস্থ নবজাতকদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ক্যাঙারু মাদার কেয়ার চিকিৎসাপদ্ধতি করোনাভাইরাস মহামারিতে ব্যাহত হচ্ছে।
ছবি: রয়টার্স

অপরিণত ও অসুস্থ নবজাতকদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ক্যাঙারু মাদার কেয়ার চিকিৎসাপদ্ধতি করোনাভাইরাস মহামারিতে ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এর সহযোগীদের নতুন গবেষণা বলছে, পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে এ ধরনের নবজাতকেরা বেশি কষ্ট পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যু হচ্ছে।

ল্যানসেট ইক্লিনিক্যাল মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, জন্মের পর নবজাতকের মা-বাবার ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেসব শিশু কম ওজন নিয়ে অথবা সময়ের আগেই জন্মায়, তাদের জন্য এটি খুব প্রয়োজন। তবে অনেক দেশে করোনায় সংক্রমিত হলে বা সংক্রমিত হয়েছেন, এমন সন্দেহে মায়ের কাছ থেকে নবজাতকদের আলাদা রাখা হচ্ছে। এতে নবজাতকদের মৃত্যু ও দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যগত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ছে।

দরিদ্র যেসব দেশে অপরিণত শিশু ও নবজাতকদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি, সেসব দেশে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, করোনার সংক্রমণের কারণে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে।
ক্যাঙারু মাদার কেয়ারের মাধ্যমে ১ লাখ ২৫ হাজার শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

ক্যাঙারু মাদার কেয়ারে মায়ের বুকে শিশুকে এমনভাবে শুইয়ে রাখা হয়, যেন দুজনের ত্বকে ত্বক লেগে থাকে। নামটা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী ক্যাঙারু থেকে। ওরা নিজের পেটের নিচে একটি বিশেষ থলেতে বাচ্চাদের নিয়ে চলাফেরা করে।

অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের মৃত্যু ক্যাঙারু মাদার কেয়ার ব্যবস্থায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। হাইপোথার্মিয়া (শরীরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যাওয়া) কমেছে ৭০ শতাংশের বেশি। আর বিভিন্ন সংক্রমণ কমেছে ৬৫ শতাংশ।

সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, বছরে দেড় কোটি শিশু ৩৭ সপ্তাহের আগেই অপরিণত অবস্থায় জন্মায়। আর ২ কোটি ১০ লাখ শিশু কম ওজন (আড়াই কেজির নিচে) নিয়ে জন্মায়। এ ধরনের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। তাদের বিকাশ দেরিতে হতে পারে। এ ছাড়া সংক্রমণ ও নানা জটিলতা হতে পারে। নবজাতক ও পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যুর বড় কারণ হলো অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মেটারনাল, নিউবর্ন, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ অ্যান্ড এজিংয়ের পরিচালক চিকিৎসক অংশু ব্যানার্জি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাঙারু মাদার কেয়ার সেবা ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, মা ও নবজাতকের উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে এবং ক্যাঙারু মাদার কেয়ারের মতো জীবন রক্ষাকারী বিশেষ চিকিৎসাসেবা বিস্তৃত করতে না পারলে শিশুমৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে যে উন্নতি হয়েছে তা ঝুঁকিতে পড়বে।

এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে বা সংক্রমিত হয়েছেন এমন সন্দেহ থাকলেও মাকে নবজাতকের সঙ্গে একঘরে রাখতে পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মায়ের ত্বকের সঙ্গে শিশুর ত্বক লাগিয়ে রাখতে হবে এবং বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে মাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনের একজন লেখক এবং মালাওয়ির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক কুইন ডিউব বলেন, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মা ও সন্তানকে একসঙ্গে সুরক্ষিত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত যেসব নবজাতক অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মায় তাদের মায়ের সঙ্গে সুরক্ষিত রাখতে হবে।

কুইন ডিউব আরও বলেন, অপরিণত ও অসুস্থ নবজাতকদের বাঁচাতে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার কম খরচে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের বাঁচাতে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাপদ্ধতি।

বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনকভাবে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যাহত হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে ১৭ দেশের ২০টি ক্লিনিকে নিয়মতান্ত্রিক পর্যালোচনা চালানো হয়। এতে দেখা যায়, করোনা মহামারিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে অথবা সংক্রমিত হতে পারেন এমন সন্দেহে এক-তৃতীয়াংশ মা ও শিশুকে আলাদা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার নবজাতক স্বাস্থ্যসেবাদান কেন্দ্রে পরিচালিত জরিপ গতকাল মঙ্গলবার ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, ৬২টি দেশের দুই-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা শনাক্ত হলে বা করোনায় শনাক্ত হয়েছেন এমন সন্দেহে মা ও নবজাতককে ক্যাঙারু মাদার কেয়ারে রাখেননি। এক–চতুর্থাংশ মাকে বুকের দুধ খাওয়াতে দেওয়া হয়নি।

গবেষণা বলছে, করোনায় সংক্রমিত হলে নবজাতকদের শরীরে তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। নবজাতকদের মৃত্যুঝুঁকিও কম। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় করোনায় সংক্রমিত হলে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ কারণে করোনা মহামারিতে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নারীদের বেশি সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন।