চাঁদা আদায় এখন মাসিক চুক্তিতে, দেওয়া হয় কার্ড

রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া বাজার থেকে সবজির ট্রাকে উঠে বসলাম গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টায়। ঢাকায় পৌঁছালাম গতকাল বুধবার সকাল ছয়টায়। প্রায় আড়াই শ কিলোমিটারের এই যাত্রায় সবজির ট্রাকটিকে কোথাও পুলিশ থামায়নি। একটি টাকাও নেয়নি। অথচ সড়কে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা নেওয়ার জোরালো অভিযোগ শোনা যায়।

ট্রাকটির চালক জানালেন, সড়কে নয়, এখন চাঁদা নেওয়া হয় মাসিক চুক্তিতে। দুই হাজার টাকা পরিশোধ করলে একটি কার্ড পাওয়া যায়। সেই কার্ড দেখালেই পুলিশ ট্রাক ছেড়ে দেয়। কার্ড না থাকলে গাড়ির নথিপত্র ঠিক থাকলেও অনেক সময় হয়রানির মুখে পড়তে হয়। চাঁদার কার্ডটিও দেখিয়েছেন এই চালক। তিনি বলেছেন, সারা দেশে ৩১০টি জায়গায় (স্পট) এই কার্ড দেখালে কাজ হয়। অবশ্য তারপরও চা পানের কথা বলে পুলিশের কোনো কোনো সদস্য মাঝেমধ্যে কিছু টাকা নেন।

গাড়ি ছাড়ার আগে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাম জানা গেল। গত মঙ্গলবার পবার নওহাটায় পাইকারিতে প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়স ২২ থেকে ২৫, কাঁচা পেঁপে ১৪ থেকে ১৫ টাকা ও পুঁইশাক ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

রাজশাহীর পবা উপজেলা সবজি চাষের জন্য সুপরিচিত। পবার সবজি রাজধানীবাসীর বাজারের ব্যাগে ওঠার আগে দাম কীভাবে বাড়ে, তা জানতেই সবজির ট্রাকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা। ট্রাকটিতে সবজি ছিল আট টনের মতো। কাঁচা পেঁপে, ঢ্যাঁড়স ও পুঁইশাক। ট্রাকে ছিলেন চালক ও চালকের সহকারী। গাড়ি ছাড়ার আগে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাম জানা গেল। গত মঙ্গলবার পবার নওহাটায় পাইকারিতে প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়স ২২ থেকে ২৫, কাঁচা পেঁপে ১৪ থেকে ১৫ টাকা ও পুঁইশাক ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

ব্যাপারটা কী—জানতে চাইলাম চালকের কাছে। কথায় কথায় চালক জানালেন মাসিক কার্ডের কথা। তাঁর কাছে দুটি কার্ড। একটি গাড়ির সামনের কাচে লাগানো। অন্যটি থাকে তাঁর পকেটে। কার্ড হাতে নিয়ে দেখা গেল, ছাপানো কার্ডটিতে ট্রাকের নম্বর ও ইস্যুর তারিখ লেখা। কার্ডের অপর পিঠে মেসার্স সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির নাম, নম্বর ও ট্রাকের নম্বর দেওয়া।

সন্ধ্যায় চালক ট্রাক নিয়ে রওনা দিলেন। কয়েক কিলোমিটার যেতে পবার বায়া বাজারে থামল। উঠলেন আরেকজন চালক, যিনি ট্রাক নিয়ে ঢাকায় যাবেন। রাজশাহীর আমচত্বর ও বেলপুকুর পেরিয়ে নাটোর এলাকায় ঢুকতে লাগল এক ঘণ্টা। এর আধা ঘণ্টা পর এল নাটোর বাইপাস মোড়। রাজশাহীর আমচত্বর ও বেলপুকুর এবং নাটোর বাইপাস মোড়ে পুলিশ ট্রাক থামিয়ে নিয়মিত চাঁদা নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যে কটি জায়গায় পুলিশ চাঁদা নেয় বলে জানিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল আমচত্বর, বেলপুকুর ও নাটোর বাইপাস। কিন্তু দেখা গেল, এই সব মোড়ে পুলিশ ট্রাকটি থামায়নি।

ব্যাপারটা কী—জানতে চাইলাম চালকের কাছে। কথায় কথায় চালক জানালেন মাসিক কার্ডের কথা। তাঁর কাছে দুটি কার্ড। একটি গাড়ির সামনের কাচে লাগানো। অন্যটি থাকে তাঁর পকেটে। কার্ড হাতে নিয়ে দেখা গেল, ছাপানো কার্ডটিতে ট্রাকের নম্বর ও ইস্যুর তারিখ লেখা। কার্ডের অপর পিঠে মেসার্স সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির নাম, নম্বর ও ট্রাকের নম্বর দেওয়া।

চালক বললেন, মেসার্স সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিই মূলত পুলিশের মধ্যস্থতাকারী। তারা পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করে মাসিক এই কার্ডের ব্যবস্থা করে। কোন কোন জায়গায় এই কার্ড দেখালে পুলিশ কোনো ঝামেলা করবে না, তার তালিকা বের করে দেখান চালক। সেখানে দেখা যায়, সারা দেশে ৩১০টি জায়গার নাম রয়েছে। জায়গা বলতে মূলত পুলিশের থানা, ফাঁড়ি, পুলিশ বক্স ও মোড়ের নাম।

