পদ্মা ও গোয়ালন্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি অভিন্ন সত্তা। এই নদীপাড়েই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ। কয়েক মাইল দীর্ঘ ছিল এই বন্দর। মালবাহী স্টিমারগুলো গন্তব্যে যাতায়াতের পথে গোয়ালন্দ এসে ভিড়ত। ঘাটের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত অসংখ্য ফ্ল্যাট বাঁধা থাকত। ফ্ল্যাট হচ্ছে ইঞ্জিনবিহীন স্টিমার। পণ্যবাহী স্টিমারগুলো এসব ফ্ল্যাটের গায়ে এসে ভিড়ত। ফ্ল্যাটে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন স্টিমারের মালামাল খালাস ও বোঝাইয়ের কাজ দেখাশোনা ও তদারকি করত। স্টিমারঘাট থেকে কিছুটা ভাটিতে ছিল লঞ্চঘাট।
বাতাসের গতি একটু বেশি হলেই পদ্মা প্রমত্তা হয়ে উঠত। উত্তাল পদ্মার কারণে লঞ্চ-স্টিমার বন্ধ থাকত কখনো কখনো। প্যাডেল স্টিমারগুলো ছিল দ্বিতল। নির্মাণশৈলী এবং দুই পাশের পাখার কারণে বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টিতেও স্টিমারগুলো নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারত।

গোয়ালন্দ রুটে চলাচলরত স্টিমার এবং দীর্ঘ সেই পথের মনোজ্ঞ বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় আমলা-রাজনীতিবিদদের স্মৃতিচারণায়। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ‘টুওয়ার্ডস ইনডিপেনডেন্স, ১৯৪০-১৯৪৭ মেময়ার্স অব অ্যান ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট অশোক মিত্র’ গ্রন্থে দেখা যায়, রিভার স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) কোম্পানির স্টিমারগুলো সুন্দরবন, খুলনা ও বরিশাল হয়ে কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে যাতায়াত করত। গুয়াহাটি, এমনকি ডিব্রুগড় পর্যন্ত এগুলো যেত। তুলনামূলকভাবে বৃহদায়তনের স্টিমারগুলো ছিল ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশনের (আইজিএন)। এই কোম্পানির পরিচালনায় অস্ট্রিচ, কিউই, ইমু ও পেলিকান নামের প্যাডেল স্টিমার গোয়ালন্দ-ঢাকা, গোয়ালন্দ-চাঁদপুর রুটে চলত। সাড়ে ১২টা নাগাদ দুপুরের খাবার দেওয়া হতো লঞ্চগুলোতে। খাবারের মেনুতে থাকত চিকেন স্যুপ, ফ্রায়েড বেক্টি, বিখ্যাত আইজিএন-আরএসএন ক্যাপ্টেন চিকেন কারি এবং ক্যারামেল কাস্টার্ড।

মুরগির সেই কারির সুখ্যাতি পাওয়া যায় লেখক ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন উমরের স্মৃতিকথাতেও। তাঁর শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৪ বছর বয়সে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে প্রথমবারের মতো স্টিমারে চড়েছিলেন তিনি। স্টিমারযাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বদরুদ্দিন উমর বিবিসি বাংলাকে (২০১৬) জানান, ‘শেয়ালদা থেকে চড়তাম। ট্রেন থেকে এসে আমরা গোয়ালন্দ ঘাটে নামতাম। ট্রেনের যে টিকিট কাটতাম সেটা হতো একদম নারায়ণগঞ্জ পর্যন্তই। টিকিট আর করতে হতো না। রাস্তায় যেতে যেতে দুটো বড় স্টেশন পড়ত। একটি ছিল তারপাশা। আরেকটি ছিল মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জে যেটা দেখা যেত বিরাট বিরাট সব ঝুড়িতে সাগর কলা। স্টিমারে দুটি জিনিস খুব ভালো রান্না করত ওরা। ইলিশ মাছ আর মুরগি। মুরগির ওই কারির খুব সুখ্যাতি ছিল। আর ইলিশ মাছও রাঁধত খুব ভালো করে।’ তবে ১৮৬৮ সালের মার্চ মাসে স্টিমারে চেপে জর্জ গ্রাহামের গোয়ালন্দ পাড়ি দেওয়ার স্মৃতি মোটেও সুখকর ছিল না। ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে যোগদানের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে আসতে গিয়ে ভয়ংকর ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন সেই রাতে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয় ১৮৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। নেভিগেশন কোম্পানি এবং রেলওয়ে কোম্পানির স্টিমার তখন গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেলের যাত্রী ও মালামাল পারাপার শুরু করে। জাপান গমনকারী প্রথম ভারতীয় মহিলা হরিপ্রভা তাকেদা ১৯১২ সালে তাঁর স্বামী ওয়েমন তাকেদার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে এই রুটেই গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা যান। জাহাজে করে কলকাতা থেকে জাপান। ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ শিরোনামে ১৯১৫ সালে এই ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়।

পরিমল গোস্বামীর ‘আমাকে তবে কি ভেবেছিলেন?’ গল্পেও উঠে এসেছে প্রমত্তা পদ্মার কথা। ঝড়-ঝঞ্ঝার রাত এবং ঢাকা মেল ট্রেন, স্টিমার আর গোয়ালন্দ স্টেশনের কথা। গল্পের বর্ণনাটা ছিল এ রকম—‘১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর, তারিখটি মনে আছে। ...দশটা সাড়ে দশটায় ঢাকা মেল আসে। তবে কোন নির্দিষ্ট সময় রাখা সম্ভব হয় না, কারণ স্টীমারের সময়ের সঙ্গে তার যোগ। স্টীমার দেরীতে এলে মেল ট্রেনও গোয়ালন্দ থেকে দেরীতে ছাড়ে। যা–ই হোক, সেদিন দুর্যোগের আবহাওয়া ছিল বলে আমি একটু আগেই এসেছিলাম স্টেশনে। কলকাতা যাওয়াটা জরুরি ছিল বলেই এমন দিনেও রওনা হয়েছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি যে দুর্যোগটা এমন প্রবল হয়ে উঠবে। আশ্বিনের ঝড় বেশীর ভাগ সময়ে এমনি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। ...রাত বাড়ছে, তখন দশটা প্রায় বাজে, ঢাকা মেল ট্রেনের কোন খবর নেই, মানে ঘণ্টা বাজার কোনো লক্ষণই নেই।
প্ল্যাটফর্মটা আকাশ খোলা। বেরিয়ে আসতে হলে ঝড়ের হাতে পড়তে হয়, অতএব অসহায়ের মত বসে আছি। ঘরে কেরোসিনের যে আলোটি দয়া করে জ্বেলে দিয়ে গেছে স্টেশনের লোকেরা, তার মৃদু আলোয় এবং উগ্র গন্ধে ওয়েটিং রুমের মধ্যে এক ভৌতিক পরিবেশ। ...ঝড় ক্রমে বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন সেই ঝড়ে বিধ্বস্ত হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ আমার কানে এসে বাজছে। বুঝতে দেরী হলো না যে, এমন ঝড়ে ঢাকার স্টীমার গোয়ালন্দ ঘাটে ঠিক সময়ে এসে পৌঁছবে না। হয়তো বা স্টীমার এতক্ষণে সেই উন্মত্ত পদ্মায় ডুবেই গেছে। মনে হতেই শিউরে উঠলাম।’

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদ্মা ও গোয়ালন্দ তীরবর্তী গ্রামের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় ‘ফ্রম দ্য হুগলি টু দ্য হিমালয়াস’ গ্রন্থে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র (১৯৩৫) প্রেক্ষাপট ছিল সে সময়কার গোয়ালন্দ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্যসহ তৎকালীন গোয়ালন্দের রেল, স্টিমার, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ জমজমাট শহর জীবনের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে: ‘...নদীর তীরে, নদীর জলে, এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া স্টিমারের বাঁশি বাজিয়া উঠে।

‘সশব্দে নোঙর তুলিয়া কোনো স্টিমার ছাড়িয়া যায়, কোনো স্টিমার ভেড়ে গিয়া জেটিতে। কলিকাতা হইতে মেল ট্রেনটি আসিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের ও স্টেশনের দোকানপাট সমস্ত খোলা হইয়াছে। অনেকে নদীর জলে স্নান করিতে নামিয়াছে। মোটরবাহী ও যাত্রীবাহী অসংখ্য ছোটো–বড়ো নৌকা ঘাটে ভিড় করিয়া আসিয়াছে। ঘাটের দুদিকে বহুদূর অবধি তীর ঘেঁষিয়া, কাদায় পোঁতা লগির সঙ্গে বাঁধা আরও যে কত নৌকা তার সংখ্যা নাই। নদীতে শুধু জলের স্রোত। জলে–স্থলে মানুষের অবিরাম জীবনপ্রবাহ। মেছো নৌকার ঘাটটি একপাশে। ইতিমধ্যে অনেকগুলি নৌকা মাছ লইয়া হাজির হইয়াছে। হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকিতে স্থানটি হইয়া উঠিয়াছে সরগরম। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দরাদরি সম্পন্ন হইয়া হরদম মাছ কেনাবেচা চলিতেছে। চালানের ব্যবস্থাও হইতেছে সঙ্গে সঙ্গেই। ...পাশেই কাঠের প্যাকিং কেসে এক সারি মাছ ও এক পরত করিয়া বরফ বিছাইয়া চালানের ব্যবস্থা হইতেছে। খানিক দূরে মেইন লাইন হইতে গায়ের জোরে টানিয়া আনা একজোড়া উঁচু–নিচু ও প্রায় অকেজো লাইনের উপর চার–পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। মাছে বোঝাই হইয়া যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছাইবে। সকালে–বিকালে বাজারে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ ফিরবে বাড়ি। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ।’ কলকাতায় মাছের বাজারে অপর উৎস ছিল লালগোলা ঘাট। তবে লালগোটা ঘাট থেকে আসা মাছের পরিমাণ গোয়ালন্দ থেকে রপ্তানিকৃত মাছের তুলনায় ছিল নিতান্তই নগণ্য। অতিপরিচিত সেই ইলিশের ঘ্রাণ এখনো স্মৃতিতাড়িত করে কলকাতার প্রবীণদের। চলবে..
আরও পড়ুন: