বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিং আর নেই

সাইমন ড্রিং

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু খ্যাতনামা সাংবাদিক সাইমন ড্রিং (৭৬) মারা গেছেন। গত শুক্রবার রোমানিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়।

সাইমন ড্রিংয়ের একসময়ের সহকর্মী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে ২০১২ সালে সাইমন ড্রিংকে সম্মাননা দেয় সরকার। তিনি দ্য টেলিগ্রাফসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। গত শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশে একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠার সময় সাইমন ড্রিংয়ের তাৎপর্যপূণ ভূমিকা ছিল। এ দেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নতুন এক যুগের সূচনাকারী ছিলেন এই সাংবাদিক।

একুশে টেলিভিশনে সাইমন ড্রিংয়ের সঙ্গে প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, ‘সাইমন ড্রিংয়ের স্ত্রী ফিয়োনার কর্মস্থল রোমানিয়া। সাইমন সেখানে নিয়মিত যেতেন। গত শুক্রবার সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।’

সাইমন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অসংখ্য সহমর্মী মানুষ। যুদ্ধের মাঠে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, শরণার্থীশিবিরে, প্রতিবাদে বা জনমত গঠনে কঠিন সেই সময়ে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের একজন সাইমন ড্রিং।

দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সাইমন ড্রিং কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করতেন একাত্তরে। সে সময় লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’ সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় চলে আসেন।

সাইমন উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি।

তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। এরপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন।

ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।

৩০ মার্চ সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। এরপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর তিনি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

তথ্যমন্ত্রীর শোক

মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের আত্মদানের প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দেওয়া ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

তথ্য মন্ত্রণালয়য়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের বন্ধু সাইমন ড্রিংয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও বিশ্বব্যাপী শুভানুধ্যায়ীদের শোক সহ্য করার শক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। শোকবার্তায় তথ্যমন্ত্রী বলেন, সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষ নির্যাতন ও গণহত্যার কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত এ দেশের অকৃত্রিম বন্ধু সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে অবদান রেখেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।