আরও পড়ুন

ট্রাকটির চালকের দাবি, পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য ট্রাকের মালিকেরা কেন্দ্রীয়ভাবে চাঁদা হিসেবে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে দেন। পরিশোধ করা হয় মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে। প্রতিটি ট্রাকের বিপরীতে টাকা দিতে হয়। টাকা জমা হলেই নতুন কার্ড চলে আসে। প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যেই এই চাঁদার টাকা জমা দিতে হয়। কার্ডে যোগাযোগের নম্বরটি প্রতি মাসেই বদলে যায়। ফলে কেউ যদি চাঁদা না দেন, তারপর পুলিশের হাতে পড়েন, তাহলে আর যোগাযোগ করতে পারেন না। কারণ, তাঁর কাছে থাকা কার্ডের পুরোনো নম্বর বন্ধ হয়ে যায়।

এ ঘটনা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আইজিপি কমপ্লেইন সেল ও এআইজি মিডিয়া বরাবর অভিযোগ দেওয়া হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কামরুজ্জামান

কার্ডে থাকা মেসার্স সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির নম্বরে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ফোন করা হলে অপর প্রান্ত থেকে আগে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। অপর প্রান্তের ব্যক্তি বারবার বলছিলেন, আপনি কোন চালকের কাছ থেকে নম্বর পেলেন। পরিচয় পরে দেওয়ার কথা বললে তিনি ফোন কেটে দেন। একটু পরেই ওই নম্বর থেকে আবার ফোন আসে। অপর প্রান্তের ব্যক্তি আবার এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। আবারও বারবার জানতে চান, কোন চালকের কাছ থেকে এই নম্বর পেয়েছি। ব্যক্তিটি দাবি করেন, তিনি মেসার্স সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির কেউ নন। একপর্যায়ে গালাগালি শুরু করেন।

আরও পড়ুন

সাতক্ষীরা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায় সাতক্ষীরায়। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা ওই ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে মালিকের ছেলে পরিচয় দিয়ে শেখ বণি নামের এক ব্যক্তি বলেন, তাঁদের ব্যবসা সাড়ে তিন বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় গত শনিবার ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সড়ক-মহাসড়কে পুলিশ ও কাঁচাবাজারে প্রভাবশালীদের ‘গুপ্ত’ চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি অনেকটা সরকারিভাবে টোল সংগ্রহের মতো হয়ে গেছে।

কার্ড দিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আইজিপি কমপ্লেইন সেল ও এআইজি মিডিয়া বরাবর অভিযোগ দেওয়া হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এর আগে ২ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সড়কে পণ্যবাহী গাড়ি না থামাতে নির্দেশনা দিয়েছে। পণ্য পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কে গাড়ি না থামিয়ে এখন মাসিক চুক্তিতে সারা দেশেই চাঁদাবাজি চলে। বিষয়টি এমন যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবহন কোম্পানির অধীনে সাধারণ মালিকদের গাড়ি পরিচালনা করেন। এ জন্য মাসে মাসে টাকা নেন। সেই টাকার বড় অংশ পুলিশ ও প্রভাবশালীদের দেন। একটা অংশ নিজেরা রাখেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি এবং বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ কার্ড না থাকলে ২০-২৫ হাজার টাকা জরিমানার মামলা দেওয়া হয়। এই কার্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশে চাঁদাবাজি চলে। উল্লেখ্য, দেশে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

রাজশাহী থেকে আসা ট্রাকটি গতকাল সন্ধ্যায় কাঁচপুর থেকে পণ্য নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেন। রাতে চালক ফোন করে জানান, ঢাকা থেকে বের হওয়ার সময় কয়েকটি জায়গায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে ৬০ টাকা এবং পরিবহন সমিতি ও লাইনম্যানের নামে ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে।

২২ টাকার ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা

রাজশাহীর পবা থেকে যে ট্রাকে উঠেছিলাম, সেটির ভাড়া ছিল ১৭ হাজার টাকা। প্রতি কেজি সবজিতে ভাড়া পড়ে দুই টাকার কিছু বেশি। গতকাল কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেল, পবায় যে ঢ্যাঁড়স প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৫ টাকা ছিল, তা খুচরায় ৬০ টাকা এবং কারওয়ান বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের ঢাকার হাতিরপুল বাজারে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই ভাবে পবার ১৪-১৫ টাকা কেজির পেঁপে কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুলে ৪০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

রাজশাহী থেকে আসা ট্রাকটি গতকাল সন্ধ্যায় কাঁচপুর থেকে পণ্য নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেন। রাতে চালক ফোন করে জানান, ঢাকা থেকে বের হওয়ার সময় কয়েকটি জায়গায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে ৬০ টাকা এবং পরিবহন সমিতি ও লাইনম্যানের নামে ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে।