একই নৌ দুর্ঘটনায় আবার দুই আইনে দুই মামলা

গত রোববার দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ আফসারউদ্দিন-২-কে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় কার্গো জাহাজ রূপসী-৯
ছবি: সংগৃহীত

নৌপথে একই দুর্ঘটনায় দুই আইনে দুই মামলা করার সুযোগ নেই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গোর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় দুই আইনে দুটি মামলা করা হয়েছে।

গত রোববার দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ আফসারউদ্দিন-২-কে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় কার্গো জাহাজ রূপসী-৯। এ ঘটনায় প্রথম মামলাটি করা হয়েছে দণ্ডবিধির অধীন।

গত সোমবার বিকেলে দণ্ডবিধির অধীন মামলাটি করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উপপরিচালক (ট্রাফিক ও নৌ নিরাপত্তা) বাবু লাল বৈদ্য। বেপরোয়া জাহাজ চালিয়ে হত্যার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় এমভি রূপসী-৯ কার্গো জাহাজের মাস্টারসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।

একই দিন এমভি রূপসী-৯ কার্গো জাহাজের মাস্টারসহ আটজনকে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউসার আলমের আদালতে হাজির করে তাঁদের সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নৌ পুলিশের উপপরিদর্শক মো. ফোরকান মিয়া। শুনানি শেষে আদালত আসামিদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

দ্বিতীয় মামলাটি করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের অধীন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মামলাটি করেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের পরিদর্শক আশিকুর রহমান। মামলাটি নথিভুক্ত করে নৌ আদালতের বিচারক জয়নাব বেগম আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

১৯৭৬ সালের অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নৌপথে দুর্ঘটনার মামলার বিচার নৌ আদালতে হওয়ার কথা। এ অধ্যাদেশে নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত মামলা, তদন্ত ও বিচারের নিয়মকানুন বিশদভাবে বলা আছে।

নৌ দুর্ঘটনায় সাধারণ আইনে মামলা করার প্রবণতা ১৯৯৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছিল। সে বছর মন্ত্রণালয়টি নৌ দুর্ঘটনায় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা না করার জন্য দেশের সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তা সত্ত্বেও নৌ চলাচল অধ্যাদেশের বাইরে দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হতে দেখা যাচ্ছে।

সবশেষ আফসারউদ্দিন-২ ডুবির ঘটনায় প্রথমে দণ্ডবিধি, পরে নৌ চলাচল অধ্যাদেশের অধীন মামলা হলো। দণ্ডবিধির অধীন হওয়া মামলার তদন্ত করছে নৌ পুলিশ।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গত বছরের মে মাসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ প্রাধান্য পাবে।

আফসারউদ্দিন -২ ডুবির ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের নৌ থানার ওসি মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। তাই দণ্ডবিধি অনুযায়ী মামলা হয়েছে।’

নৌ দুর্ঘটনায় দণ্ডবিধিতে মামলা হওয়ায় বিধান লঙ্ঘন হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান আইন পড়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) অগ্রাধিকার পাবে, অন্য আইন পরে আসবে।’

আফসারউদ্দিন-২ ডুবির ঘটনায় নৌ আদালতে হওয়া মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ কোনোভাবেই নৌ দুর্ঘটনার মামলা তদন্ত করতে পারবে না। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী, পুলিশ শুধু উদ্ধার অভিযানে অংশ নেবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করবে। নৌ দুর্ঘটনার মামলায় পুলিশের ভূমিকা কী হবে, তা আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে।

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ২ উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একই অপরাধে দুই আইনে মামলা হতে পারে না উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর হোসাইন আরও বলেন, নৌ দুর্ঘটনার মামলা অন্য আইনে না নিতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গত বছরও একটি চিঠি দিয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। তারপরও দুই আইনে মামলা করা হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৩ ধারা, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের ২৬ ধারায়ও একই অপরাধে দুই আইনের অধীন মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট বলা আছে।

আরও পড়ুন

এ ব্যাপারে গত বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের ২৬ ধারা অনুযায়ী, একই ঘটনার জন্য দুই আইনের অধীন যদি অপরাধ হয়, তখন বিচার চলবে একটি আইনের অধীন। জেনারেল রুলসই হলো, পরের আইনটা আগের আইনের থেকে প্রাধান্য পায়। বিশেষ আইন সব সময় প্রাধান্য পাবে।

নৌপথে একই দুর্ঘটনায় দুই আইনে দুই মামলা করার কারণে আসামিপক্ষ সুবিধা পাচ্ছে। আসামিপক্ষ একই ঘটনায় দুই মামলার বিচারের মুখোমুখি করার অজুহাত দেখিয়ে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে যাচ্ছে। নৌ আদালতে বিচারাধীন কয়েকটি মামলায় উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ পেয়েছে আসামিপক্ষ।

২০১৪ সালে পিনাক-৬ ডুবির ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ ও দণ্ডবিধিতে দুটি মামলা হয়। হাইকোর্ট এ ঘটনায় নৌ আদালতে চলমান মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় ঝালকাঠি, বরগুনা ও ঢাকায় পৃথক তিনটি মামলা হয়। পরবর্তীকালে এসব মামলা নৌ আদালতে বদলি করা হয় বলে প্রথম আলোকে জানান আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসাইন।

নৌ চলাচল অধ্যাদেশ আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ পাঁচ লাখ টাকা। নৌ আদালতে মামলা পরিচালনাকারী প্রবীণ আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, নৌ চলাচল অধ্যাদেশ আইনে অনেক অস্পষ্টতা আছে। সেগুলো দূর করা যেতে পারে। কিন্তু নৌ আদালতের বাইরে অন্য আদালতে নৌ দুর্ঘটনার বিচারের সুযোগ নেই।

আফসারউদ্দিন-২ ডুবির ঘটনায় দণ্ডবিধির অধীন হওয়া মামলার বাদী বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জের কর্মকর্তা বাবু লাল বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক, যুগ্ম পরিচালক, সহকারী পরিচালক ও পরিবহন পরিদর্শক পদমর্যাদার ৪৭ কর্মকর্তাকে মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি এজাহার দায়ের করেছি। তদন্তের পর সংশ্লিষ্ট থানায় তা নিয়মিত মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হবে।’

নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৌ দুর্ঘটনার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নৌ আদালতে মামলা করার দায়িত্ব নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকের। কিন্তু মামলা করতে দেরি হলেই নানা আইনি জটিলতা তৈরি হয়।

গত রোববার দুপুরে আফসারউদ্দিন-২ ডুবির ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে তিন দিন সময় নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের পরিদর্শক আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ঘটনাস্থলে থাকতে হয়েছিল। এ ছাড়া আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই করতেও সময় লেগেছে।’

জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজের চালকদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা ছাড়াও দুর্ঘটনার সময়ে তাঁরা কর্তব্যরত ছিলেন কি না, তা-ও যাচাই করে দেখতে হয়। এ জন্যই মামলা করতে কিছুটা দেরি হয়েছে।

আফসারউদ্দিন-২ ডুবির ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ২ শিশুসহ ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজের সরকারি তালিকায় আর কেউ না থাকায় উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি করেছে।