বঙ্গীয় বদ্বীপে স্টিমার ও গোয়ালন্দ

রেলপূর্ব সময়কালে বাংলার যোগাযোগের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল নদীপথ। তন্মধ্যে পূর্বাঞ্চল ছিল সবচেয়ে সুবিধাজনক অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্র। নদীগুলো এমনভাবে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত ছিল যে জনগণ সব প্রধান স্থানেই জলপথে সহজে যাতায়াত করতে পারত। তবে বাংলার অভ্যন্তরীণ জলপথ দিয়ে পরিবহন ছিল সময়সাপেক্ষ। কলকাতা থেকে নৌকায় ঢাকা পৌঁছাতে প্রায় এক মাস লেগে যেত। 

এ অঞ্চলের নৌপথে নিয়মিত স্টিমার চলাচল শুরু হয় ব্রিটিশ নৌবিভাগের সাবেক অফিসার জনস্টনের উদ্যোগে।

১৮২৯ সালে বাংলার নদীপথে মেরিন বোর্ড চালিত সব স্টিমারের অস্থায়ী কমান্ডার নিযুক্ত হন জনস্টন। শুরুতে স্টিমারের সংখ্যা ছিল খুবই কম। দীর্ঘ সময় অন্তর এগুলো যাতায়াত করত। যার ফলে ভাড়াও ছিল বেশি এবং বুকিং পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের বহন এবং কলকাতা থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের কাজেই এগুলো ব্যবহৃত হতো।

বেঙ্গল ডেল্টা। ছবি: বাংলাপিডিয়া
বেঙ্গল ডেল্টা। ছবি: বাংলাপিডিয়া


দ্য ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন (আইজিএসএন) নামে ব্রিটিশ ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি কোম্পানি বঙ্গীয় বদ্বীপে নৌপরিবহন ব্যবসার পথিকৃৎ। কোম্পানিটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৪৪ সালে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানি, কলকাতা এবং আসাম উপত্যকার মধ্যে দুটি স্টিমার চালু করে। ছয় সপ্তাহ অন্তর সেই স্টিমার ছাড়ত।

রিভার স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) নামে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কোম্পানির অনুপ্রবেশ ঘটে ১৮৬২ সালে। পূর্ব বাংলার নৌপথে একচেটিয়া পরিবহন ব্যবসা ছিল এই দুটি কোম্পানির। এই পথের নৌব্যবসায় ‘ইস্ট বেঙ্গল রিভার স্টিমার’ নামে ভাগ্যকূল জমিদারদের একটি কোম্পানির কথাও জানা যায়। ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, বিসি এলেন এর তথ্য মোতাবেক ১৯০৭ সালে তাঁরা নৌ ব্যবসায় সংযুক্ত হন। রণদাপ্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ কোম্পানিটি নৌপথে সংযুক্ত হয় ১৯৩৩ সালে। তৎকালীন নেভিগেশন কোম্পানির আসন ব্যবস্থা, ভাড়ার হার এবং তাদের বিবিধ গন্তব্যস্থল সম্পর্কে বেশ খানিকটা আঁচ করা যায় ৩০ ডিসেম্বর ১৮৬৮ সালের ‘সংবাদ প্রভাকর’–এর বিজ্ঞাপন থেকে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ নামক কবিতায় সেকালের গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রার যে ক্লান্তিকর ও বিপদসংকুল ছবি আঁকা হয়েছে, নেভিগেশন আর রেলওয়ে কোম্পানির বদৌলতে তত দিনে সেই পরিস্থিতির যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে, বিজ্ঞাপন দেখে তা বেশ অনুভব করা যায়।

১৮৬৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকর’–এর বিজ্ঞাপন। উৎস: রেল উনিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সাহিত্যে, রমেনকুমার সর, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা:১৮৪-১৮৫।
১৮৬৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকর’–এর বিজ্ঞাপন। উৎস: রেল উনিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সাহিত্যে, রমেনকুমার সর, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, জুলাই ২০১২, পৃষ্ঠা:১৮৪-১৮৫।


সুনীল কুমার মুনশির ‘পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যায় বিশ শতকের গোড়ায় বড় বড় স্টিমার স্টেশন দিয়ে প্রতি মাসে যাতায়াতের পরিসংখ্যান। নারায়ণগঞ্জ ছিল তালিকার শীর্ষে (২৩২ বার); এরপর ছিল যথাক্রমে খুলনা (১৯২), গোয়ালন্দ (১৭৮), বরিশাল (১১৮), কলকাতা (১০৮), পটুয়াখালী (৯০), চাঁদপুর (৭৬), মারকুলি জং (৬০), শিলচর (৪৬), ডিব্রুগড় (৪৪), সিরাজগঞ্জ (৩৮), সিলেট (৩৮) এবং গুয়াহাটি (৩৪)। যাতায়াতের পরিসংখ্যানে তৃতীয় হলেও অবস্থানগত কারণে নদীপথে গোয়ালন্দ ঘাটের গুরুত্ব ছিল ততোধিক। পদ্মা নদীর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ঢাকাসহ যেকোনো জেলার মানুষের জন্য গোয়ালন্দ ছাড়া কলকাতা যাওয়ার পথ ছিল না। কলকাতা তখন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী। আধুনিক সাহিত্যের চর্চা, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা—সবকিছুরই কেন্দ্রভূমি ছিল কলকাতা। গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ-ডিব্রুগড় ছাড়াও অন্য অনেক পথে স্টিমার গোয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর, বরিশাল এবং খুলনা হয়ে কলকাতা যাতায়াত করত।

বাংলা ও আসামে ১৯০৯ সালে স্টিমার চলাচল পথ। ছবির উৎস: ওয়াটারওয়েজ ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম, সিএ হোয়াইট (১৯০৯)।
বাংলা ও আসামে ১৯০৯ সালে স্টিমার চলাচল পথ। ছবির উৎস: ওয়াটারওয়েজ ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম, সিএ হোয়াইট (১৯০৯)।


নদীপথ ছাড়াও গোয়ালন্দের দেখা মেলে সেকালের মেডিকেল গেজেটে। গোয়ালন্দ ডিসপেনসারির তথ্য জানার পর অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। ১৮৭৫ সালের ২ আগস্ট প্রকাশিত ‘দ্য ইন্ডিয়ান মেডিকেল গেজেট’–এ খুঁজে পাওয়া যায় ভিনসেন্ট রিচার্ডসের লেখা নিবন্ধ, ‘নোটস অব সার্জিক্যাল কেইসেস আন্ডার ট্রিটমেন্ট অ্যাট দ্য গোয়ালন্দ ডিসপেনসারি’। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে দেখা যায়, গোয়ালন্দ ঘাটকেন্দ্রিক ডিসপেনসারিতে যখন ছিল ৫৪ শয্যার ব্যবস্থা; ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জে তখন ছিল যথাক্রমে ২৭, ০৮, ২১ ও ১২ শয্যার ব্যবস্থা। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকার ডিসপেনসারিতে তখনো শয্যার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

সাহিত্যিক জলধর সেনের আত্মজীবনীতে দেখা যায়, গোয়ালন্দ স্কুল থেকে মাইনর পাস করে তিনি পাঁচ টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেটি এন্ট্রান্স স্কুলে পরিণত হয়। এন্ট্রান্সে পরিণত হওয়ার ২-৩ বছর পরে শিক্ষক হিসেবে সেখানে যোগদান করেছিলেন এই গুণীজন। এটা ছিল ১৮৮১ সালের কথা। সেকালের সমৃদ্ধিশালী গোয়ালন্দে শুধু এই একটি স্কুলই নয়, খুঁজে পাওয়া যায় আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোয়ালন্দ মডেল হাইস্কুল, যা পরে রাজবাড়ী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়াও ইত্যবসরে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে গোয়ালন্দের নানা স্থাপনা।

ছবির উৎস: বাংলায় ভ্রমণ (১ম খণ্ড), পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৪০, পৃ. ১১২
ছবির উৎস: বাংলায় ভ্রমণ (১ম খণ্ড), পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৪০, পৃ. ১১২


গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশন দিয়ে সেকালে আসামের চা–বাগানে শ্রমিক পাঠানো হতো। সে জন্য এখানে একটি ডিপোর ব্যবস্থা ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, এজেন্ট এবং মেডিকেল ইন্সপেক্টররা এখানে চা–শ্রমিকদের বহির্গমন ও অভিবাসনের কাজ তদারক করত। শ্রমিক নির্যাতনের এক লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী এই গোয়ালন্দ ঘাট। এ প্রসঙ্গে প্রদোষ চৌধুরী তাঁর ‘সমাজচিত্রে ভারতীয় রেল’ গ্রন্থে লিখেছেন, আসামের চা–বাগানের কুলিরা দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষণ সহ্য করতে না পেরে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে। চা–শিল্পের মালিকেরা একজোট হয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কুলিদের টিকিট বিক্রি বন্ধের অনুরোধ জানায়। বাধ্য হয়ে কুলিরা হেঁটেই দেশে চলে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করে। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত অবসন্ন কুলিরা চাঁদপুর এবং গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে রাতে বিশ্রামের জন্য উপস্থিত হয়। ১৯২১ সালের ২০ মে প্ল্যাটফর্মে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সপরিবার ঘুমিয়েছিল কুলিরা। মাঝরাতে কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদপুরের নির্দেশে ব্রিটিশ অফিসাররা এবং গোর্খা চৌকিদাররা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অসহায় হাজার হাজার কুলি পরিবার। যুগে যুগে সামাজিক ইতিহাসের পরতে পরতে এভাবেই স্থান করে নিয়েছে গোয়ালন্দ। (চলবে..)