স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দ তাঁদের

পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড়। গতকাল বিকেলে
ছবি: সাজিদ হোসেন

আরিফুল ইসলামের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার আমিরাবাদ, চাকরি করেন ঢাকায়। নিজে থাকতেন ঢাকায় ছোট্ট একটি মেসে, আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যেতেন মাদারীপুরের বাড়িতে। আরিফুল ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘২৬ জুন থেকে বাড়ি থেকে গিয়েই ঢাকায় অফিস করব। বাড়ির মানুষের সঙ্গে থাকব।’ তাঁর সঙ্গে কথা হলো গতকাল শুক্রবার বিকেলে, মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে।

আজ ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে উচ্ছ্বাসে ভাসছেন দুই পারের বাসিন্দারা। কারণ, তাঁদের দীর্ঘদিনের কষ্ট ও দুর্ভোগের অবসান হতে যাচ্ছে আজ। যে নৌপথে ব্যয় করতে হতো কমপক্ষে দুই ঘণ্টা, সঙ্গী হতো নানা দুর্ভোগ–কষ্ট; আজ থেকে সে পথ পার হওয়া যাবে মাত্র সাত মিনিটে। এই আনন্দ ছুঁয়ে গেছে দুই পারের মানুষকে। আর আনন্দ উদ্‌যাপনে পদ্মা সেতুর দুই পার সেজেছে নানা আয়োজনে।

গতকাল ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে মহাসড়কের দুই পাশে ও সড়ক বিভাজকে নানা ধরনের ব্যানার, বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। এসব বিলবোর্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ অনেকেই। বিলবোর্ড দেখা গেছে শিমুলিয়া ও মাওয়া পুরোনো ঘাটে যাওয়ার সড়কেও। রয়েছে রংবেরঙের আলোকসজ্জা।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ শিকদার জানালেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘিরে শিমুলিয়া ঘাটে তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। পোড়ানো হবে আতশবাজি। অপর দিকে জাজিরায় টোল প্লাজা থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে সাজিয়েছেন স্থানীয় নেতারা। বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি। পদ্মা সেতুর নাওডোবা টোল প্লাজা থেকে সাড়ে দশ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও কাঁঠালবাড়ি জনসভাস্থল পর্যন্ত সড়কে বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক ছবি। রয়েছে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন সময়ের কার্যক্রমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। এসব বিলবোর্ড স্থাপন করেছে সেতু বিভাগ।

পদ্মা সেতু ও সেতুসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে জমি দেন লৌহজংয়ের মাওয়া এলাকার বাসিন্দা রাসেল হোসেন। রাসেল জানালেন, ‘আমাদের এলাকার মানুষ তাঁদের বাপ–দাদার বসতভিটা ছেড়ে দিয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন। এখন সেতু হওয়ায় সবাই গর্বিত।’

একইভাবে অধিগ্রহণ করা হয় জাজিরার নাওডোবার বাদল জমাদ্দারের পরিবারের ২০ বিঘা জমি। সেতু উদ্বোধন ঘিরে তাঁর বাড়িতে শুরু হয়েছে উৎসব। বাড়িতে এসেছেন আত্মীয়স্বজন। তাঁদের আপ্যায়ন করতে মাছ, মাংস, ফলমূল, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও উপহারসামগ্রী আনা হয়েছে। অতিথিদের আপ্যায়ন করতে বাড়ির নারী সদস্যরা তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের পিঠা।

উচ্ছ্বসিত বাদল জমাদ্দার বললেন, ‘পদ্মা নদী আমাদের দুঃখের বড় কারণ ছিল। সেতু সেই দুঃখ ঘুচিয়ে আমাদের জীবনে আনন্দ আনবে। বাড়ি থেকে এক ঘণ্টায় ঢাকা যাব, ভাবলেই স্বপ্ন মনে হয়।’

গতকাল সকালে শিমুলিয়া ঘাটে প্রাইভেট কারে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন বাগেরহাটের আফরোজা আক্তার। বললেন, ‘আজ ফেরিতে করে পার হচ্ছি। কিন্তু ঢাকায় ফিরব সেতু পার হয়ে।’

ঝালকাঠির রাজাপুরের বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেনের বয়স ৫০ বছর। ৩০ বছর যাবৎ ঢাকার শাজাহানপুরে থাকেন। ১৯৯৬ সাল থেকে সড়কপথে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি হয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করছেন। নদীর স্রোত, ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশায় দিনের পর দিন দুর্ভোগে পড়তে হতো তাঁকে। ১০ বছর ধরে কেবল দুই ঈদে বাড়ি যেতেন। গতকাল শেষবারের মতো নৌপথে বাড়ি গেছেন তিনি। রোববার ফিরবেন সেতু পার হয়ে। উচ্ছ্বসিত সাখাওয়াত বলেন, ‘আর কষ্ট নেই। এখন আমি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি যেতে পারব।’

দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসছেন পদ্মা সেতু এলাকায়। শিমুলিয়া ঘাটে কথা হলো আহাদুল ইসলামের সঙ্গে, যার বাড়ি নীলফামারী জেলায়। তাঁর কথা, এই সেতু পার হয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে যাবেন না। কিন্তু তিনি এসেছেন দেশের এত বড় একটা অর্জনের সাক্ষী হতে। উদ্বোধনের দিন আজই তিনি সেতুতে উঠতে চান বলে জানালেন।