আরও ১৪ জেলায় বন্যার শঙ্কা

নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন আবদুল্লাহ। বর্ণি এলাকা, কোম্পানীগঞ্জ
ছবি: প্রথম আলো

সিলেট বিভাগে বন্যার বিপদ বরং বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলেও বন্যার তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ১৪টি জেলায়ও বন্যা হতে পারে। পদ্মা নদীর পানি বেড়ে একই সময়ে দেশের মধ্যাঞ্চলের চারটি জেলায় বন্যা শুরু হতে পারে। দেশের তিন এলাকার ওই বন্যা আরও ৭ থেকে ১০ দিন ধরে থাকতে পারে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাসে এমন সব আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগামী দুই দিনের মধ্যে দেশের উজানে ভারতের মেঘালয়, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভারী বৃষ্টি আরও বাড়তে পারে। এরই মধ্যে শুরু হওয়া বৃষ্টির কারণে উজানের নদ–নদীগুলোর পানি বাড়ছে। নতুন করে বৃষ্টি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে পদ্মার মূল নদী গঙ্গার উজানে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তা আরও বাড়তে পারে। ফলে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর ও ফরিদপুরে নিম্নাঞ্চলে বন্যা শুরু হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, একই সময়ে দেশের প্রধান দুটি নদী অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি বাড়ছে। সেই সঙ্গে তিস্তার পানিও এরই মধ্যে বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে সব মিলিয়ে এবার দেশে মাঝারি বন্যা হতে পারে। ৭ থেকে ১০ দিন দেশের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এলাকা বন্যায় ডুবে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কুড়িগ্রাম দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করে তা আরও সামনে এগিয়ে আসছে। ফলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে। আর তিস্তা অববাহিকার কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুরে বন্যা শুরু হতে পারে।

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কে বইছে ঢলের পানি। গবাদীপশু নিয়ে নিরাপদ স্থানে দিকে যাচ্ছেন মানুষজন। মিত্রীমহল এলাকা, গোয়াইনঘাট
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটে বন্যা রেকর্ড ভেঙেছে

সিলেট বিভাগে চলমান বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি তিন জেলার শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই–তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।

প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। আর সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

আরও পড়ুন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিইউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার বাংলাদেশের উজানে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে; যা ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা মানুষ। সালুটিকর এলাকা, গোয়াইনঘাট
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় কৃষিকাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে।

দুর্ভোগে মানুষ

আকস্মিক বন্যায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা। শুক্রবার সিলেটের বানভাসি মানুষেরা জানিয়েছেন, পানি শুধু বাড়ছেই। তাই ঘরে কেউই নিরাপদ বোধ করছেন না। এ অবস্থায় অনেকে হন্যে হয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। অনেকে নৌকার অভাবে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ঘরে মাচা বেঁধে কোনো রকমে আছেন। কেউ কেউ দিনের বেলা ঘরের চালেও আশ্রয় নিয়েছেন। পরে অবশ্য নৌকাযোগে তাঁরা চাল ছেড়ে বিভিন্ন উঁচু এলাকায় ঠাঁই নিয়েছেন।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার এলাকায় কথা হয় আমেনা বেগমের সঙ্গে। ছয় বছরের নাতিকে কোলে নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর ডুবে যাওয়া ঘরের দিকে। তখন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি নিজের ঘর প্লাবিত হওয়ার কথা বলতে বলতে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর কেবল চোখ মোছেন। বৃষ্টির পানির সঙ্গে তাঁর গাল বেয়ে পড়া কান্নার রেখাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

মিনিট দশেক পর আমেনা বলেন, ‘সব শেষ অই গেছে। ঘর ডুবি গেছে! জিনিসপত্র ভাসি গেছে। কী খাইমু, কই থাকমু?’ এরপর আর কোনো কথাই বলতে পারেননি তিনি। বার কয়েক হাহাকার–সূচক শব্দ উচ্চারণ করে তিনি ডুবে থাকা সড়ক ঠাওর করে হাঁটতে থাকেন সামনের দিকে।

সিলেটে আবারও পাহাড়ি ঢলের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘর–বাড়ি। পানিবন্দী বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বাসিন্দারা। মিত্রীমহল এলাকা, গোয়াইনঘাট
ছবি: প্রথম আলো

সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের যে স্থানে দাঁড়িয়ে আমেনার সঙ্গে কথা হয়, তখন সেখানে ছিল হাঁটুপানি। এ রাস্তা ধরে আমেনার মতো অনেককেই দিনভর হেঁটে হেঁটে সিলেট শহরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রওনা হতে দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। তাই টুকেরবাজার ও আশপাশের অন্তত ১০টি বন্যাকবলিত গ্রামের কয়েক শ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে হেঁটেই সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা হন। বৃষ্টিতে ভিজে নারী, পুরুষ ও বয়স্ক ব্যক্তিরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অনেকের কোলে ছিল বিভিন্ন বয়সী শিশু। কারও কারও মাথায় ছিল বস্তা আর কাপড়ের পোঁটলা। কেউ কেউ গবাদিপশু নিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজে পানিতে হাঁটতে হাঁটতে শীতে কাঁপছিলেন কেউ কেউ।

জাঙ্গাইল গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী হায়দার রুবেল (৪১) জানান, তাঁদের ঘরে এক দিনের ব্যবধানে কোমরপানি দেখা দিয়েছে। ফলে পরিবারের ১৫ সদস্যের সবাইকে নিয়ে সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সড়ক ডুবে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় হেঁটেই রওনা হয়েছেন। তবে সঙ্গে ছোট বাচ্চারা থাকায় ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে হাঁটছেন। সকাল সাতটায় সদর উপজেলার জাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়ে আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের পথ টুকেরবাজারে পৌঁছেছেন দুপুর ১২টায়।

আরও পড়ুন

বন্যাকবলিত মানুষের হাহাকার ও আজাহারি শুরু হয়েছে। চুলা তলিয়ে যাওয়ায় অনেকের ঘরেই শুক্রবার রান্না হয়নি। এতে খাদ্যসংকটে পড়েছেন অনেকে। সুপেয় পানির সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ-সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় গবাদিপশু নিয়ে অনেকে বিপদে পড়েছেন। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও অভুক্ত থাকছে।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের উপজেলাগুলোর পাশাপাশি নগরের ২০ থেকে ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, কালীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর, তেরোরতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর ও ঘাসিটুলা এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক রাস্তায় পানি থই থই করছে। বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বানের পানির সঙ্গে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা। এসব পানি থেকে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে।

সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার অসংখ্য দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে। মা-মণি এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী ফখরুল ইসলাম এবং শাহজালাল-শাহপরান বেডিং স্টোরের ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুপুরে চোখের পলকেই দোকানে পানি ঢুকে যায়। এতে তাঁদের প্রত্যেকের দোকানে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি এখনো বাড়ছে। তাই তাঁরা এখনো ভিজে না যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন।