নারী নির্যাতনে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রতিকারের উপায়

>১৭ নভেম্বর ২০১৫, প্রথমআলোর আয়োজনে ‘নারী নির্যাতনে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার: প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
.
.

আলোচনা 

আব্দুল কাইয়ুম: তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। কখনো ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে আবার কখনো সম্পূর্ণ অপরিচিতজনের মাধ্যমে নারীরা এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক সময় একজনের ছবিতে অন্যের আপত্তিকর ছবি জুড়ে দেওয়া, সফটওয়্যারের মাধ্যমে অশ্লীল ছবির ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

বিনা অনুমতিতে ফেসবুক পেজ খোলা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা, উত্ত্যক্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে অনেক নারী। কিছু ওয়েবসাই​েট ফটোশপের মাধ্যমে ছবি বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে। একদল প্রশিক্ষিত অপরাধী ক্রমাগতভাবে এ কাজ করছে। একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনু​যা​য়ী বিশ্বের প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব বিষয়ে এখন আ​েলাচনা করবেন তারানা হালিম।

তারানা হালিম:

তারানা হালিম
তারানা হালিম

সারা বিশ্বের যে অসংখ্য না​রী তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত সহিংসতার শিকার, তার ​মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ অভিযোগ করছে। একটি বড় অংশ প্র​িতবাদ করছে না প্রচলিত পদ্ধতিতে সম্মানহানির ভয়ে। প্রতিহিংসা, ব্ল্যাকমেল, বিয়েতে রাজি না হওয়া, যুবকদের বিকৃত মানসিকতা ইত্যাদি কারণে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ থেকে প্রায় কেউই বাদ যাচ্ছে না। সাইবার ক্রাইম থেকে সেলিব্রেটিরাও বাদ পড়ছেন না।
অনেক​ ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র মা–বাবা বোঝেনও না যে তঁাদের মেয়ের ছবি ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করা সম্ভব। ফলে তঁারা অন্যদেরও বোঝাতে পারেন না। মনে হয়, আগামী দুই থেকে তিন বছরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে নারীরা সাইবার সহিংসতার শিকার হবে। এখন থেকেই এর বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। সাইবার ক্রাইম অপরাধ দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ—সবাই কাজ করছে। কিন্তু এসব কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভা​েব আশানুরূপ ফল অ​ির্জত হচ্ছে না।
পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইন আছে। এ আইনে সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর। বাংলাদেশ কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে, সাইবার ক্যাফের প্রতিনিধি—এরা সবাই সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছে। আবার সিআইডিতে সাইবার ক্রাইম ইউনিট আছে। ডিবি, র‌্যাব, পুলিশও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। সব বিভাগ মিলে কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করতে পারলে সাইবার অপরাধ দ্রুত কমানো সম্ভব হবে। 

প্রত্যেকে নিজেদের মতো কাজ করে। পুলিশ তদন্ত বা উৎসকে গুরুত্ব দেয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে বিষয়বস্তুর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইসিটি অন্য একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এসবের মধ্যে সমন্বয় হলে সবার কাজ ফলপ্রসূ হবে। বিটিআরসিতে এ বছর ২২০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধে্য ৬০ শতাংশ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর আবার বেশির ভাগ ভুয়া আইডি খুলে আপত্তিকর ছবি আপলোড করা, রাজনৈতিক বিষয়সহ বিভিন্নভাবে এসব আইডির অপব্যবহার হচ্ছে। 

পর্নোগ্রাফিসহ অংসখ্য অপরাধে আমরা ৪০টি ফেসবুক পেজ বন্ধ করেছি। সাইবার ক্রাইম নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাজে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আপত্তিকর ছবিসহ বিভিন্ন অপরাধে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়, কিছু ক্ষেত্রে নেয় না। কারণ, তারা আবার আমাদের অভিযোগের কিছু বিষয়কে আপত্তিকর মনে করে না। আবার কখনো কখনো এত বেশি অভিযোগ জমা পড়ে যে সবগু​েলা তারা সমাধান করতে পারে না।

বিএনপি সরকারের সময়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল। তারা তখন এ চুক্তি করেনি। ফলে এখন আমরা তাদের আপত্তিকর বিষয় ফেলে দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে পারছি না। আমরা সাইবার ক্রাইমের ব্যাপারে খুবই সজাগ। নিরলসভাবে এর বিরুদ্ধে কাজ করছি। এসব অপরাধ নিরসনের জন্য কাজ​ কমিয়ে আনতে পারব বলে আশা করি।

সুপর্ণা রায়:

সুপর্ণা রায়
সুপর্ণা রায়

 ২০০৭ সালে এটুআই (এক্সেস টু ইনফরমেশন) শুরু হয়। এটুআইয়ের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া। আজ ইউনিয়ন পর্যায়ে পাঁচ হাজার তথ্যপ্রযুক্তি সেবাকেন্দ্র আছে। এখান থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ সেবা গ্রহণ করছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন পুরুষ ও একজন নারী উদ্যোক্তা আছে। পুরুষেরা দ্রুত কাজ শিখে নিজের উন্নয়ন করতে পারছে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজে আগ্রহ আছে—এমন নারী পেতে সমস্যা হয়। আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তাদের কীভাবে দেখবেন, গ্রহণ করবেন, সেটা একটি সমস্যা। এলাকার পরিবেশ, বিয়ে হয়ে যাওয়া—এমন অনেক সমস্যা মেয়েদের ক্ষেত্রে রয়েছে।
এর মধ্য দিয়েও মোটামুটি ভালোভাবেই কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখানে সেবা নিতে আসছে। মোবাইল ব্যাংকিং হচ্ছে। মানুষ ব্যাংক হিসাব খুলছে। বিভিন্ন ধরনের ফ্রিল্যান্সিং সেবা শিখছে। গ্রাফিক ডিজাইন শিখছে। গ্রামের মেয়েরা এখান থেকে কিছু অর্থ উপার্জন করছে। তারপরও কিছু সমস্যা এখনো আছে। ১২ হাজার উদ্যোক্তা তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। তাদের একটা নিজস্ব ব্লগ আছে। এই ব্লগের মাধ্যমে কখনো ছেলে উদ্যোক্তা মেয়ে উদ্যোক্তাদের বিরক্ত করে। পাসওয়ার্ডসহ ব্যক্তিগত বিষয়গুলো যেন কোনো অবস্থায় কেউ কাউকে না দেয়, সে ক্ষেত্রে আমরা সবাইকে সতর্ক করছি। 

ইউনিয়ন পর্যায়ের সেবাকেন্দ্রগুলোতে সাধারণত বড় রকমের কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, এখানে সব সময় মানুষের উপস্থিতি থাকে। সবাই কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই এই কেন্দ্রগুলোতে সাইবার অপরাধের সুযোগ একেবারেই কম। বরং এই কেন্দ্রগুলো থেকে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সেবাই বেশি পাচ্ছে।
সুরাইয়া পারভীন:

সুরাইয়া পারভীন
সুরাইয়া পারভীন

যন্ত্রের আসলে কোনো ভালো-খারাপ দিক বলে কিছু নেই। যন্ত্রকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়, সেভাবে কাজ করে। যন্ত্র থেকে ছেলেমেয়েদের দূরে রাখার চেষ্টাও সমর্থন করি না। কারণ, আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি যে কোনো না কোনোভাবে তরুণেরা কম্পিউটার ব্যবহার করবেই। শিক্ষার জন্য তাদের এটা ব্যবহার করাটাই বরং কল্যাণজনক। একটি বিশ্বমানের অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি কোনো ধরনের প্রস্ত্ততি ছাড়াই আমাদের মাঝে চলে এসেছে। অধিকাংশ অভিভাবক এই প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। তাঁরা কীভাবে তাঁদের সন্তানদের এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে উপদেশ দেবেন? আবার আমরা চাইছি সবাই প্রযুক্তি ব্যবহার করুক। ঘরে ঘরে প্রযুক্তি পৌঁছে যাক। কারণ, প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকই বেশি।
প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে হয়তো আরও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। তাতে কয়েকজন অপরাধীকে সাজা দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়তো আরও বড় রকমের অপরাধ সংঘটিত হবে।
সত্যিকার অর্থে কাজ করতে হবে আমাদের বোধ ও সচেতনতার ক্ষেত্রে। প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রযুক্তি দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আমার মনে হয়, তরুণ-তরুণী, অভিভাবকসহ সবার জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
গণমাধ্যমসহ সব ক্ষেত্রে দেখে থাকি কোনো কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচারের জন্য একটি মেয়ে আত্মহত্যাসহ অনেক কিছু করছে। কিন্তু এর সঙ্গে একটি ছেলেও জড়িত আছে, সে তো আত্মহত্যা করছে না। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যত দিন পর্যন্ত এই অবস্থায় না আসতে পারব, তত দিন মেয়েরা নির্যাতিত হতে থাকবে। শেষ কথা হলো, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতার উদ্যোগ নিতে হবে।
মাহবুবা পান্না:

মাহবুবা পান্না
মাহবুবা পান্না

সাইবার অপরাধ না বলে আমরা বলছি ডিজিটাল অপরাধ। যাতে প্রযুক্তির মাধ্যমে করা সব ধরনের অপরাধ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের কাজের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধটা করা হচ্ছে, সেটা বের করা। আমরা ছেলেদের ও মেয়েদের স্কুলে কথা বলেছি। বিশেষভাবে মেয়েদের কাছে জানতে চেয়েছি তারা প্রযুক্তির নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু জানে কি না। অধিকাংশ মেয়েই তাদের প্রযুক্তির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কিছুই জানে না।
মেয়েরা তাদের পাসওয়ার্ড ছেলেদের দিচ্ছে। এসব পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে অনেকে মেয়েদের বিপদে ফেলছে। আমরা মেয়েদের খুব গুরুত্বের সঙ্গে বুঝিয়েছি যে পাসওয়ার্ড এমন একটি বিষয়, যা কখনো কোনো অবস্থায় কোনো ছেলেকে দেওয়া ঠিক না।
প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা নিরাপত্তা কোড আছে। কিন্তু মেয়েরা এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। আমরা এমনও দেখেছি যে একটি মেয়ের ফেসবুক নেই, অথচ তার নামে একটি ফেসবুক খুলে তাকে আলোচনার বিষয় করে তুলেছে। অথচ মেয়েটি এ বিষয়ে কিছু জানে না। আমরা বিভিন্ন অপরাধের বিষয় পুলিশকে জানাই। আমাদের কাজ এ পর্যন্তই। এরপরে কতটুকু কাজ হয় বা আদৌ হয় কি না, সেটা আর আমাদের জানার সুযোগ হয় না। আমাদের কাজের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সাইবার নিরাপত্তা আইন হতে যাচ্ছে। এই আইনের আওতায় ব্যাপক কাজ করার সুযোগ থাকবে। তখন আমরা আরও অনেক ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিতে পারব।

তাসলিমা মিজি :

তাসলিমা মিজি
তাসলিমা মিজি

একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করায় একটি মেয়ের সঙ্গে একটি ছেলের বন্ধুত্ব হয়। সে একদিন তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। একসময় তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়। তার স্ত্রী একদিন বলল, তার স্বামী তার এবং তার বোনের ফেসবুকে বাজে মন্তব্য ও ছবি দিয়েছে। তাদের অনেক পারিবারিক ছবিকে ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করেছে। সে এমনভাবে কাজগুলো করেছে যে এটা দেখে যে কেউ বিশ্বাস করবে। সামাজিকভাবে ওই মেয়েরা মানসম্মান হারাতে বসেছে। অনেক রকমের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কাউকে বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না যে এটা একটা প্রতারণা। তারপর আমি ওই ছেলেকে ডেকে সবকিছু জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে স্বীকার করে না। তারপর মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে একটা সমাধান করলাম।
আমার ছোট বোনের এক দরিদ্র বান্ধবী ছিল। চাকরি খঁুজতে গিয়ে এক প্রতারকের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। সেই প্রতারকের সঙ্গে সে কিছুটা অন্তরঙ্গ হয়। বিভিন্নভাবে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। একসময় মেয়েটি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। পরে তো সেই লোকটি তার অন্তরঙ্গ ভিডিওগুলো ইউটিউবে ছেড়ে দেয়। তবে সেখানে চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু ছিল না। ভিডিওগুলো ছিল অনেক লম্বা। মানুষ মনে করত, শেষে যেন কী আছে। তখন ইন্টারনেট স্পিড না থাকার জন্য শেষটা আর মানুষ দেখতে পারত না। একপর্যায়ে মেয়েটি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তাকে অনেক বুঝিয়ে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করি। এরপর আমি ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব মিলে একটি ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করি, মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিই।
আমরা সবাই ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়াই। সে সাহস পায় এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন অপরাধ হয়, তেমনি প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে শক্তি অর্জন করা যায়।

সাদেকা হালিম:

সাদেকা হালিম
সাদেকা হালিম

একটা ধারার মধ্য দিয়ে যখন একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন তার মনমানসিকতার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। আমি মেয়েদের বলি, তোমরা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি দাও। প্রায় সব মেয়েই তার একার ছবি দেয়। সে ভাবে এটা তার জন্য ভালো, তার  অনেক লাইক পড়বে, তাকে সবাই চিনবে ইত্যাদি। আবার মানুষ তার এক​া ছবি দেখতেও চায়। প্রধান সমস্যা হচ্ছে, আমরা মেয়েদের মানুষ মনে করছি না, পণ্য মনে করছি।
মানসিকতার পরিবর্তনটা খুব জরুরি। আইসিটি আইন আছে। এই আইন নারীদের সেভাবে রক্ষা করছে না। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অনেকেই এটা জানে না। ফলে আইন সম্পর্কে মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। অনেক মেয়েই আবেগের বশে বন্ধুকে ছবি দিচ্ছে। এই ছবি বিকৃত করে প্রতারণা করা হচ্ছে। অথচ মেয়েটি আইসিটি আইন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানছে না।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে নারীদের জন্য বিশেষ একটি ধারা থাকা প্রয়োজন। তথ্য কমিশনে থাকার সময় দেখেছি, অনেকে নারীদের ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চান। কিন্তু তথ্য অধিকার আইনেই বলা আছে, কাউকে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া যাবে না। এখন ডিজিটাল অপরাধ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। 

এখানে মহিলা ও শিশু, সমাজকল্যাণ, বৈদেশিক, স্বরাষ্ট্র—এসব মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ, এদের সবার সংশ্লিষ্টতা আছে। তা না হলে ডিজিটাল অপরাধ দমন করা সহজ হবে না। 

ডিজিটাল অপরাধের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। সর্বোপরি সবাই আন্তরিক হলে এ অপরাধ নিরসন করা কঠিন কোনো কাজ হবে না।

ফরিদা ইয়াসমিন:

ফরিদা ইয়াসমিন
ফরিদা ইয়াসমিন

আমাদের কাছে যারা আসে, তাদের আমরা সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করি। তার সব ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করি। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। তাকে পরামর্শ-সহায়তা দিই। তারপর তাকে আমরা সহযোগীর মাধ্যমে পুলিশ স্টেশনে পাঠিয়ে মামলা করানোর ব্যবস্থা করি। মামলাটি কোন আইনে হবে, সাইবার ক্রাইম, না অন্য কোনো আইনে, তার যাবতীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে মামলাটি দায়ের করার চেষ্টা করি। ভুক্তভোগী যদি মনে করে, তদন্ত মহিলা পুলিশ দিয়ে করানো উচিত, সে ক্ষেত্রেও আমরা সহযোগিতা দিই। একজন ভুক্তভোগী যেন কোনো ভয়াবহ অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে না পড়ে, তার জন্য যত ধরনের সহযোগিতা দেওয়া দরকার, তার সবটাই আমরা দিতে চেষ্টা করি। আমাদের কার্যক্রম প্রযুক্তিনির্ভর না। প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম আমাদের আরও অনেক বাড়ানো প্রয়োজন।

শাহানা সিদ্দিক:

শাহানা সিদ্দিক
শাহানা সিদ্দিক

মায়া ডটকমে দ্রুত যেকোনো ধরনের প্রশ্ন করা যায়। অনেক ধরনের প্রশ্ন আমাদের এখানে আসে। এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। একজন হয়তো একটা ভালো প্রশ্ন করে কিছু জানতে চাইল। একটা ভালো প্রশ্নের বিষয়েও অনে​েক ফেসবুকে খারাপ মন্তব্য করে।
আমাদের নারী ডাক্তাররা যখন তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন, তখন এই ডাক্তার সম্পর্কেও অনেক বাজে মন্তব্য আসে। ফলে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজটি করে যেতে হয়। প্রথম দিকে আমাদের ও অ্যাপ ব্যবহারকারীদের তেমন নিরাপত্তা ছিল না। এখন আমরা অ্যাপের মাধ্যমে সবার নিরাপত্তা দিতে পারছি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত নারীরা ৩৫ হাজার প্রশ্ন করেছে। এসব প্রশ্নের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়েছে। অনেক বিষয় প্রায় একই রকম। যেমন একটি মেয়ে একটি ছেলেকে ভালোবেসে নিজের ছবি দেয়। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ সময়ের ছবিও প্রেমিক ধারণ করে। তারপর ছেলেটি তার সঙ্গে প্রতারণা করা শুরু করে। এখানে ভালোবাসার আর কোনো মূল্য থাকে না। ছেলেটি মেয়েটির ছবি ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করে। তারপর ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। মায়া ডটকম এটা প্রতিরোধে সহায়তা দিয়ে থাকে। গ্রাম ও শহরে প্রায় সবার হাতে স্মার্টফোন আছে। মেয়েরা একটা ই-মেইল অ্যাড্রেস নেয় কেবল ফেসবুক খোলার জন্য। এই ই-মেইল দিয়ে যে আরও অনেক কিছু করা যায়, সেটা সে জানে না। এটা দিয়ে সে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিন্তু সে করতে পারে।

 কিন্তু মেয়েটি হয়তো এ বিষয়ের কিছু জানে না। শেষ কথা হলো, অনেক ছেলে বিভিন্নভাবে মেয়েদের ছবি বিকৃত করে অপব্যবহার করে। তাতে মেয়েটির জীবন যে একেবারে শেষ হলো, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। মেয়েদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা। 

লুনা সামসুদ্দোহা:

লুনা সামসুদ্দোহা
লুনা সামসুদ্দোহা

এখন বিশ্বব্যাপী নারীদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন উপায়ে নারীদের ওপর সহিংসতা হচ্ছে। ইন্টারনেট এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমরা যে ওষুধ খাব, সেটাও নাকি ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হবে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার প্রতিনিয়ত ব্যাপক হারে বাড়ছে। সরকার ৫০০ সাইট নিরাপদ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকেও সাইটের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। আমরা টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি। এই উন্নয়নের জন্য নারীদের প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনের ওপরও জোর দিতে হবে, যাতে নারীরা প্রযুক্তির অপব্যবহারের শিকার হলে তাকে সুরক্ষা দেওয়া যায়। সাইবার অপরাধটা আমাদের দেশে নতুন, তাই এ ক্ষেত্রে সচেতনতার ওপর জোর দিতে হবে। আইটি বিশেষজ্ঞ, মন্ত্রণালয়, নাগরিক সমাজ—সবাই মিলে সাইবার অপরাধ নিরসনে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সবাইকে সচেতন করে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

তানজীব-উল-আলম:

তানজীব-উল-আলম
তানজীব-উল-আলম

 অনেকগুলো প্রতিকারের বিষয় ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। যেমন গণসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আন্দোলন, মানসিকতার পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটলে সবার আগে প্রয়োজন আইনি প্রতিকার।
প্রযুক্তির মাধ্যমে যেসব অপরাধ হচ্ছে, সেগুলো বর্তমান আইনের দণ্ডবিধিতেও করা যায়। কিন্তু সাইবার অপরাধের পৃথক আইন আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি আইন। আজ নারীদের প্রতি যেসব অপরাধের কথা আলোচনা হলো, সেসব পর্নোগ্রাফি আইনে পড়ে। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে আইনটি অব্যবহৃত থেকে গেছে।
মানুষকে আরও সচেতন করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি আলোচিত আইন হলো আইসিটি আইন। এটি ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়। এ আইনটি নিয়ে আবার ভুলবোঝাবুঝি আছে। মূলত এ আইনটির একটি উদ্দেশ্য ছিল ডিজিটাল স্বাক্ষরের বৈধতা দেওয়া।
আইসিটি এমন একটি মাধ্যম, যেখানে অপরাধী এবং যার প্রতি অপরাধ হয়, তাদের সরাসরি দেখা হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। সাইবার অপরাধের শিকার কেবল নারীরাই হয়।

এর মাধ্যমে পুরুষের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ পায়। পুরুষ এভাবে তার ক্ষমতা দেখাতে চায় বলে মনে হয়। এখানে পুরুষেরা মনে করে এ অপরাধে তার কোনো সাজা হবে না।

আইন অনুসারে যেখানে অপরাধ হয়, সে এলাকায় মামলা দায়ের করতে হয়। গ্রামের একটা মেয়ে যদি থানায় অভিযোগ করে তাহলে হয়তো পুলিশের কর্মকর্তা মামলাই নেবেন না। কারণ, তিনি নিজেই হয়তো জানেন না কীভাবে সাইবার অপরাধ হয়।

কোনোভাবে পুলিশের কর্মকর্তা মামলা দায়ের করলেও বিচারকের যদি কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা না থাকে, তাহলে তিনি সঠিক বিচার পাবেন না। ২০০৬ সালে যখন আইসিটি আইনটি হয়, তখন এমন অনেক জটিলতার কথা আমরা ভেবেছি। এখন এ অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। 

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। ২০০৬ সালে আমাদের একটি ভাবনা ছিল যে কেন্দ্রীয়ভাবে একটা আলাদা ট্রাইব্যুনাল করা। এখানে সব তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করবেন। ফটোশপে যে ব্যক্তি নারীর ছবি বিকৃত করে প্রকাশ করে, সে মনে করে তার কিছু হবে না। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাজার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। 

সাইবার অপরাধের অভিযোগ, মামলা, তদন্ত, বিচার প্রতিটি স্তরে দক্ষতার অভাব রয়েছে। এটা দূর না করতে পারলে এ ক্ষেত্রে তেমন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। 

শীপা হাফিজা:

শীপা হাফিজা
শীপা হাফিজা

ফেসবুকের মাধ্যমে কত ধরনের অপরাধ যে হয় তার কোনো শেষ নেই। একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, একটি ছেলে ফেসবুকের মাধ্যমে একটি মেয়েকে বলেছে, বন্ধু হবা? মেয়েটি সম্মতি দিয়েছে। কয়েক দিন কথা বলার পর দুজনে একটি মোটরসাইকেলের দোকানে দেখা করেছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দোকানে রেখে একটি মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। পরে পুলিশ-অভিভাবক সবাই মিলে একটা সমঝোতায় এসে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে আনেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সাধারণ বন্ধুত্ব করতে গিয়ে মেয়েটির কত বড় বিপদ হলো। আমার স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ বিষয়টি খুব জরুরি ভিত্তিতে শেখাচ্ছি। মেয়েরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করে, মোবাইল ব্যবহার করে, এসব ক্ষেত্রে সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন। কারণ, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীর তথ্যপ্রযুক্তি–সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
বিটিআরসি যে উদ্যোগগুলো নিচ্ছে, সেগুলো খুব ফলপ্রসূ হবে বলে আমার বিশ্বাস। আইসিটির নিরাপদ হেল্প ডেস্ক শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। একে একটা বিশাল অগ্রগতি বলতে হবে। বড় কথা হলো, কিছু করা যাচ্ছে। সবাই এ বিষয়টি ভাবলে সাইবার অপরাধ দ্রুত কমতে থাকবে। স্কুলের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হলে শিক্ষার্থীরা শিখবে পাসওয়ার্ড কী, কী কী ভাবে অপরাধ হতে পারে। কী কী বিষয়ে সাবধানতা নিতে হবে ইত্যাদি।
সবাইকে সচেতন করতে হবে ফেসবুক, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কীভাবে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়। আমাদের ধারণার পরিবর্তন আনতে হবে। কোথাও নিজের
সন্তানের কোনো বাজে ছবি দেখলে মা–বাবার মাথা খারাপ করার কিছু নেই। সত্যিকার অর্থে কী হয়েছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যাঁরা এগুলো নিয়ে কাজ করেন, এ ক্ষেত্রে বেশি জানেন, তাঁদের সবার দায়িত্ব হলো যাঁরা জানেন না তাঁদের সচেতন করা। একদিন নিশ্চয়ই এমন একটা সকাল আসবে, যেদিন আর মানুষকে এসব বিষয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত হতে হবে না। সবাই সবার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করবেন।

তারানা হালিম: আইসিটি হলো ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ। আইসিটি আইনের দিকগুলো আইসিটি বিভাগ থেকে দেখা হচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা একসঙ্গে দেখছি। 

পর্নোগ্রাফি আইনে ছবি আপলোড, ছবি বিকৃত করাসহ বিভিন্ন আপত্তিকর কাজের শাস্তি আছে। পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হচ্ছে কম। কারণ হলো, মামলা হবে কার বিরুদ্ধে? যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হবে, সে একটি ভুয়া আইডি ব্যবহার করছে। তাহলে আমি কার বিরুদ্ধে মামলা করব?

এ আইডিগুলো চিহ্নিত করার দায়িত্বও আমাদের। কিন্তু সমস্যা হলো ফেসবুকের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি নেই। ফলে আমরা এ কাজটি করতে পারছি না। 

আমরা ডিজিটাল সব মাধ্যম ব্যবহার করতে চাই। কিন্তু প্রতিটি মাধ্যমের একটা সীমা আছে। সে সীমা কখনো পার হওয়া উচিত নয়। এ সীমা যাতে কেউ অতিক্রম না করে, সেখানেই আমাদের কাজ। আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। 

একজন নারীকে শারীরিকভাবে আঘাত করলে যতটা কষ্ট পান, তাঁর চরিত্রে কালিমা দিলে ততটাই আঘাত পান। আমাদের সমাজের মারাত্মক ক্ষতিকর মানসিকতা হলো, সব দোষ নারীকেই দেওয়া হয়। 

কোনো নারী-পুরুষের আপত্তিকর ছবি যখন ইউটিউবে দেখি, তখন নারীটি আত্মহত্যা করছে। আমার কথা, অভিযুক্ত পুরুষের কীভাবে বিয়ে হয়? সে কীভাবে সমাজে মানুষের সঙ্গে মেশে? তাকে কেন মানুষ ঘৃণা করে সমাজ থেকে বিতাড়িত করে না? আসলে পুরুষ দেখে আসছে যে তার কিছু হয় না। এ জন্যই সে বারবার অপরাধ করার সাহস করছে। 

আমাদের মানসিকতার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রযুক্তিকে যদি ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করি, তাহলে উন্নয়নের সীমা থাকবে না। নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করলে ধ্বংস অনিবার্য। এ জন্য ইন্টারনেটের নিরাপত্তার বিষয়টিতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি, যাতে আপত্তিকর শব্দগুলো না থাকে। 

অনেকে নিজেদের বৈধ হ্যাকার্স বলছে। কিন্তু তারাই যে অবৈধ কাজ করবে না তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো ভুক্তভোগী নারী যখন অভিযোগ করে, তখন ওই নারীকেই দোষারোপ করা হয়, এমন অভিযোগ পাই। অনেক নারী সংগঠনের প্রতিনিধিারাও এমন অভিযোগ করেন। অতএব, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। 

আমরা অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছি। এভাবে আসলে হবে না। আমাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তা না হলে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।

আব্দুল কাইয়ুম: ডিজিটাল অপরাধের অনেক দিক আলোচনায় এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটা আমাদের জীবনে সাফল্য এনে দিতে পারে। আবার নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করলে ধ্বংস নিয়ে আসে।

 প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের জন্য  আইন তো লাগবেই, সেই সঙ্গে সচেতনতার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুবই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি। আমাদের আশার কথা হলো, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এসব ব্যাপারে খুবই সতর্ক এবং প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। ফেসবুকের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সাইবার নিরাপত্তা চুক্তি হবে বলে আমাদের সবার প্রত্যাশা।

আলোচনায় সুপারিশ

*  আইন ও হেল্প ডেস্ক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ

*  সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেলে দ্রুত প্র​িতকারের ব্যবস্থা নেওয়া 

*  শিশু পর্নোগ্রাফি-সংক্রান্ত সব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া

*  আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেন অভিযোগ করে,​ এমন পরিবেশ তৈরি করা

*  বিটিআরসি, ফেসবুক, গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা–বিষয়ক চুক্তি করা

*  আধুনিক প্রযুক্তিগত সরঞ্জমাদি সংগ্রহ ও যথাযথ প্রশিক্ষণ

*  সাইবার ক্রাইম বিষয়ে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস তৈরি করা

যাঁরা অংশ নিলেন 

তারানা হালিম       :   প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়

মাহবুবাপান্না     :  উপসচিব, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ এবং সাবেক পরিচালক, সাইবার সিকিউরিটি

শীপাহাফিজা    :  প​রিচালক,জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি ও মাইগ্রেশন কর্মসূচি, ব্র্যাক

সাদেকাহালিম   :  অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সুরাইয়াপারভীনঅধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফরিদাইয়াসমিনউপপুলিশ কমিশনার, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, ঢাকা

তানজীব-উল-আলম :     তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ

সুপর্ণারায়        :  স্থানীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, এটুআই কর্মসূচি

লুনাসামসুদ্দোহাচেয়ারম্যান, দোহাটেক

তাসলিমামিজি   :  প্রধান নির্বাহী, টেকম্যানিয়া, ঢাকা

শাহানাসিদ্দিক   :  হেড অব কনট্যান্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন, মায়া ডটকম ডট বিডি

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম    :   সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো