বিদেশি বন্ধুদের আবার সম্মাননা দেবে সরকার

৩৩টি দেশের ৩৪৮ বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা আরও কয়েকজন বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মিসর, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ভুটানসহ ৩৩টি দেশের ৩৪৮ বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি বৈঠক হয়। তবে তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাতে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রধান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনের মাধ্যমে এবার বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হবে। মূলত সম্মাননা হিসেবে দেওয়া পদক (ক্রেস্ট) এবং মানপত্র দূতাবাসের মাধ্যমে ওই সব ব্যক্তি বা তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁদের হাতে ক্রেস্ট দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি স্বাধীনতাযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকেও সম্মাননা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।

আরও পড়ুন

এর আগে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ২১ দেশের ৩৩৮ জন বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে সম্মাননা জানায় সরকার। অন্য উপহারসামগ্রীর সঙ্গে তাঁদের একটি করে ক্রেস্টও দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা—এ তিন শ্রেণিতে সম্মাননা দেওয়া হয়। তখন সম্মাননা হিসেবে বিদেশি বন্ধুদের স্বর্ণের ক্রেস্ট দেওয়া হয়। তবে সেই ক্রেস্টে ব্যবহৃত স্বর্ণের মধ্যে খাদের পরিমাণই বেশি ছিল। এ নিয়ে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এই মার্চ মাসেই বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমাদের। বিশেষ করে ভারত, মিসর, তুরস্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এখনো সম্মাননা দেওয়া হয়নি।
আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

সম্মাননার প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা ছিল। কিন্তু পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণক ও তদারকি সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় তখন দেখা যায়, ক্রেস্টে ১ ভরি বা ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম স্বর্ণ থাকার কথা থাকলেও ছিল মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম সোনা (সোয়া ৩ আনা)। অর্থাৎ ১ ভরি সোনার মধ্যে প্রায় ১২ আনাই ছিল না। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ঢাকার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে তখন বলা হয়েছিল, ‘প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সত্যতা মিলেছে।’

নতুন করে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মার্চ মাসেই বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমাদের। সেটি করতে না পারলেও দ্রুতই কাজটি শুরু করতে চাই আমরা। বিশেষ করে ভারত, মিসর, তুরস্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এখনো সম্মাননা দেওয়া হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আগে যেহেতু স্বর্ণের ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছে, এবারও তাই হবে। তবে এবার আমরা নিজেরা তদারক করব, যাতে কোনো ত্রুটি না হয়।’

ক্রেস্ট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘এটা ঠিক, বিষয়টি আর এগোয়নি। তবে এ বিষয়ে যে তদন্ত হয়েছিল, সেই প্রতিবেদন আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়েছি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’ তবে এরপর অগ্রগতি কী, সেটি জানাতে পারেননি তিনি।

বিতর্ক এড়াতে এবার আগেই স্বর্ণের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে মন্ত্রণালয়। পরমাণু শক্তি কমিশনে এ পরীক্ষা হবে। ক্রেস্টে ব্যবহার করা স্বর্ণের উপাদান ও মান নিশ্চিত করার পরই তা বিদেশি বন্ধুদের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান।

সম্মাননা প্রদানের তালিকাসংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের এ সম্মাননা দেওয়া হবে, তাঁদের অধিকাংশই এখন জীবিত নেই। তাঁদের পরিবার–পরিজনকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তালিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছেন তাঁরা।

ক্রেস্ট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এখনো বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, আগের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিচার এবং সম্মাননা প্রদান দুটি দুই বিষয়। তবে অপরাধীদের বিচার না হওয়া হতাশাজনক।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কারা এ সম্মাননা পেতে পারেন, তা নির্ধারণ করতে একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করা হয়েছিল ২০১১ সালে। ওই তালিকা অনুযায়ী এখনো ৩৩ দেশেরে ৩৪৮ জন সম্মাননা পাননি। এখন নতুন করে এ তালিকা হালনাগাদ করা হবে। তালিকার বাইরেও যদি মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের নাম জানা যায়, তাহলে যাচাই-বাছাই করে তাঁদের নাম যুক্ত করা হবে। এবারের তালিকায় কোনো একটি রাষ্ট্র বা কোনো একটি অঞ্চলের প্রাধান্য যাতে না থাকে, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকায় অবস্থান করা বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন ও দূতাবাসকে যুক্ত করলে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের নাম, ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। প্রসঙ্গত, বিদেশি বন্ধুদের খোঁজ করতে মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ও ব্যবস্থাপনায় সম্প্রতি ভারতের কলকাতা ঘুরে এসেছেন তিনি। স্থানীয় সাংবাদিক, লেখক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এ বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, ৩০ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছেন।