সিজনাল ফুটবল দর্শক

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

সাধারণত তিনটা পরিস্থিতিতে আমি ফুটবল খেলা দেখি। প্রথমত, বিশ্বকাপের সময়। দ্বিতীয়ত, যখন ইউরো টুর্নামেন্ট চলে আর তৃতীয়ত, যখন টিভিতে দেখার কিছু থাকে না (এমনকি ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটও না)। ফলে ‘সিজনাল ফুটবল সমর্থক’-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমি—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন বিশ্বকাপ চলছে। সিজন এলে বাজারে যেমন আম-লিচুর সমাহার দেখা যায়, তেমনি চারপাশে দেখা যাচ্ছে আমার মতো বিপুলসংখ্যক সিজনাল ফুটবল দর্শকের উপস্থিতি। সবার মধ্যেই নিজেকে একজন ‘নিয়মিত ফুটবল দর্শক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা। ‘আরে ভাই, আমি কি দুই দিনের ফুটবল দর্শক? বহুত আগে থেকে ফুটবল দেখি ভাই। আমাকে শিখাইতে আইসেন না’—এই ধরনের বাণী দিয়ে অনেকেই বুঝিয়ে দেন, ফুটবল তাঁরা ভালোই বোঝেন। তাঁদের শেখানোর কিছু নেই (আমিও ব্যতিক্রম নই)। আসলে আমাদের অন্য কোনো কিছুতে আপত্তি না থাকলেও শেখার ব্যাপারে বেশ আপত্তি আছে। কারও কাছ থেকে কিছু শেখাকে আমরা সহজভাবে নিতেই পারি না। যেকোনো তর্কের একপর্যায়ে আমরা বলবই, ‘এত দিন ধরে এই লাইনে আছি, এখন এসে আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে?’ এমনকি বাসের হেলপারের সঙ্গে তর্ক হলেও আমরা উত্তেজিত গলায় বলব, ‘ওই ব্যাটা, আমারে ভাড়া শিখাস?’
ফলে আমার মতো একজন সিজনাল দর্শক যখন অফিসের বসকে ফুটবল বিষয়ে কিছু বলতে গেলাম, স্বাভাবিকভাবেই তিনি ব্যাপারটা নিতে পারলেন না (অবশ্য বসেরা কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না)। আমাদের বস আর্জেন্টিনার সমর্থক (উনি যে কাউকে সমর্থন করতে পারেন—এটাতেই বেশ অবাক হয়েছিলাম আমি। কোনোদিন দেখিনি কর্মীদের কোনো কিছু সমর্থন করেছেন বস)। ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে যাওয়ার পর বসকে বললাম, ‘এই দল নিয়ে ওরা বেশি দূর যেতে পারবে না স্যার। মেসি একা আর কী করবে বলুন?’ ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বস বললেন, ‘মেসিই তো যত সমস্যা। ওর জায়গায় ম্যারাডোনা থাকলে এই দলকেই চ্যাম্পিয়ন করে ফেলত।’
‘কিন্তু স্যার, দুজন তো দুই পজিশনের খেলোয়াড়। ম্যারাডোনা ছিল মিডফিল্ডার, আর মেসি ফরোয়ার্ড। মিডফিল্ড থেকে বল না আসলে ও একা কী করবে?’
‘দেখেন, এসব আমাকে শেখানোর চেষ্টা কইরেন না। এই মিডফিল্ডার-ফরোয়ার্ড—সব একই। এগুলো কোনো ব্যাপার না। কেন, আমরা কি খেলি নাই? গোলকিপারও থেকেছি আবার স্ট্রাইকেও খেলেছি। আরে ভাই, মিডফিল্ড থেকে বল না আসলে তুই নেমে গিয়ে বল নিয়ে আয়। কেউ মানা করেছে? যা হোক, আপনার অ্যাটেনডেন্স রিপোর্ট তো ভালো না। ৭ দিনের মধ্যে ৫ দিনই লেট। ব্যাপার কী?’
‘একটু লেট হচ্ছে স্যার। আসলে রাতে খেলা দেখে...’
‘খেলাটেলার জন্য অফিস হেলাফেলা করলে চলবে নাকি? সকালে উঠে গোলগুলো নেটে দেখে নেবেন, তাহলেই তো হয়। এরপর থেকে লেট অ্যালাও করব না আমি।’
‘স্যার...’
‘নিজের কাজে যান। গো টু ইয়োর ওয়ার্ক।’
এই হলো সমস্যা। আমার ধারণা, অফিসের বস আসলে ফুটবলের রেফারির মতো। রেফারিকে যতই বোঝান, তিনি কোনো কথা শুনবেন না। নিজে যেটাকে ঠিক ভেবেছেন, ভুল হলেও সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। আবহমানকাল ধরে অফিসের বসেরাও তাই করে আসছেন। বসের সিদ্ধান্ত রিভিউয়ের জন্য একটা ভিএআর টিম থাকলে ভালো হতো।
মনটা আর্জেন্টিনার ডিফেন্সের চেয়েও খারাপ হয়ে গেল। ডেস্কে ফিরে এসে দেখি, সহকর্মী মোবাইলে খেলার হাইলাইটস দেখছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বসের কাছে যাওয়ার আগে একটু হাইলাইটস দেখে নিচ্ছি। রাত জেগে খেলা দেখার শখ নেই আমার। কিন্তু আলোচনায় অংশ না নিলেও তো স্ট্যাটাসটা থাকে না, তাই না?’
‘অবশ্যই। ‘
‘আমাদের বস, সে-ও কিন্তু রাতের খেলা দেখেন না। সকালে হাইলাইটস দেখে আসেন। রাত জেগে খেলা দেখলে চোখের নিচে কালি পড়ে যেত। আপনার যেমন পড়েছে।’
‘আমাদের বস এমনিতেই বেশ কালো। চোখের নিচে কালি পড়লে আলাদা করে বোঝার কথা না।’
‘হে হে হে, ফানি। কিন্তু ভাই, সেদিন খেলার মধ্যে রেফারি হঠাৎ দৌড় দিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? টয়লেট ম্যাটার নাকি?’
‘রেফারি একটা ডিসিশন কী দেবেন বুঝতে পারছিলেন না। তাই জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলেন।’
‘কাকে?’
‘তাঁর বউকে। বউয়ের ডিসিশন ছাড়া আপনি কোনো কাজ করেন? করেন না। রেফারিও ওই রকম। তাঁর জানের মায়া আছে।’
‘ও, আচ্ছা ভাই। যাই, বসকে ফেসটা দেখিয়ে আসি। খেলার ছুতায় আজকাল লেট হচ্ছে, কিন্তু বস এত ভালো। কিছুই বলছেন না। বিগ হার্ট ম্যান। হে হে হে।’
আমার মনে হলো, এ জন্যই ফুটবলাররা অযথাই পড়ে ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ডানে-বামে গড়াগড়ি দিতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি ফুঁ দেয়, ফাউল। ফ্রি-কিক, হলুদ কার্ড, লাল কার্ড। আসলেই ফাউল হয়েছে কি না তা কেউ খতিয়ে দেখবে না। দুনিয়াটাই এমন। আপনি কাজ করবেন, কেউ পাত্তা দেবে না। কিন্তু কাজ দেখাবেন, তাহলে সেরা কর্মীর তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে আপনার নাম। দেখানোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সফলতার চাবিকাঠি।
আমিও কয়েক দিন লুকিয়ে রাখলাম আমার সিজনাল ফুটবলপ্রেম। রাত জেগে খেলা না দেখে সময়মতো অফিসে এলাম। একদিন খুব খোশমেজাজে আমার ডেস্কে এসে বস বললেন—
‘কী, দেখেছেন কালকের ম্যাচ? কী খেলল! ওহ, মেসি! হোয়াট এ গেম!’
‘কালকের ম্যাচটা দেখা হয়নি স্যার, আসলে রাত জেগে খেলা দেখলে পরে অফিসে আসতে লেট হয়ে যায়।’
‘আরে এক-দুই দিন লেট হলে কিছু হয় না। মিস করলেন। আমরা তো সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেলাম। চ্যাম্পিয়নও হবো। কী বলেন?’
আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে সহকর্মী যেভাবে ‘জি স্যার, জি স্যার’ বলে উঠলেন, তাতে আমার আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না।
কিন্তু দুদিন পর অফিসে এসে দেখি পুরো অফিসের চেহারা বদলে গেছে। সবাই কেমন যেন চুপচাপ। শুনলাম, বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন বস। কারণ, এতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। স্বাভাবিক। আর্জেন্টিনা বিদায় নিয়েছে, এখন আলোচনা করলে তো কর্মঘণ্টা নষ্ট হবেই। চাকরিও চলে যেতে পারে। বসের দল শেষ, অফিসের সবার বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতিও শেষ।
কিছুক্ষণ পর বস ডেকে পাঠালেন আমাকে। গত কয়েক দিনে আমার করা কাজগুলো যে কিছুই হয়নি, আমি যে দিন দিন কাজের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছি—এসব নিয়ে বেশ কড়া লেকচারও দিলেন। সেই সঙ্গে দিলেন নতুন কিছু কাজ, যেগুলো করতে আমার আরও এক সপ্তাহ লাগবে। সব শেষে বললেন, ‘দেখুন, আমার দল হারায় আপনি ফেসবুকে খুব উল্লাস প্রকাশ করেছেন, করতেই পারেন। বিষয়টাকে আমি বেশ সহজভাবে নিয়েছি। আসলে এটাই তো বিশ্বকাপের মজা। হা হা হা।’
আমি বিস্মিত হলাম। কারণ, ফেসবুক পোস্টের কথা বসের জানার কথা না। তিনি তো আমার ফ্রেন্ডলিস্টেই নেই। অনেক আগেই তাঁকে ব্লক করে রেখেছি। নিজের ডেস্কে ফিরে সহকর্মীকে বললাম, ‘ভাই, আমার পোস্টটার খুব প্রশংসা করলেন বস। আমি তো অবাক। খুব ভালো লাগছে। বসের মতো মানুষ হয় না। বিগ হার্ট ম্যান। পোস্টের কথা কি বসকে আপনি বলেছিলেন?’
‘ইয়ে...হ্যাঁ...মানে বলেছিলাম আরকি, আপনি একটা মজার লেখা লিখেছেন...হে হে...তেমন কিছু না।’
সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে ফুটবল ব্যর্থতার কারণটা ধরে ফেললাম আমি। আমাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বভাব আছে। বল নিয়ে খুব ভালোভাবে যদি আমরা গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাই, আমাদের রাফ ট্যাকল করা হবে। আর ট্যাকলটা করবে আমাদের দলেরই কোনো সদস্য। তাই সব ক্ষেত্রে আমরা এক হয়ে গোল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। আর এ জন্যই তিনটা পরিস্থিতি ছাড়া আমিও ফুটবল খেলা দেখি না।