চা-বাগানের তিন তরুণ স্বপ্ন দেখেন নিজেদের জনগোষ্ঠীর সেবা করার

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগর চা-বাগানের দরিদ্র চা-শ্রমিক অনত লাল যাদবের ছেলে সিবায় যাদব। বাবার দৈনিক ১২০ টাকা মজুরির আয়ে চলে তাঁদের চারজনের সংসার। বাবার এই কষ্ট আর আত্মীয়স্বজন, এলাকাবাসী ও শিক্ষকদের সহযোগিতার প্রতিদান দিচ্ছেন সিবায়। এসএসসির পর এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন চিকিৎসক হয়ে নিজের জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর।

এসএসসিতে লংলা চা-বাগানের ক্যামেলিয়া ডানকান স্কুল থেকে জিপিও-৫ পেয়েছিলেন সিবায়। সে বছর অদম্য মেধাবীদের নিয়ে প্রথম আলোতে ধারাবাহিক লেখায় তাঁর কথা প্রকাশিত হলে প্রথম আলো ট্রাস্ট তাঁকে দুই বছর আর্থিক সহায়তা দেয়। এসএসসির পর সিবায় অঙ্গীকার করেন, এইচএসসিতেও ভালো ফলাফল করবেন। তা-ই করে দেখালেন। শমশেরনগরের সুজা মেমোরিয়াল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ২০২১ সালের এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি।

প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সিবায় বলেন, এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর প্রথম আলোর সহায়তায় এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এখন তাঁর ইচ্ছা সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে একজন চিকিৎসক হয়ে নিজের এলাকার মানুষের জন্য কাজ করবেন। তবে দুশ্চিন্তা, বাবার সীমিত আয়ে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হবে কি না।

এইচএসসিতে সিবায়ের মতোই সাফল্য দেখিয়ে একই স্বপ্ন দেখছেন চা-জনগোষ্ঠীতে বেড়ে ওঠা সৈকত তেলী। বাবা সুদর্শন তেলী কমলগঞ্জের শমশেরনগরের কানিহাটি চা-বাগানে অবস্থিত ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। মা লাকি তেলী একজন গৃহিণী। সুদর্শনের অল্প বেতনে এবং এলাকাবাসী ও স্বজনদের সহায়তায় দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন এই দম্পতি।

সৈকত তেলী ক্যামেলিয়া ডানকান স্কুল থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। প্রথম আলোতে অদম্য মেধাবী হিসেবে তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে যমুনা ব্যাংক প্রথম আলোর মাধ্যমে সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে দুই বছরের বৃত্তি দেয়। তিনি শমশেরনগর সুজা মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

এইচএসসি ফলের পর প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বাবা-ছেলে। সৈকত বলেন, তাঁর ইচ্ছা সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হওয়া। চিকিৎসক হলে তিনি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে পারবেন। তবে মেডিকেলে পড়াশোনায় আর্থিক অসংগতিকে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন তিনি। তবে তাঁর বিশ্বাস, এবারও সহায়তার হাত নিয়ে কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াবেন।

বিসিএস ক্যাডার হতে চান প্রশান্ত

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জেরই আরেক অদম্য প্রশান্ত শব্দকর। আলীনগর ইউনিয়নের যোগিবিল গ্রামের অনগ্রসর দরিদ্র শব্দকর পরিবারের এই সন্তান ছোটবেলায় হারিয়েছেন বাবা ঈরেশ শব্দকরকে। সংসার চলছিল না। পরিবারের চার সদস্য নিয়ে বিপাকে পড়েন মা দীপালি রানী কর। অন্যের বাড়িতে কাজ করেন তিনি। বড় ছেলে একটি ফার্মেসিতে কাজ করেন। তবে অসুস্থ মায়ের শরীরটা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে আসছে।

এমন অবস্থা পেছনে ফেলে সুদিনের স্বপ্ন দেখেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া প্রশান্ত। তিনি বলেন, ‘মা অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। আমি লেখাপড়া করতে চাই। হাল ছাড়া যাবে না। লেখাপড়া করতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে।’

পড়াশোনায় আগের ধাপগুলোতেও সাফল্য দেখিয়েছেন প্রশান্ত। কমলগঞ্জ মডেল সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান তিনি। এরপর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ৮৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা তুলে ধরে প্রশান্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী করব আমি বুঝতে পারছি না। ছোটবেলা থেকে কষ্ট করে আসছি। কখনো কখনো না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি, কিন্তু পড়াশোনা বাদ দিইনি। মা এখন অসুস্থ, চলা দায় হয়ে পড়েছে। স্কুলে প্রধান শিক্ষকসহ স্যাররা সাহায্য করেছেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কলেজ অধ্যক্ষসহ বিভিন্নজন সহযোগিতা করেছেন। আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। কীভাবে ভর্তি হব, কীভাবে কী করব, এখন আর মাথায় কাজ করছে না।’ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে বিসিএস ক্যাডার হতে চান। তবে দারিদ্র্য তাঁর এ স্বপ্নপূরণ হতে দেবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত তিনি।