অক্তাবিও পাজের পাপমোচন

অক্তাবিও পাজ [৩১ মার্চ ১৯১৪-১৯ এপ্রিল ১৯৯৮], অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অক্তাবিও পাজ [৩১ মার্চ ১৯১৪-১৯ এপ্রিল ১৯৯৮], অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই ৩১ মার্চ ছিল কবি অক্তাবিও পাজের জন্মশতবর্ষের মূল দিনটি। ওদিন থেকে শুরু করে পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে এ উপলক্ষে চলছে নানা আয়োজন। এ ছাড়া ইউরোপ, দুই আমেরিকা, এশিয়ার টোকিও ও নিউ দিল্লিতে এপ্রিল মাসজুড়ে চলবে নানা সম্মেলন, ডাকটিকিট উন্মোচন, কবিতাপাঠ ইত্যাদি। নিজের দেশ মেহিকোতে স্কুলে স্কুলে বিতরণ করা হচ্ছে তাঁর কবিতার বই। ওখানে সাহিত্যে দুই নোবেল বিজয়ীর উপস্থিতিতে শুরু হয়েছে এক গ্র্যান্ড সাহিত্য সম্মেলন। চেক রিপাবলিকের কাফকা সোসাইটি ১২ এপ্রিল আয়োজন করেছে অক্তাবিও পাজ উৎসবের, যেখানে মূল বক্তা মিলান কুন্ডেরা ও নোবেলজয়ী মারিও ভার্গাস য়োসা। নিউ ইয়র্কার পত্রিকা জানাচ্ছে, মেহিকোর রাজধানীর সিনেট বিল্ডিংয়ের বাইরের প্রধান প্লাজায় চলছে তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলোর পাবলিক রিডিং।
আমরা কল্পনায় ভেবে নিতে পারি, পাজের শহর মেহিকো সিটির আকাশে-বাতাসে ভাসছে মেগাফোনের ভরাট আওয়াজ—শুনছি যেন তাঁর সেই অমর কবিতা ‘লাস্ট ডন’: ‘অরণ্যে হারিয়ে গেছে তোমার চুল গোছা,/ তোমার দুই পা ছুঁলো আমার দুই পা-কে।/ ঘুমন্ত তুমি যে রাত্রির থেকে বড়,/ তবে তোমার স্বপ্ন এ-ঘরের আয়তনে খাটে।/ কীই বা আমরা আর, যারা কিনা এতখানি ছোট!/ বাইরে এক ট্যাক্সি চলে যায়/ তা যে ভূত-আত্মা এসবে বোঝাই।/ পাশ দিয়ে ছোটে যেই নদী/ সর্বদাই তা যে/ পেছন দিকে ছোটে।/ আগামীকাল দিনটা কি অন্য রকম কোনো দিন হবে?’
পাজকে নিয়ে এই উন্মাদনার কারণ চারটি। প্রথম, পাজ তাঁর গদ্যে মেহিকোর মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি যে স্বচ্ছতায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে করে তিনি হয়ে গেছেন এ জাতির আয়না। দ্বিতীয়, তিনি ছিলেন আঞ্চলিক সীমানা ছাড়ানো সত্যিকারের এক আন্তর্জাতিক মেধা। তৃতীয়, মেহিকোর একনায়কতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পাজ ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ এক বহুত্ববাদী, বাক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সপক্ষে সদা সরব। চতুর্থ, ড্রয়িংরুম-চিন্তকদের বিপরীতে তিনি ছিলেন সাহসী এক মানুষ। আর শেষে অবশ্যই আছে তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির বিষয়টি।
তবে এ উদ্যাপন যে একদম নিষ্কলুষ সর্বজনীন, তা বলা যাবে না। পাজ জীবনব্যাপী বৃদ্ধিবৃত্তিক যে লড়াই করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতির ওপর ভর করে সে লড়াই আজও চলছে। পাজের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ওই সময়ে জন্ম নেওয়া অন্য অনেক লেখকের মতোই তাঁর নির্মাণের ছাঁচটি পরবর্তীকালের বড় কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা দিয়ে গড়া: রুশ বিপ্লব, ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, স্তালিনের গুলাগ। ১৯৩৭ সালে তিনি স্পেনে গেলেন রিপাবলিকানদের পক্ষে ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে লড়বেন বলে। সেই মানুষই পরে স্তালিনের ওপর শ্রদ্ধা হারালেন, কিউবার বিপ্লব থেকেও দূরে রাখলেন নিজেকে। যদিও এই ১৯৬৭ সালেও পাজ লিখলেন, মার্ক্সবাদই ‘আমাদের পয়েন্ট অব ভিউ’। কিন্তু ১৯৭৪ সালে, বয়স যখন তাঁর ষাট ছুঁয়েছে, সলেঝনিৎসিনের গুলাগ আর্কিপেলাগো পড়ে তাঁর মধ্যে আলোকপ্রাপ্তির একটা ব্যাপার ঘটে গেল যেন। তিনি লিখলেন, ‘আমরা এখন জানি, ওই যে দ্যুতিটাকে নতুন ভোর বলে মনে হতো আমাদের, তা ছিল রক্তে-চুবচুব এক শবদাহের চিতা...এ বিষয়ে আমাদের ভুলগুলোকে স্রেফ ভুল বললে চলবে না...এ (বামপন্থায় বিশ্বাস) ছিল পাপ...এই পাপ আমাদেরকে কলঙ্কের দাগ দিয়ে গেছে, আমাদের লেখাগুলোও মারাত্মকভাবে সেই দাগে ভরিয়েছে।’ তাঁর জীবনের পরবর্তী ২৪টি বছর কাটল এই ‘পাপ’ থেকে মুক্ত হওয়ারই প্রয়াসে।
কবিতায় অবশ্য পাজ রোমান্টিক উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বস্তই ছিলেন। পাবলো নেরুদার মতো বিশ্বাস করতেন, কবিতা দিয়ে দুনিয়া বদলে দেওয়া সম্ভব। লিখেছেন গদ্যগ্রন্থ দ্য ল্যাবিরিন্থ অব সলিচুড (১৯৫০)। লাতিন আমেরিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে আজও সম্ভবত অন্য যেকোনো বইয়ের আগে অবশ্যপাঠ্য এই বইটি। এর মধ্যেই ধরা আছে তাঁর কবিসত্তারও মূল সার: নানা কিছুর বৈপরীত্য—একদিকে মৃত্যু নিয়ে মুগ্ধতা, অন্যদিকে ফিয়েস্তা বা নাচ-গান-হইচইয়ের প্রতি বংশপরম্পরার টান; এক পাশে জয়ের ইচ্ছা, অন্য পাশে নিয়ত এই ভয় যে অনন্তকাল আমরা হারতেই থাকব; ইন্ডিয়ান আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতি মোহ, অন্যদিকে হিস্পানি ঔপনিবেশিক শাসক ও ক্যাথলিক ঐতিহ্যের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম; পশ্চিমা লিবারলিজমই শুদ্ধতম রাজনৈতিক আদর্শ—এই বোধ, অন্যদিকে মেহিকান হিসেবে কট্টর জাতীয়তাবাদী চেতনার ও বিপ্লবী কমিটমেন্টের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি।
নোবেলজয়ী কবি চেশোয়াভ মিউশ বলেছিলেন, ‘অনেক কবিই আছে পৃথিবীতে, কিন্তু নেরুদা ও পাজের মতো জনপ্রিয় কবি কয়জন?’ সত্যি, তিনি এমন এক কবি যাঁর কবিতা চূড়ান্ত দার্শনিক গূঢ় চিন্তায় ভরপুর, কিন্তু একই সঙ্গে তরবারির ঝলকের মতো স্বচ্ছ; অসংখ্য মিথে ভর্তি, কিন্তু এরই সমান্তরালে আধুনিক মানুষের সব কামনা-বাসনা-কৌতূহলে দীর্ণ। সাধারণ হিসেবে পাজকে বলা হয় পরাবাস্তববাদী কবি। কিন্তু তাঁর কবিতায় পরাবাস্তবতাবাদী চিন্তার অনাবিল ডানা মেলার সঙ্গে মিশেছে ভারতীয় সংস্কৃতির হাজারো রং—হিন্দু দ্বৈতবাদ ও তান্ত্রিক চেতনা, যেখানে ভালো ও মন্দ, বিষ্ঠা ও মধু, বাম ও ডান, নারী ও পুরুষ, প্রেম ও ঘৃণা এক পাতেই থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর দূরপ্রাচ্য-প্রেম—জাপানি ও চীনা সংস্কৃতি এবং গৌতম বুদ্ধের দীক্ষা। চিরকালই তিনি মানতেন যে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারে ভরা মেহিকোকে বদলানোর রাস্তা একটিই—বিপ্লব। তবে পাজ রক্তের পথ ধরে বিপ্লব চাননি কখনোই, বরং বেনারসের মন্দিরে ঘণ্টা বাজা গাঢ় সন্ধ্যা তাঁকে মহাত্মা গান্ধীর ঢঙে অহিংস বিপ্লবেরই দীক্ষা দিয়েছিল। এই দীক্ষা থেকেই তিনি হঠাৎ মোড় ঘুরলেন জীবনের শেষ পাদে এসে। কম্যুনিজমের মিথ্যাচার ও গণহত্যার হিসাব কষে অতঃপর তিনি পুনর্মূল্যায়ন করলেন গণতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাসের, আলিঙ্গন করলেন সোশ্যাল ডেমোক্রেসিকে।
অতএব, পাজকে বলা হলো ‘প্রতিক্রিয়াশীল; এবং তাঁর ‘পাপমোচন’-এর প্রয়াসকে ‘চরিত্রহীনতা’। কিন্তু এসবে ঘাবড়ে যাননি তিনি। যা বিশ্বাস করেন তাঁর সপক্ষে তিনি লিখে চললেন অবিরাম। কারণ, ব্যাপারটিকে তিনি নিয়েছিলেন ‘ভুল শোধ’ হিসেবেই।
অক্তাবিও পাজের মতো নামকরা ‘দলত্যাগী’ মানুষটির জন্মশতবর্ষ যে নানা বিতর্ক, নানা পুষ্প আর আগুন নিয়েই হাজির হবে, তা বলা বাহুল্য। তবে মেহিকোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট এনরিকে পেনা নিয়েতোর রাজনৈতিক দলটির অন্যায়ের প্রতিবাদে যে পাজ চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তাঁরই জন্মশতবর্ষে যখন সেই প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘পাজ আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বজনীন...শতাব্দীর সবচেয়ে স্বচ্ছ, সম্পূর্ণ ও উজ্জ্বল মেহিকান মাথা তিনি...আমাদের সবচেয়ে শুদ্ধ বিবেক’, তখন অনুমান করতে ইচ্ছে হয় যে সময়ের পরিক্রমায় অক্তাবিও পাজ নামের আমাদের এই প্রিয় কবির স্মৃতির প্রতি বন্দুক তাক করে থাকা মানুষের সংখ্যা অবশ্যই অনেক কমে এসেছে।