
কোটি কোটি মুসলমান যে ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন, সেই আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ দেখার পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে যাচ্ছি আমরা। সারা বিশ্বের প্রতিপালকের মেহমান হয়ে মক্কা, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফায় হাজির হয়ে বলব, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ানিন’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্, লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।’
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমানের বোয়িং ৭৭৭ বিজি ০৩৫ প্লেন উড়াল দিল জেদ্দার পথে।
আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, জেদ্দায় অবতরণের পর ফ্লাইটের কোন হজযাত্রী মক্কায় যাবেন আর কারা মদিনায় যাবেন। যেহেতু আমরা মক্কায় যাব তাই বিমানে ওঠার আগে হজ ক্যাম্পেই ইহরামের কাপড় (আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ কাপড়) পরে নিলাম। যাঁরা জেদ্দা থেকে মদিনায় যান তাঁরা সাধারণ পোশাকেই যান। মদিনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে তাঁরা ইহরামের কাপড় পরে যাবেন।
দীর্ঘ সাত ঘণ্টা পর জেদ্দা বিমানবন্দরে গিয়ে নামলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা। প্রথম কাজ হিসেবে ঘড়ির সময় তিন ঘণ্টা কমিয়ে নিলাম। একটি বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হজ টার্মিনালে। বিশাল টার্মিনাল, চারদিক খোলা। ঐতিহ্যবাহী তাঁবুর নকশায় করা ছাদ। এই হজ টার্মিনালের স্থপতি কিন্তু বাংলাদেশি। যুক্তরাষ্ট্রের শিয়ার্স টাওয়ারের স্থপতি ফজলুর রহমান খান, যিনি এফ আর খান নামে পরিচিত। গর্বে বুকটা ভরে গেল।
টার্মিনালে নিজ দেশের ক্যাম্পে পথ চেনা খুবই সহজ। কিছু দূর পর পর নিজ নিজ দেশের পতাকা দিয়ে পথ নির্দেশিত করা। লাল সবুজ পতাকা অনুসরণ করে বাংলাদেশ প্লাজায় পৌঁছালাম। চার ঘণ্টার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সেখান থেকে ৪৫ জন করে একেকটি বাস মক্কার উদ্দেশে রওনা হলো। পথে যেতে যেতে হজ যাত্রীরা মনে মনে জপছেন, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ানিন’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্, লা শারিকা লাকা।’ দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আমরা পবিত্র মক্কা নগরে পৌঁছালাম।
হজ তিন প্রকার—তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ। বেশির ভাগ হজযাত্রী তামাত্তু হজ করেন। যেহেতু তামাত্তু হজ করব তাই মক্কায় পৌঁছে প্রথম কাজ হলো ওমরা করা। অর্থাৎ পবিত্র কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করে, সাফা মারওয়ায় সাতবার সায়ি করে, মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম খুলে ফেলা।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে ওজু করে মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফে) পৌঁছালাম। ঢুকলাম মাতাফে (কাবা শরিফের চারদিকে তাওয়াফের স্থানকে মাতাফ বা চত্বর বলে)। মেঝেতে বড় বড় সাদা পাথর বসানো। এই পাথরের বিশেষত্ব হলো তীব্র তাপেও পাথর ততটা গরম হয় না।
এবার মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কাবা শরিফের তাওয়াফ শুরু করতে হয় হাজরে আসওয়াদ থেকে। ভিড়ের কারণে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুমু দেওয়া সম্ভব না হলে ইশারায় চুমুু দিতে হয়। এর আগে পরপর নয়বার হজ করতে এসে হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
কাবা শরিফকে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে ৪০ মিনিটের মতো লাগল। ভিড় কম থাকলে ১৫ মিনিটেও করা যায়। তাওয়াফ শেষে দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে জমজম কূপের পানি খেলাম। আল্লাহর রহমতে জমজমের পানি অনেক খেয়েছি। এর স্বাদ সব সময়ই একই রকম লেগেছে। কোনো পরিবর্তন নেই। মসজিদে কিছু দুর পর পর (ঠান্ডা, স্বাভাবিক) জমজমের পানি একাধিক জারে ভরে রাখা আছে। ইচ্ছা হলেই যাতে পানি পান করা যায়।
জমজমের পানি খেয়ে সাফা মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সায়ি করলাম। অর্থাৎ সাফা মারওয়া সাতবার আসা-যাওয়া করলাম। জনশ্রুতি আছে, হজরত হাজেরা (আ.) এবং শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কাবার পাশে বড় একটি গাছের ছায়ায় রেখে যান হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তখন কাবা শরিফের স্থানটি ছিল উঁচু একটি টিলার মতো। তাঁদের দিয়ে যান কিছু খেজুর আর এক মশক পানি। পানি ফুরিয়ে গেলে হজরত হাজেরা (আ.) পানির জন্য কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ছোটাছুটি করতে থাকেন। সাতবার ছোটাছুটির পর একটি আওয়াজ শুনে তিনি কাবার পাশে এসে দেখেন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। তিনি পানির উৎসের চারদিকে বালির বাঁধ দেন। পরে খনন করে এই কূপকে আরও প্রশস্ত করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। এইটাই জমজম পানির উৎপত্তি ও সাফা মারওয়ায় দৌড়ানোর ইতিহাস।
দুই পাহাড়ের মধ্যে একটি জায়গায় এলে কিছুটা স্থান দৌড়াতে হয় এবং বাকি পথ হাঁটার রেওয়াজ। বিবি হাজেরা পানির জন্য যে জায়গাগুলোতে ছুটোছুটি করেছিলেন এখন সেখানে ওমরাহ বা হজে হজযাত্রীরা দৌড়ান। এই পাহাড় দুটি এখন মসজিদুল হারামের অন্তর্ভুক্ত। সাফা পাহাড় থেকে সায়ি শুরু করতে হয় এবং সাতবার আসা-যাওয়ার পর মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে শেষ করতে হয়।
মারওয়ার কাছেই সেলুন। পাকিস্তানি নাপিত মাথা মুণ্ডন করে দিল ১০ রিয়ালে। ইহরামের কাপড় বদলে গোসল করে স্বাভাবিক পোশাক পরলাম। এভাবেই ওমরাহ শেষ হলো। হজের আগে ৭ জিলহজ আবার ইহরামের কাপড় পরতে হবে।
আগামীকাল পড়ুন: মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদের বর্ণনা