সংকট বড়, মনোযোগ কম

প্রতিরোধে অসংখ্য প্রস্তাব। উদ্যোগ কম। বাজেটও সীমিত। কত বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সে তথ্যটিও সরকারের কাছে নেই।

দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অসংখ্য কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব নিয়ে সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এএনপি) তৈরি করেছে বেশ আগেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে যুক্ত করা হয়েছে ২৫টি মন্ত্রণালয়কে।

রাশেদা কে চৌধূরী

উন্নয়ন সংস্থা, অধিকারকর্মী ও গবেষকদের মতে, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, প্রস্তাবিত কার্যক্রমের সঙ্গে বাজেট বরাদ্দের ফারাক, সময় গড়িয়ে গেলেও প্রস্তাব বাস্তবায়নে উদ্যোগ না নেওয়া, সর্বোপরি তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি স্পষ্ট করছে, বাল্যবিবাহ নির্মূলের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। বাল্যবিবাহের সংকট বড় হলেও তা মোকাবিলায় খুব কমই নজর দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে এ সংকটকে আরও গুরুতর দেওয়া হচ্ছে।

বাল্যবিবাহ নির্মূলে দেশে আইন, নীতিমালা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব নেই। তবে তা বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।
রাশেদা কে চৌধূরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কত বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সে তথ্য নেই সরকারের কাছে। কেবল প্রতিরোধ কত হয়েছে, সেই তথ্য আছে।

করোনাকালে বাল্যবিবাহের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য।’

বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে প্রধানত তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয় বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়ে মেয়েটি সামনে এগোতে পারে না, অকাল গর্ভধারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে এবং সে নিজে ও তার সন্তান অপুষ্টিতে ভোগে। এ বিষয়গুলো পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়।

বাল্যবিবাহ
প্রতীকী ছবি

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাল্যবিবাহ নির্মূলে দেশে আইন, নীতিমালা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব নেই। তবে তা বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। করোনাকালে সামাজিক সচেতনতার অভাব ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। সরকারি তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সরকারকে দেখতে হবে কোথায় কী ঘাটতি রয়েছে, এর ভিত্তিতেই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং বিনিয়োগ করা সম্ভব।

অঙ্গীকার পূরণে হোঁচট

২০১৪ সালের ২২ জুলাই লন্ডন গার্লস সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক–তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূলের অঙ্গীকার করেন। এরপরই ২০১৮ সালকে ভিত্তি ধরে স্বল্প (২০১৮-২১), মধ্য (২০১৮-২৫) এবং দীর্ঘ মেয়াদে (২০১৮-৩০) মোট ২৩৫টি কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে এএনপি ঘোষিত হয়।

বিভিন্ন বেসরকারি তথ্য–উপাত্ত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ কমানোর লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়নি।

বাল্যবিবাহ নির্মূলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান করে ২৯ সদস্যের জাতীয় কমিটি ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি গঠিত হয়। কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আছেন। গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রথম এ কমিটির বৈঠক হয়। পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার অভাবে ওই বৈঠকে বাল্যবিবাহ নির্মূলে কাজের কোনো অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরতে পারেনি মন্ত্রণালয়গুলো। স্বল্প মেয়াদে শুধু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৬৯টি প্রস্তাবিত কার্যক্রম রয়েছে, যার কোনোটিই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেদের বিয়ের জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয়েছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে, বিশেষ বিধানের আওতায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

প্রস্তাব ও বরাদ্দে বিস্তর ফারাক

বাল্যবিবাহ নির্মূলে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাব ও বাজেট বরাদ্দ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশার নেতৃত্বে ‘অ্যানালাইসিস অব পাবলিক বাজেট অ্যালোকেশন ফর দ্য ইফেকটিভ ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান টু এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ’ (বাল্যবিবাহ নির্মূলে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ করা জাতীয় বাজেট বিশ্লেষণ) শিরোনামে একটি গবেষণা হয়। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) জন্য করা প্রতিবেদনটি গত বছরের ৬ ডিসেম্বর জমা দেন তিনি।

ওই গবেষণায় সায়মা হক দেখান, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২০২১-২২–এর বাজেট বরাদ্দের শীর্ষ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের জন্য ভূমিকা রাখবে এমন তিন মন্ত্রণালয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নেই। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তিনটি অর্থবছর ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১–এর দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দের ১ শতাংশের কম রাখা হয়েছে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সবচেয়ে বেশি কার্যক্রম থাকা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য।

অধ্যাপক সায়মা হক প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অনেক প্রস্তাব নেওয়া হলেও সরকারি বাল্যবিবাহ নির্মূলে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি অনেক কম। প্রস্তাবের তুলনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দও অনেক কম। শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাল্যবিবাহ নির্মূলে ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও এসব সরাসরি কার্যক্রম নয়। সামাজিক সচেতনতা ও আইনি বিষয়গুলোর সরাসরি কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন ও বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার পায়নি।

আরও পড়ুন

করোনাকালের চিত্র

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে ২১ জেলার ৮৪টি উপজেলায় ‘র‌্যাপিড অ্যানালাইসিস অব চাইল্ড ম্যারেজ সিচুয়েশন ডিউরিং কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের জরিপে ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহের তথ্য পাওয়া যায়। মেয়েদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বয়স ১৬–১৭ বছর, ৪৮ শতাংশের ১৩–১৫ বছর এবং ২ শতাংশের বয়স ১০–১২ বছর ছিল। বাল্যবিবাহ বেশি হয়েছে বরগুনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লক্ষ্মীপুরে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়। ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয় ১৫ শতাংশের।

সায়মা হকের গবেষণায় এসেছে, সবচেয়ে বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জে (৭২ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম সিলেটে (২৫ শতাংশ) বাল্যবিবাহের প্রবণতা রয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ফোন পেয়ে ৮ হাজার ২৫৪টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।

সরকারি পদক্ষেপ কতটুকু বেড়েছে

গত বছর সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহের শিকার এক মেয়ের (১৫) বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো পাত্র’ পাওয়ায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজ বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করেন, কেউ তাতে বাধা দেয়নি।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ের কয়েকজন অধিকারকর্মী জানান, যেসব জেলায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে, সেখানে এখন বাল্যবিবাহ আয়োজনের খবর পেলে প্রশাসন থেকে এসে বাধা দেয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধে কমিটি থাকলেও সেগুলো খুব সক্রিয় নয়। অনেক জনপ্রতিনিধি বাল্যবিবাহ নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। ফলে ১০০টি বাল্যবিবাহ হলে পাঁচটির খবর পায় প্রশাসন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দুই শতাধিক কমিটির সভাপতি। এত বৈঠক করার মতো বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে এক বৈঠকেই ৮–১০টি কমিটির বৈঠক করে ফেলেন তাঁরা। বাল্যবিবাহ ইস্যুতে আলোচনা না হলেও সরকার দেখে বৈঠক হয়েছে।

তবে নাটোরের গুরুদাসপুর ইউএনও মো. তমাল হোসেন জানান, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিলবোর্ড স্থাপন, উঠান বৈঠকসহ সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, বাল্যবিবাহ নিরোধে উপজেলা কমিটির বৈঠক করোনাকালেও ব্যাহত হয়নি।

আরও পড়ুন

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (শিশু ও সমন্বয় শাখা) অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে বাল্যবিবাহ বাড়ায় মন্ত্রণালয়ের চারজন অতিরিক্ত সচিবকে আটটি বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অমিক্রনের ঢেউয়ে এ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে স্বাস্থ্যের দিকে নজরদারি বেড়ে যাওয়ায়, প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ কমে গেছে।

একটি বাল্যবিবাহ রোধে ক্ষতি কমবে পৌনে ৪ লাখ টাকা

২০১৯ সালে বিয়ে হয় নীলফামারীর নবম শ্রেণিতে পড়া একটি মেয়ের (১৫)। দেড় বছরের মধ্যে সে ছেলের জন্ম দেয়। মেয়েটি প্রথম আলোকে বলে, লেখাপড়ার অনেক শখ ছিল। কম বয়সে সন্তান হওয়ায় দুর্বল লাগে, ছেলেও অপুষ্ট।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুসারে, প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহের মধ্যে ৫ হাজার ৮৯টি মেয়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছে।

সায়মা হকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ না হলে মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে কাজ করতে সক্ষমতা বাড়বে, হাসপাতালের খরচ কমবে। এসব বিবেচনায় একটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আর্থিক ক্ষতি কমানো সম্ভব আনুমানিক ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন

জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার সময় এর ফোকাল পারসন ছিলেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বললেন, বাল্যবিবাহ নির্মূলে আইন ও বিধি সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচার করা দরকার। জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যে কমিটির সে কাজ করার কথা, তা সুচারুভাবে করতে হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।