সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জেলায় মিলনায়তনের অভাব

নেত্রকোনায় নিয়মিত অনুষ্ঠান করার মতো কোনো মিলনায়তন নেই। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একমাত্র ভরসা জেলা পাবলিক হল। সেটি আবার সব সময় দিবসভিত্তিক সরকারি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে। এ ছাড়া আধুনিক কোনো সুবিধা না থাকলেও হলের ভাড়া গুনতে হয় মাত্রাতিরিক্ত।

জানতে চাইলে নেত্রকোনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, নেত্রকোনা একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ১৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও জায়গার অভাবে অত্যাধুনিক নকশায় মিলনায়তন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। ওই নকশায় মিলনায়তনের জন্য ৮৭ শতক জায়গা প্রয়োজন। নকশা পরিবর্তন করা গেলে শহরের মোক্তারপাড়া পৌরসভার সামনে প্রধান সড়কের পাশে জেলা পরিষদের সাড়ে ১০ হাজার বর্গফুট জায়গায় একটি আধুনিক মিলনায়তন করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহুকাল থেকেই নেত্রকোনা সাংস্কৃতিক চর্চায় যথেষ্ট অগ্রসর। শান্তিনিকেতনের বাইরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হয় এখানেই। প্রগতিশীল সংগঠন ‘উদীচী’র ঢাকার বাইরে প্রথম শাখা খোলা হয় নেত্রকোনায়। এখানে নাটক, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তির চর্চা করে এবং প্রশিক্ষণ দেয়, এমন সক্রিয় সংগঠনের সংখ্যা ২৫-এর বেশি। যাত্রায় ও নাটকে নেত্রকোনায় বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বলেন, ‘তরুণ সমাজকে সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। জেলায় আধুনিক মিলনায়তন না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক।’

শহরের মোক্তারপাড়া এলাকায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির কাছে একটি আধুনিক মিলনায়তন ছিল। পৌরসভার জায়গায় ১৯৭৯ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সেটি নির্মাণ করে। নাম দেওয়া হয় ‘মহুয়া অডিটোরিয়াম’। নির্মাণের পর শিল্পকলা একাডেমি এটি তাদের দাবি করে আদালতে মামলা করে। মামলার রায়ে এটি পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে চলে। কিন্তু সর্বশেষ ভূমি জরিপে জায়গাটি সরকারের নামে চলে যায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে এটি জরাজীর্ণ হতে থাকে। ছয় বছর আগে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে ভবনে সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মিলনায়তনের অভাবে জেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এখন অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সানওয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সাহিত্য, নাটক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ৩০টির মতো সংগঠন থাকলেও হাতে গোনা তিন-চারটি সংগঠন ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। অনেক সংগঠন এখন বিলুপ্তির পথে।

শহরের একমাত্র মিলনায়তন ‘জেলা পাবলিক হল’ ১৯৬০ সালে নির্মিত। আধা পাকা পুরোনো ভবনটি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এতে নেই কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ শতাধিক মানুষের ধারণক্ষমতা থাকলেও প্লাস্টিকের চেয়ার আছে ৩০০টি। শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্র (এসি) নেই। নেই পুরুষ ও নারী শিল্পীদের জন্য কোনো পৃথক প্রসাধনকক্ষ। কক্ষের এক কোণে আছে একটি মঞ্চ। তবে হলটি দিবসভিত্তিক সরকারি গৎবাঁধা অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত থাকে। থাকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিও। ফলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর তেমন সুযোগ মেলে না। আবার এটির ভাড়াও অনেক বেশি। প্রতি অনুষ্ঠানে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা ভাড়া গুনতে হয়। আর্থিকভাবে দুর্বল সংগঠনগুলোর তা কুলানোর সাধ্য নেই।

সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলছেন, সরকারি দলের আজ্ঞাবহ শিল্পীদের ধরাবাঁধা এবং পুরোনো কিছু পরিবেশনা ছাড়া অনেক দিন ধরে জেলায় ব্যতিক্রম কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন নেই। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহ করতে না পারা এবং সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে অনেকটাই হীনম্মন্যতা বোধ এর জন্য দায়ী। জেলা শিল্পকলা একাডেমি এ বিষয়ে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু সেটিও হচ্ছে না। এমনকি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতেও মিলনায়তন নেই।

জেলা প্রশাসক মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, মামলা জটিলতার জন্য পুরোনো মিলনায়তনটির জায়গায় নতুন করে নির্মাণ করা যাচ্ছে না। আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। সুবিধামতো জায়গা পেলে দ্রুত তা নির্মাণ করা হবে।