সৌদির দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁদের

‘হাতের কাছে জুতা থেকে শুরু করে যা পেত, তাই দিয়েই মারত আমাকে। অর্থ চাইলে কিংবা বাড়িতে ফোন করতে চাইলে আমাকে হুমকি দিত। যখন আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তখন আমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি।’

এই কথাগুলো ভারতের নাগরিক জয়নাব বেগমের। সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মতো ভারত থেকে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাওয়া নারীদেরও অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবছরই মধ্যপ্রাচ্যে অনেক নারী শ্রমিক পাচার করা হয়। তেমনই একজন নারী শ্রমিক ভারতের হায়দরাবাদের জয়নাব বেগম। লোভনীয় চাকরি ও বেতনের লোভ দেখিয়ে তাঁকে সৌদি আরবে পাচার করেছিল অবৈধ দালালেরা। কিন্তু ভালো বেতনের চাকরির বদলে জয়নাবকে কাজ করতে হয়েছে গৃহকর্মী হিসেবে। ন্যায্য বেতনের বদলে বছরখানেক ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিবার ভারতীয় সরকারের কাছে আবেদন জানালে রিয়াদে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস তাঁকে উদ্ধার করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে জয়নাবের মতো এমন ভাগ্য বরণ করতে হয় হায়দরাবাদের আরও অনেক নারীকে। হায়দরাবাদের শাহীন নগরের বাসিন্দা ইলিয়াস বেগম এখনো সৌদি আরবের অভিজ্ঞতা মনে করে শিউরে ওঠেন। মালিকের ছেলের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তাঁকে তিনতলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ইলিয়াস বেগম বলেন, ‘ভালো চাকরির কথা বলে ২০১৬ সালে আমাকে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাকে রিয়াদের একটি ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত কাজের ব্যাপারে প্রতিবাদ করলে আমাকে রড দিয়ে পেটানো হতো। একদিন মালিকের ছেলে আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। নিজেকে বাঁচাতে আমি ভবনের তৃতীয় তলায় যাই। সেখান থেকে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়।’

প্রাণে বেঁচে গেলেও দুটো পা-ই হারাতে হয়েছিল ইলিয়াসকে। তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর ইলিয়াসের স্বামীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রিয়াদে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস তাঁকে উদ্ধার করে দেশে পাঠায়।

সাইদাবাদের বাসিন্দা আমেনাকেও ইলিয়াসের মতো দুবাই নেওয়ার কথা বলে রিয়াদে পাচার করে দেওয়া হয়। এখন দেশে ফেরত এলেও সৌদি আরবের ভয়াবহ সেই দিনগুলোর কথা ভুলতে পারেননি আমেনা। তিনি বলেন, ‘দিনে একবার খাবার দেওয়া হতো আমাকে। এমনকি ঠিকমতো পানিও দিত না আমাকে। সারা দিন খাটার পরও তাঁরা আমার ওপর নির্যাতন চালাতেন।’ একদিন সুযোগ পেয়ে বাসা থেকে পালিয়ে স্থানীয় থানার সাহায্য নেন আমেনা। এরপর ভারতীয় দূতাবাস তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনে।

শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের অনেক নারী শ্রমিকও সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশ সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ১৩ জানুয়ারির মধ্যে নির্যাতনের শিকার ৩২৪ নারীকে দেশে ফেরত আনা হয়েছিল। দেশে ফেরার আগে তাঁদের অনেকেই তিন মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফ হোমে ছিলেন।

এ ছাড়া এর আগে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকজন নারী সৌদি আরবে গিয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে পাচার হওয়া এ রকম একজন বাংলাদেশি নারীর দাম প্রায় পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠত বলেও জানা গেছে।

আরও পড়ুন: