জয়-পরাজয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কে যেন চিৎকার করে ওঠে, ‘ক্লিয়ার।’
শব্দটা শুনে সানসেট থেকে একপ্রকারে লাফিয়ে পড়ে মন্টু ভাই। অল্পের জন্য লুঙ্গির কোঁচড়টা খোলেনি। বাঁ হাতে সামলে নিয়েছে। ঘরে ঢুকে দেখে টিভির পর্দায় আবার সেই কাঁপা কাঁপা ঢেউ। একটু পর ঝিরিঝিরি। পণ্ডশ্রম। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অ্যানটেনার জন্য এত চেষ্টাচরিত্র—সব বিফলে। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। ইচ্ছা হয় জোরসে একটা লাথি মারতে টিভির পর্দায়। কিন্তু এখন এটা করা যাবে না। কলোনির মুরব্বিরা সব এখানে। টিভি ঠিক করার নাম করে গতকাল সবার থেকে টাকা তুলেছিল। অ্যানটেনা, বাঁশ, তার বাবদ ৩০০ টাকা খরচ গেলেও উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে ১৬০ টাকা। তার মাথায় এখন জবাবদিহি আর টাকার চিন্তা।
‘মনু, বহুদ হইছে, এবার রাহো। এই ঝিলঝিলির মইধ্যে যা আয় দেইখ্যা লই।’
মোখলেছ কাকুর কথায় সবাই মাথা নাড়ায়। মন্টু ভাই মনে মনে ঢোঁক গিলে বসে পড়ে মেঝেতে।
সবার থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে বসেছেন সামাদ সাহেব। অহনা-সোহানার বাবা। টিএ ব্র্যাঞ্চের বড় বাবু। গত বছর কলোনির সবাইকে অবাক করে নতুন বউয়ের মতো এই রঙিন টিভিটা তিনি ঘরে তোলেন। সে থেকে তিনি কলোনির বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। সপ্তাহে অন্তত একদিন পাড়ার সবাই তার কোয়ার্টারে একত্র হয়। সেটা হতে পারে মঙ্গলবার বহুব্রীহি দেখার দিন, নইলে যেদিন শুক্রবার দুপুরে বাংলা সিনেমা দেখানো হয়, সেদিন।
বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে প্রতি রাতেই এখন থেকে আসর বসবে। একটু পরেই শুরু হবে ওপেনিং ম্যাচ। সাদেক সাহেব বড় একটা কাঁঠাল কাঁধে ঢুকেছেন। তাঁর গাছের কাঁঠাল। শাহাদাৎ ভাই হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল নাচাতে নাচাতে বলেন, ‘মুরুব্বি, আইজ দেখেন ধরা খাই যান কিনা। কাইল্যাগুলায় কিক মারলে কিন্তু পা তো দূরে হাতেও নাগাল পাইতেন না।’
ধুপ করে কাঁঠালটা মাটিতে রেখে সটান করে দাঁড়িয়ে যান সাদেক সাহেব। রফিক আংকেলের হাতে একটা প্রমাণ সাইজের পোস্টার ছিল। যেখানে সাদা-নীল ডোরাকাটা জার্সি পরনের ছোটখাটো একটা মানুষ ন্যাড়া মাথার একটা সোনার গোলকে চুম্বন খাচ্ছে। শাহাদাৎ ভাইয়ের কথায় যেন পোস্টারের লোকটাও মুখ ফিরে তাকাল। অকস্মাৎ এমন আক্রমণের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। তাই কারও মুখে কথা ফুটছিল না। শেষমেশ মোখলেছ কাকু ওরফে বরিশাইল্যা মোকলেস প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘এই ব্যাডা মুখ সামলাই কথা কও। মেরেডোনা যে দলে আছে, হেই দলরে হারাইবার শক্তি...।’
শাহাদাৎ ভাই মুচকি হেসে ওঠেন, ‘হায়রে সমর্থক, ভালো কইরা পেলেয়ারের নামটাও কইতে পারে না। মেরেডোনা না, বলেন ম্যারাডোনা। ডিয়েগো আর্মান্দ ম্যারাডোনা।’
এই সময় অহনাপু বড় থালায় বেশ কয়েক কাপ চা নিয়ে ঢোকেন। সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাৎ ভাইয়ের জবান বন্ধ। হারমোনিয়াম চালনায় সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
‘...ভেবে ত পাই না আমি কি হলো আমার
লজ্জা প্রহরী কেন খেলো না কো দ্বার...’

দুই.
‘কালা বুইজ্যা ইগারে চোয়ার মারি মাটত্তুন বাইর করি দে ন কিল্লাই...’
প্রথমার্ধে কেউ আর বিপক্ষ শিবিরের জালে বল জড়াতে পারল না। গোলশূন্য কেটে গেল আর্জেন্টিনা-ক্যামেরুনের ম্যাচ। ১৯৮৬-এর ম্যারাডোনা জাদুর কল্যাণে সমর্থন অবশ্য আর্জেন্টিনার দিকেই বেশি। তারপরও ভিন্নমতাবলম্বীরা আছেন। যেমন সমীরন আংকেল লোকসেডের ফোরম্যান। ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন অস্ট্রিয়া। সীমান্ত থেকে তিনি জার্মানি দেখেছেন। মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়নি, কিন্তু জার্মান ইঞ্জিনের দারুণ ভক্ত। প্রায় বলেন, ‘আরে, অস্ট্রিয়াতেই তো হিটলারের জন্ম...ব্যাটা একডা আছিল...।’ পরপর দুবার শিরোপার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসা দেশটার জন্য তাঁর সহানুভূতির শেষ নেই। বড়ুয়া আংকেলও জার্মানের হয়ে কথা বলেন। তবে তাঁর সমর্থনের কারণ ভিন্ন। তাঁর মতে, ওয়ার্ল্ড ওয়ারের রেজাল্ট যদি জার্মানের ফেভারে যেত, নেতাজি শিওর ভারতের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হতেন। ধর্মের কাঁটা চামচ দিয়ে ভারতকে টুকরো টুকরো করতে দিতেন না তিনি। ব্রাজিলেরও কিছু সমর্থক আছে। এরা আজ ভেতরে ভেতরে ক্যামেরুনের পক্ষে। অবশ্য আর্জেন্টিনার সমর্থক আধিক্যের কারণে কিছু বলার সাহস হয় না তাদের। ফিসফিস করে রাসেল বলে, ‘ভালোই তো চাইপ্যা ধরছে জচ্চোরগুলারে। দেউগ একটা গোউল। শুরুতেই একটা উষ্ঠা খাক।’
রাসেলের কথা হয়তো আড়াল থেকে শুনে ফেলে নিয়তিপুরুষ। মিনিট দশকের মধ্যে ডি-বক্সের বাইরের শর্ট বিয়িকের মাথা ছোঁয় আর্জেন্টিনার গোলবারে। এক মিনিট নিস্তব্ধতায় কাটল। তারপর সুনামির মতো উঠল উল্লাসের বলক। তবে উল্লাসকারীদের সংখ্যা নেহাত কম। রাসেল, শাহাদাৎ ভাই, সমীরণ আংকেলদের মতো কয়েকজন। অহনা আপু ওড়নায় মুখে চেপে কেঁদেই ফেলল। শাহাদাৎ ভাই বিষয়টা খেয়াল করে চুপ মেরে গেলেন।
একের পর এক আক্রমণে ক্যামেরুনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে আর্জেন্টিনা। বল ডি-বক্সের কাছাকাছি গেলেই হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে কলোনি। কিন্তু গোলের আর দেখা পায় না কোনো দলই।
খেলা শেষের মিনিট দশেক আগে নামানো হলো এক খেলোয়াড়কে। তাঁকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন শাহাদাৎ ভাই, ‘ট্রাম্প কার্ড নামছে। এবার এগারোজন গোলবারে গিয়ে দাঁড়াও। রক্ষা নাই।’
সবাই উৎসুক হয়ে উঠল লোকটার পরিচয় জানতে। এত বয়স্ক মানুষকে তো খেলতে দেখা যায় না। শাহাদাৎ ভাই জানান, এ লোক খেলা থেকে অবসর নিয়েছিলেন অনেক আগে। ক্যামেরুন বিশ্বকাপে চান্স পাওয়ার পর সে দেশের রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করে তাঁকে মাঠে নামান। কারণ একটাই, তিনি নাকি পুরো দলের প্রেরণার উৎস। নাম রজার মিলা। তবে র-এর সঙ্গে বাড়তি একটা আ-কার লাগালে ক্ষতি নেই। প্রকৃতই তিনি রাজা।
রজার মাঠে নামার পর থেকেই আরও শাণিত হয়ে ওঠে আক্রমণ। ক্ষণে ক্ষণে শঙ্কা, এই বুঝি আরেকটা গোল দিয়ে দিল ক্যামেরুন। এদিকে লোহার মতো কালো কালো পায়ের পাহারা আর ল্যাঙে খুদে জাদুকর ম্যারাডোনা একবারেই নিশ্চল।
উৎকণ্ঠায় রহিম ব্যাপারী অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। ওপরের কথাগুলো একসময় বলেই ফেললেন প্রকাশ্যে।
শেষে একটা লাল কার্ডের কল্যাণে ক্যামেরুনের খেলোয়াড় দশে নেমে এলেও কোনো সুবিধা করতে পারল না আর্জেন্টিনা। অহনাপুদের ফোঁচ ফোঁচ কান্নায় শেষ হলো বিশ্বকাপ ফুটবল ১৯৯০-এর উদ্বোধনী ম্যাচ। পচা শামুকে পা কাটার বেদনা নিয়ে অবশ্য আর্জেন্টিনা চলে গেল ফাইনালে। ক্যামেরুনও কী করে যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গোঁ-হারা হেরেও পৌঁছে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। অবশ্য এরপর আর এগোতে পারেনি।

তিন.
‘মারা খাইছে রে মারা খাইছে’, রফিক আংকেল চিৎকার করে উঠলেন। কলম্বিয়া আর ক্যামেরুনের ম্যাচ হচ্ছে। শেষ ষোলর ম্যাচ। বাঘে-মহিষে লড়াই। কেউ কারও জায়গা থেকে এক চুল নড়বার নয়। খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। ওহ, বলা হয়নি, ঝাঁকড়া চুলের একটু চঞ্চল স্বভাবের কারণে প্রথম ম্যাচ থেকে কলম্বিয়ার গোলকিপার হিগুইতা দৃষ্টি কেড়েছেন অনেকের। দল আক্রমণে গেলে তিনি গোলপোস্ট রেখে অবলীলায় চলে যান আক্রমণভাগে। অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ানোর মিনিট দশকের মধ্যে গোল দিয়ে বসে ক্যামেরুন। অস্থির হিগুইতা চুল উড়িয়ে ছুটে যান মাঝ মাঠে। এ নিয়ে সকলের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। এর মধ্যে তার পা থেকে ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে ছুট লাগান রজার মিলা। খালি গোলপোস্টে করে বসেন ইতিহাসের সহজতম গোলটি। কলম্বিয়ার সমর্থকদের মুখ শুকিয়ে চালকুমড়ো।
অহনাপু দুঃখে-অভিমানে টিভির সামনে থেকে উঠে চলে যায়। এবার রফিক আংকলের কপালে শনি হয়ে আবির্ভূত হন শাহাদৎ আর চপল ভাই।
‘বুড়া হইছেন বাতাসে, কথাবার্তা শিখেন নাই।’ চিৎকার দিয়ে ওঠে চপল ভাই।
পরদিন বিকেলে অহনাপুদের বাসায় মন্টু, শাহাদাৎ ও চপল ভাই বিকেল ও সন্ধ্যের বিভিন্নসময় হাজির হলেন অহনাপুকে সান্ত্বনা দিতে। এভাবে খেলার আড়ালে অহনাপুদের বাসায় মন্টু কিংবা শাহাদাৎ কিংবা চপল ভাইদের অবাধ বিচরণ শুরু হলো। বিকেলে প্রায়ই চায়ের কথা বলে কেউ না কেউ হাজির হয়। অহনাপু শর্ট কামিজ আর চোঙামার্কা সালোয়ার পরে আঙুলে ওড়না জড়াতে জড়াতে কথা বলে। টোস্ট বিস্কুটের সঙ্গে বাদামি রঙের চা আসে। সবাই এবারও আর্জেন্টিনার সামনে বিশ্বকাপ জয়ের পথ মসৃণ—এমন কথা বলে। বিভিন্ন রকমের সমীকরণ দেখিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে। অহনাপুর চোখের তারা দুটি জ্বলজ্বল করে। তার মাথার পেছনে ম্যারাডোনা বল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেন অহনাপু বললেই ছুটবে উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো।
শাহাদাৎ ভাই অহনাপুদের বাসায় যা-ই বলুন না কেন, ভুতুর দোকানের সামনে এসে ক্যামেরুনের গুণকীর্তনে মুখর হয়ে ওঠেন। কথায় কথায় বলেন, ‘ফুটবলের দুনিয়ায় সর্বহারার অবস্থান করে নিতে হবে। সে কাজ একমাত্র ক্যামেরুনই করতে পারে। পারে রজার মিলা।’
চপল ভাই মুচকি হাসেন, ‘সবখানে তোমার মার্ক্সিজম হান্দাইও না তো। কাইল্যাগুলার লাগি তোমার এত টান, তোমার বাপগো তো টান দেহি না। সোভিয়েত ইউনিয়ন তো ক্যামেরুনের বিপক্ষে গোউল করতে দ্বিধা করে নাই। গুইন্যা গুইন্যা এক হালি দিছে—’
আমরা দূরে বসে গল্প শুনি। মনে মনে ভাবি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা—এই দেশগুলো আসলে কোথায়। কতদূর। পাহাড়তলী স্টেশন ছুঁয়ে যে ট্রেনগুলো যায়, সেসব কি ওখানে যায়। নেপাল এক্সপ্রেস নামে একটা ট্রেন তখন চলত। আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা ব্রাজিল এক্সপ্রেস কেন নয়।
মোখলেছ কাকু এর সমাধান দিলেন, ‘ট্রেইনে...হ যাইতে পারবা। তবে পেলেইনে গেলে ভালো হয়। সময় একটু কম লাগব। ধরো তিন-চাইরটা দেশ পরেই আর্জেন্টিনা। হের পরেই ব্রাজিল।’
আমরা আরও উৎসুক হই। নিশ্চিত হতে চাই দেশগুলোর অবস্থান। মোখলেছ কাকু কথার চরকি ঘোরান, ‘এই ধরো, বাংলাদেশের পাশে ভারত। এইটা হিন্দু গো স্টেইট। এরপর আছে দুইটা মুসলমানগো স্টেইট। পাকিস্তান আর আরব। এরপর ধরো সব ইহুদি-নাসারাগো দেশ। ঢোকার মুখেই পাবা আর্জেন্টিনা। একটু পরেই ব্রাজিল। দেশ খুব একটা বড় না। লুকসইংখ্যাও কম...’
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। মহামানবের কল্লোলধ্বনি যেন বাজে দু-কানে।
এর মধ্যে একতা ক্লাবের এক আড্ডায় ফয়েজ ডাক্তার বলেই দিলেন ‘ম্যারাডোনারে আর সাপোর্ট করা যাইত না। হে ইন্টারভিউতে কইছে, বাংলাদেশের নাম হে কুনুদিন হুনে নাই। কি এস্পর্ধা...’
তখন একতা ক্লাবে পত্রিকা পড়ার জন্য দারুণ ভিড়। সবাই এই-ওই পত্রিকার বিশ্বকাপ সংখ্যা পড়ছে গোগ্রাসে। খেলার সময় সেই জ্ঞান ঝাড়তে হবে।
এর মধ্যেই শোনা গেল শাহাদাৎ ভাইয়ের সঙ্গে অহনাপুকে দেখা গেছে ডায়মন্ড হোটেলে। পাশাপাশি বসে কাটলেট খেতে।
উত্তেজনার ওপর উত্তেজনা। বিশ্বকাপ কার ঘরে যাবে, সেটা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জানা জরুরি অহনাপু কার গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেয়। একসঙ্গে কাটলেট খাওয়ার কাহিনি শুনে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে গেলেন, শাহাদাৎ ভাই তাহলে অহনা ট্রফিটা নিচ্ছে। কিন্তু যাঁদের বিশ্লেষণক্ষমতা ভালো, তাঁরা এত সহজে রায় দিতে নারাজ। তাঁদের মতে, এখনো অনেক ম্যাচ বাকি আছে।

চার.
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। শাহাদাৎ ভাইয়ের আর মস্কো যাওয়া হলো না। তিনি বুঝে গেছেন, মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। বড় স্বপ্ন দেখে আর লাভ নেই। অহনাপুদের বাসায় ঘুরঘুর করার চেয়ে পোস্টাপিসে গিয়ে চাকরির দরখাস্ত জমা দেওয়া তাঁর জন্য জরুরি হয়ে পড়ল। এদিকে নয় বছরের টানা শাসন শেষে দেশেও ঘটল পালাবদল। যাঁরা এত দিন পুলিশের ধাওয়ার ওপরে থাকতেন, তাঁরা এখন সরকারি লোক। অবশ্য তখনো কলোনির কোয়ার্টারগুলোর শিরোস্ত্রাণে শোভা পায় লাল, নীল, হলুদ পতাকা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রাষ্ট্রসংঘের সভা বসেছে এখানে। উপসাগরীয় যুদ্ধের একটা ফয়সালা হতে যাচ্ছে। দেয়ালে ফ্রান্স, ইতালি কিংবা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার জন্য শুভকামনা। যুদ্ধের চিহ্ন থাকলেও যুদ্ধ আর নেই। এখন ভেতরে-ভেতরে এক নতুন উদ্দীপনা। নতুন একটা সময়ের আগমনী গুঞ্জন চারদিকে। এখন আর কেউ দলবেঁধে কিছু করে না। অহনাপুদের বাসায়ও রাতে তেমন একটা লোকজন হয় না টিভি দেখার। রঙিন টিভি এখন ঘরে ঘরে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি নিয়ে শেষ গরম হয়ে উঠেছিল অহনাপুদের বাসা। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকানো যায়নি। লোকজন বুঝে গেছে বাকের ভাইদের পরিণতি। তাই দেয়াল তুলে যে যার কোয়ার্টারের সীমানা বুঝে নিয়েছে। কিনে নিয়েছে নতুন টিভি।
অহনাপুর মাস্টার্স হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। এক-দুটো সম্বন্ধ এলেই ও-এ নাকি ভাঙানি দেয়। মেয়ের পাড়াবেড়ানিয়া স্বভাব। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে হেসে হেসে। ভয়ংকর সব অভিযোগ। এ নিয়ে সামাদ আংকেলের টেনশনের শেষ নেই। চপল ভাই কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে কলোনি ছাড়া। বিয়েও করেছেন কোনো শিল্পপতির মেয়েকে। শাহাদাৎ ভাই টেলিফোন বোর্ডের চাকরি নিয়ে চলে গেছেন মাগুরা। থাকার মধ্যে আছেন মন্টু ভাই। খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়েছেন রেলওয়েতে। সকালবেলা ওয়ার্কশপের ঘাস পরিষ্কার করেন।
দেখতে দেখতে চারটি বছর চলে গেল। আবার এল বিশ্বকাপ। অহনাপুদের বাসায় আবার আসর জমল। তবে আগের মতো এত দর্শক নেই। আমাদের মতো সিঁকি-আধুলি কিছু।
শাহাদাৎ ভাই, চপল ভাই নেই। সমীরণ কাকা রিটায়ার্ডে গেলেও কলোনিতে আছেন। খেলার সময় হলে আসেন। অন্যরা কেউ আসেন না। তাঁদের সবার বাসায় রঙিন টিভি এসে গেছে। সঙ্গে কেব্‌ল টিভির কানেকশন। কেন জানি অহনাপুরা শুধু সংযোগ নেয়নি। তাই মন্টু ভাইয়ের গুরুত্ব রয়ে গেছে এ বাসায়।
অহনাপু এখন আর খেলা দেখে কাঁদে না। মুখের রেখাগুলো কেমন শক্ত শক্ত হয়ে গেছে। খেলা দেখতে দেখতে আড়চোখে তাকে আমি দেখি। ম্যারাডোনাকে নিয়ে তার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। প্রতিটি ম্যাচ যায় নিস্তরঙ্গ প্রবাহের মতো।
শুধু ক্যামেরুনের যেদিন খেলা হয়, সেদিন দু-একটা কথা বলতে শোনা যায় অহনাপুকে।
‘লোকটা এ বয়সেও কী ক্ষিপ্র! একেই বলে জাতির প্রতি কমিটমেন্ট।’
‘কোন লোকটা?’ আলটপকা প্রশ্নটা করেই ফেলি আমি।
‘ওই যে তোর শাহাদাৎ ভাইয়ের রাজা। রজার মিলা।’
‘কিন্তু একা ত কিছু হয় না আপু।’
‘চেষ্টা করতে ক্ষতি কী!’
চেষ্টা তেমন কাজ দিল না। ২১ জন মানুষের বিপক্ষে একা পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেন রাজা। ক্যামেরুনের দশ জোড়া লোহার মতো পা গলিয়ে ছয়-ছয়টা গোল করল রাশিয়া।

পাঁচ.
শাহাদাৎ ভাই তিনতলা বাড়ি তুলছেন আকবর শাহ এলাকায়। চপল ভাইয়ের তদবিরে নন্দনকানন বদলি হয়ে এসেছেন। বাড়ির কাজ দেখভাল করার জন্য প্রায় এদিকটায় আসেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলে সেই পুরোনো আড্ডা জমে ভুতুর দোকানে। খেলা ক্লাব ফাংশন—এসব এখন আর আলোচনায় আসে না। আলোচনার বিষয় কোন অফিসে কে আছে। কোথায় লগ্নি করলে লাভের অঙ্কটা বড়। বাজেটে কোন জিনিসটার দাম বাড়ছে। ইত্যাদি। পুরোনোদের মধ্যে আছে শুধু মন্টু ভাই। সে-ও যাই যাই করে। কুয়েতের একটা ভিসার অপেক্ষায় আছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর নতুন করে লোক নিচ্ছে কুয়েত। অহনাপু এখন একটা এনজিওতে কাজ নিয়েছেন। খেলাঘর-এর বাদল ভাইয়ের এনজিও। সন্ধ্যায় রিকশা থেকে নেমে মাথা গুঁজে চলে যান দোকানের সামনে দিয়ে। কেউ কাউকে চেনে না এমন একটা ভাব। তবে অহনাপুকে দেখলে কেন জানি শাহাদাৎ ভাইয়ের কথার খাতার পাতাগুলো উল্টে যায়। শুরু হয় নতুন নতুন গল্প। তাঁর উঠতি বাড়ির কয়েকটা রুম মোজাইক হচ্ছে। মোজাইকের রংই বা কি। ভুতুর দোকানে বসে তিনি গেলকবার ভাবিকে নিয়ে নেপাল যাওয়ার গল্প করেন রসিয়ে রসিয়ে।
অহনাপু মাথা নিচু করে চলে যান। তবুও দু-একটা গল্প তাকে ছররার মতো বিদ্ধ করে কিনা জানা নেই।
আমার চোখে ভাসে এক রজার মিলা। একটার পর একটা গোল খেয়ে যাচ্ছে। গোল শোধবার আর কোনো চেষ্টা নেই, কেবল আত্মরক্ষার আয়োজন। অথচ আমরা সবাই চাইছি, একবার হিগুইতার পা থেকে বলটা কেড়ে নিয়ে ছুটুক অহনাপু। সবাই কত দূর দূর চলে গেছে। অহনাপু কেন পড়ে থাকবেন খালি মাঠে? সবার উপহাসের পাত্র হয়ে।
একদিন অহনাপু ঠিক ঠিকই আমাদের কথা শুনে পাল্টে যায়। সেদিন অহনাপু বাসায় ফেরে হলুদ-কালো ট্যাক্সিতে। তারপর আর সন্ধ্যা করে ফেরে না। কারণ বাসায়ই থাকে সারা দিন। পাড়ায় শুরু হয় কানাঘুষা। কোনো এক আন্টি বলেই বসে, ‘খারাপ স্বভাবের মেয়ে তো, যা ভেবেছিলাম তাই—’
‘হুম, পেটটা দেখছ না, ডিয়ার বল হইয়া রইছে।’
ডিয়ার বলঅলা পেটটা আর দেখা হয় না। মাস দু-এক রোগে ভুগে দিব্যি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে চলে যায় ডিবক্সে। রোগটা অনির্ণীতই রয়ে যায়। কেউ বলে লিভার পচে গিয়েছিল। কারও ধারণা, কিডনি। আমি বললাম, যাক, শেষ গোলেই জিতে গেলেন অহনাপু!