প্রমথ চৌধুরী: মূল্যায়নে ঘাটতি ও ত্রুটি

১০ আগস্ট ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীকে নিয়ে কুদরত-ই-হুদার লেখা ‘সবুজপত্রের সবুজ “বীরবল”’ শিরোনামের প্রবন্ধটি আমার নজরে পড়েছে। লেখার শিরোনাম এবং প্রসঙ্গের অবতারণা থেকে আশা করা গিয়েছিল, সবুজপত্র পত্রিকার সূত্র ধরে লিখিত বাংলায় প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব ও এর পূর্বাপর জ্ঞাত হয়ে প্রাবন্ধিক আলোচনা করবেন।

প্রথমেই মাথায় রাখা দরকার, সাধুগদ্য মানেই সাধু নয়, আর চলিতগদ্য মানেই মুখের ভাষা নয়। উনিশ শতকের শুরুতে ‘হাতুড়ি-বাটালের পিটুনিতে’ গড়ে ওঠা গদ্য সবুজপত্রের অনেক আগেই ‘অনুস্বারবাদী’দের প্রভাবমুক্ত হতে পেরেছিল। সুতরাং একজন প্রমথ চৌধুরী ছাড়াও বাংলা লিখিত গদ্যের বদল অবশ্যম্ভাবী ছিল। আর লিখিত গদ্য মুখের গদ্য থেকে সব সময়ই আলাদা হবে। কারণ, ভাষায় দ্বিবাচন পরিস্থিতির উদ্ভব স্বাভাবিক। প্রমথ আসলে সাধু ও চলিতকে দুটি আলাদা ভাষা ধরে এদের সম্পর্ককে বিবর্তনমূলক করে তুলতে চেয়েছেন। এই প্রতিস্থাপনের কাজ করতে গিয়ে তিনি শ্রেষ্ঠজ্ঞান করে বেছে নিয়েছেন ‘দক্ষিণদেশি’ ভাষাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো ভাষাবৈজ্ঞানিক যুক্তিশৃঙ্খলা কাজ করেনি। মুখের ভাষাকে লেখার ভাষা করতে চাইলেন তিনি; অথচ অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে তা কৃত্রিম হয়েই রয়ে গেল। প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখায় যথার্থ প্রমথ-মূল্যায়ন হয়নি। নজরে আনতে চাই, সবুজপত্রেও সাধুরীতিতে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, সেখানে আরও কেউ কেউ লিখেছেন; কিন্তু পত্রিকার সংখ্যাগুলো উল্টিয়ে দেখুন, এর লেখক মানে রবীন্দ্রনাথ আর নামে-বেনামে চৌধুরী নিজে। পত্রিকার প্রথম বছরে প্রকাশিত ১২টি সংখ্যার ৭০টি লেখার মধ্যে এ দুজনের লেখাই ৫৫টি!

প্রবন্ধকার লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মাত্র সাত বছরের ছোট প্রমথ চৌধুরী।...রুচি, চিন্তা, দ্রোহ ইত্যাদিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ।’ কথাটি উল্টিয়ে দিলে বরং আপত্তি কম থাকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ কর্ম ও সাহিত্যজীবনে পুনঃপুনঃ রূপান্তরিত হয়েছেন—ভাবনায় ও লেখায়; বিদ্ধ ও ঋদ্ধ হয়েছেন সমকালীন প্রসঙ্গে; রুচি, চিন্তায়, এমনকি ‘দ্রোহে’ও প্রাগ্রসর ছিলেন অনেকের চেয়ে। রবীন্দ্রনাথের কর্ম, দর্শন এবং যেকোনো ধরনের লেখা দিয়ে তা প্রমাণ করা যাবে। আবার, জীবনের শেষ প্রান্তে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ তো বটেই, জীবনের বিভিন্ন পর্বে লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ দিয়ে এটাও প্রমাণ করা যাবে, রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে ‘হৃদয়বাদী’ ও ‘বুদ্ধিবাদী’। অন্যদিকে ‘বর্ষার কথা’, ‘রূপের কথা’সহ প্রমথ-লিখিত প্রচুর প্রবন্ধ দিয়ে দেখানো যাবে, তিনি ‘হৃদয়বাদী’ও বটে। সুতরাং ‘এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথও তাঁর সঙ্গে তুলনীয় নন’—প্রাবন্ধিকের এ কথা ঠিক নয়। সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোকিছু মূল্যায়নের পক্ষপাতী নই আমরা। তাহলে তো এটাও বলা যেতে পারে: ‘প্রাগ্রসর’ প্রমথ কতটা সেকেলে—এটা তাঁর কবিতা দেখেই অনুমান করা যায়! আবার, ইন্দিরা (প্রাবন্ধিক যাঁকে বলেছেন রবীন্দ্রনাথের বড় ভাইয়ের মেয়ে, আসলে তা হবে মেজো ভাই), প্রমথ আর রবীন্দ্রনাথ পারস্পরিক সম্পর্ক বা বয়স—যেকোনো অর্থেই সমপ্রজন্মের। প্রজন্মান্তর ঘটতে অন্তত দুই যুগের ব্যবধান লাগে, পাঁচ-সাত বা বারো বছর নয়। আর পত্রিকায় এ ধরনের লেখার ক্ষেত্রে সূত্র ও পৃষ্ঠার উল্লেখ জরুরি নয়; তা করতে গেলে গ্রন্থের প্রকাশক কিংবা অন্তত প্রকাশসাল উল্লেখ করা জরুরি।

তারিক মনজুর

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।