প্রসূতির রক্তক্ষরণ পরিমাপের নতুন পদ্ধতি

সন্তান প্রসবের সময় রক্তক্ষরণ স্বাভাবিক ঘটনা হলেও তা অনেক সময় প্রসূতির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিন্তু সেই রক্তক্ষরণ পরিমাপের সহজ কোনো পদ্ধতি ছিল না। এবার তা পরিমাপের পদ্ধতি বের করেছেন মো. আব্দুল কাইউম।
নতুন এই পদ্ধতির ব্যবহার মাতৃমৃত্যু কমাতে ভূমিকা রাখবে। আব্দুল কাইউম আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহযোগী বিজ্ঞানী।
প্লাস্টিক, টিস্যু পেপার আর সাদা কাপড়ের (হাসপাতালের গজ) সমন্বয়ে তৈরি একটি ম্যাটের (মাদুর) মাধ্যমে পদ্ধতিটি কাজ করে। ১৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ১৮ ইঞ্চি প্রস্থের ম্যাটটি প্রসবের সময় প্রসূতির কোমরের নিচে রাখা হয়। প্রসবের পর যে রক্তক্ষরণ হয়, তা এই ম্যাট শুষে নেয়। রক্তে ম্যাট কতটুকু ভিজল, তা দেখে প্রসূতির ঝুঁকি আঁচ করা সম্ভব হয়। কৌশলটি অতি সরল এবং সহজে ব্যবহার করা যায়। স্বাস্থ্যকর্মী বা দাইকে সহজে এর ব্যবহার শেখানো সম্ভব।
মো. আব্দুল কাইউম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িতে প্রসবের সময় পুরোনো কাঁথা বা কাপড়ের ব্যবহার আছে। গ্রামে দরিদ্র পরিবার চট বা ছালাও ব্যবহার করে। এগুলো ব্যবহার করা হয় প্রসবের পর রক্ত মোছার কাজে। আমাদের ম্যাট দিয়ে রক্তের পরিমাণও পরিমাপ করা যাচ্ছে। এটির নাম দেওয়া হয়েছে আইসিডিডিআরবি কিউ ম্যাট।’
সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ (২০১০) বলছে, মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ তিনটি: প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (৩১ শতাংশ), একলামসিয়া বা খিঁচুনি (২০ শতাংশ) এবং বাধাগ্রস্ত বা প্রলম্বিত প্রসব (৬ দশমিক ৫ শতাংশ)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো ৭০ শতাংশের বেশি প্রসব হয় বাড়িতে, দাইয়ের হাতে। প্রসবের পর কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা অনেকেই পরিমাপ করতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, প্রতিটি প্রসবের পরই রক্তক্ষরণ হয়। রক্তক্ষরণ হয় আধা ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত। ৫০০ মিলিলিটারের (আধা কেজি) বেশি রক্তক্ষরণ হলে তাকে বলে ‘প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা পোস্টপার্টেম হেমোরেজ। এটা প্রসূতির জন্য বিপজ্জনক। এত রক্ত ঝরলে শরীরে রক্তচাপ কমে যায়। অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। কিডনি, যকৃৎ, হূৎপিণ্ড নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রসূতিকে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। কিন্তু এটা বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। এ দেশে হাসপাতালে নিতে বিলম্ব হওয়ার কারণে অনেক মা মারা যান।
আইসিডিডিআরবি কিউ ম্যাট: প্রসবের পর কোমরের নিচে রাখা ম্যাটে রক্ত পড়তে থাকে। ৪২৭ (+/- ৪২) মিলিলিটার রক্তে পুরো ম্যাটটি ভিজে লাল হয়।
ম্যাটটির ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সায়েবা আখতার বলেন, এই ম্যাট ব্যবহার করে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ পরিমাপ করা সম্ভব হচ্ছে। এই ম্যাট যদি গ্রামের দরিদ্র সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়, তবেই এর সুফল পাওয়া যাবে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক কাউসার আফসানা বলেন, গবেষণায় এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ম্যাটটি গ্রামের মানুষের হাতে পৌঁছানো।
আব্দুল কাইউম জানিয়েছেন, ব্যাপক ভিত্তিতে এই ম্যাট তৈরির কাজ শুরু হয়নি। গবেষণার জন্য এ পর্যন্ত যা তৈরি করেছেন, তাতে প্রতিটির খরচ পড়েছে ৪০ টাকা।
পেছনের কাহিনি: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে ছয়জন ছাত্রের উদ্যোগে সন্ধানী রক্তদান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মো. আব্দুল কাইউম তাঁদের একজন। তিনি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আইসিডিডিআরবিতে যোগ দেন। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে ম্যাটের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ২০০৬ সালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আজিমপুর মা ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং মাতুয়াইলের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এই গবেষণা শুরু হয়।
শুরুর দিকে ম্যাটটি ছিল দৈর্ঘ্যে ২০ ইঞ্চি ও প্রস্থে ২০ ইঞ্চি। উপকরণ হিসেবে ছিল প্লাস্টিক, ফোম ও গজ। ওই ম্যাট ৪৫০ (+/-৫৮) মিলিলিটার রক্ত শুষে নিতে পারত। পরে পরিবেশবান্ধব ম্যাট তৈরি করা হয়। যুক্ত করা হয় ভারত থেকে আনা পচনশীল প্লাস্টিক (বায়োডিগ্রেডেবল)। আর ফোমের পরিবর্তে ব্যবহূত হচ্ছে টিস্যু পেপার।
ইতিমধ্যে এই গবেষণার জন্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে অনুদানও পেয়েছেন আব্দুল কাউম। তিনি জানান, কম্বোডিয়া, মিসর ও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাটের ব্যাপারে আগ্রহ জানিয়ে যোগাযোগ করেছে। ম্যাটটি এখন একটা মানে (স্ট্যান্ডার্ড) এসেছে। তাই পেটেন্ট করার চিন্তা করা হচ্ছে।