শিল্পকারখানা হবে, কৃষিতে উন্নয়ন ঘটবে

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল
প্রথম আলো

আজ ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। এই সেতু নির্মাণ ও তদারকিতে যুক্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। আজ ছাপা হলো অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সাক্ষাৎকার। ১৮ জুন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দেশের মানুষের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে, কিন্তু এটা তো বিশ্বব্যাংকসহ অন্য আরও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদের ঋণের অর্থে হওয়ার কথা ছিল। তারা শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল কেন?

মুস্তফা কামাল: বিনা কারণে ফিরে গেছে বিশ্বব্যাংক। একজন সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক আমি। সে হিসেবে বলতে পারি যে প্রকল্পে একটি টাকাও খরচ হয়নি, সেখানে দুর্নীতি কোত্থেকে আসবে? পরে দেখলাম যে ‘না’ করার পরও বিশ্বব্যাংক আশা ছাড়েনি। তত দিনে নিজেদের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছি। আমরা তখন বললাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেশের মানুষ ‘হ্যাঁ’ বললে হবে। অন্যথা কোনো উপায় নেই। ভুল–বোঝাবুঝি যা–ই হোক না কেন, ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছি যে আমরা তাদের অপছন্দ করি না। ভুল স্বীকার করে তারা (বিশ্বব্যাংক) পুরো দল নিয়ে পরে এসেছিল।

প্রশ্ন:

কেন এসেছিল?

মুস্তফা কামাল: পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে। বলেছি, অন্তত পদ্মা সেতুতে আর সুযোগ নেই। অন্য প্রকল্পে তারা থাকতে পারেন। আমরা যে বৈঠক করেছি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে তার প্রমাণ পাবেন।

প্রশ্ন:

এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ব্যয় হলো ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। বেশি ব্যয়ের সমালোচনা করেন অনেকে।

মুস্তফা কামাল: এখানে অনেক বিষয় আছে। শুধু পদ্মা সেতুর ব্যয়ের কথা বললে হবে না। মানুষকে পুনর্বাসন করতে হয়েছে। জমি কিনতে হয়েছে। অনেক রাস্তা করতে হয়েছে। নদীশাসনের বিষয়টিও আগে ছিল না। এটা যুক্ত হয়েছে। রেল যুক্ত হয়েছে। তাই খরচ বেড়েছে। শুধু টাকা দিয়ে মেলাতে চাইলে হবে না। অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক যাঁরা আছেন, তাঁরা ভালো বুঝবেন। এর যে সম্মান, ইজ্জত—সারা বিশ্বের কাছে নিয়ে গেছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রীর হিরণ্ময় নেতৃত্ব এবং সরকারের স্থায়িত্বশীলতার কারণে এ সেতু হয়েছে। নইলে এক সরকার আসত, অন্য সরকার তা ফেলে চলে যেত।

প্রশ্ন:

পদ্মা সেতু হওয়ার জন্য কার অবদানকে আপনি এক নম্বরে রাখবেন?

মুস্তফা কামাল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান।

প্রশ্ন:

সেতু নির্মাণে যত ডলার ব্যয় হলো, তার অন্যতম অংশ তো এল প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত আয় থেকে। কিন্তু তাঁদের কোনো স্বীকৃতি নেই কোথাও।

মুস্তফা কামাল: অবশ্যই তাঁদের প্রত্যেকের অবদান আছে। তাঁরা প্রবাসী আয় না পাঠালে পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্প হতো না। এবার আমরা তাঁদের স্বীকৃতি দেব। দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া বা বিদেশ থেকে দেশে আসার ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য ফরম পূরণসহ সব ধরনের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

প্রশ্ন:

পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে কতটি জেলার কত মানুষ উপকার পাবেন এবং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কত বাড়বে?

মুস্তফা কামাল: তিন বিভাগের ২১ জেলার অন্তত চার কোটি মানুষ উপকার পাবেন। আর জিডিপির হার বাড়বে এক থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। জিডিপি পরিমাণে বাড়বে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলার (প্রতি ডলার ৯২ টাকা হিসেবে ৮০০ কোটি ডলারে হয় ৭৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)।

প্রশ্ন:

এ বৃদ্ধি কত সময়ে হবে?

মুস্তফা কামাল: প্রতিবছর। আঞ্চলিক জিডিপি আরও বেশি বাড়বে। শিল্পকারখানা হবে, কৃষিতে উন্নয়ন ঘটবে, ওই এলাকার মানুষই বেশি উপকৃত হবেন।

প্রশ্ন:

ওই এলাকায় শিল্পকারখানা হওয়ার জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের কী ব্যবস্থা থাকবে?

মুস্তফা কামাল: আপনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?

প্রশ্ন:

পরিকল্পনা কী আছে, যদি বলতেন...

মুস্তফা কামাল: অবশ্যই আছে। এই প্রকল্প যখন উন্মুক্ত হয়ে যাবে, ব্যবসায়ের খরচ কমবে। যে অঞ্চলে যে জিনিস আছে এবং যেখানে ওই জিনিসের চাহিদা বেশি, সেখানে চলে যাবে।

প্রশ্ন:

গ্যাস-বিদ্যুতের কথা জানতে চেয়েছিলাম।

মুস্তফা কামাল: আমরা তো চিন্তা করিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাবে। যুদ্ধ থেমে যাবে। আর আপনি জানেন যে গ্যাস পাওয়া গেছে ভোলায়। ওটা উত্তোলন করা হবে। ইয়েমেন, ইরানসহ অনেক দেশ পাইপলাইন তৈরি করে সাগরের নিচ দিয়ে গ্যাস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়। বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নেই।

প্রশ্ন:

নিজস্ব অর্থায়নের পরিবর্তে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু করলে বিদ্যমান ডলার–সংকট একটু কম হতো না?

মুস্তফা কামাল: আমরা বহুপক্ষীয় ঋণ নিচ্ছি কম সুদে। বাণিজ্যিক ঋণ নয়। কঠিন শর্তের ঋণ নেই আমাদের। সব সহজ শর্তের। ঋণ-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম আমাদের।

প্রশ্ন:

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কাউকে নিমন্ত্রণ করেছেন?

মুস্তফা কামাল: (হাসি)। এটা তারা ভুলে গেছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ে গিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আসুন। দেখুন, তাদের মানসিকতা কী এবং বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছে। ওখানে তো ব্যবস্থাপনা বদলায়। ২০১২-১৩ সময়ে যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি চলে গেছেন এখন জাপানে। হয়তো তখন বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল প্রকল্পটা অনেক বড়, ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনা করা যাবে না, বলতেও লজ্জা লাগে। তাই তখন ‘না’ করেছিল।

প্রশ্ন:

দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কী অবদান রাখবে এ পদ্মা সেতু?

মুস্তফা কামাল: অর্থনীতি আগের চেয়ে গতিশীল হবে। কম সুদে ঋণ পাওয়া সহজ হবে বিদেশ থেকে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। দেশের স্থিতিপত্র দেখে বিদেশিরা বিনিয়োগ করেন। এখন তো বিনিয়োগ খুব আসে না। এখন পদ্মা সেতু হলো, উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলেই বিনিয়োগ কী হারে আসে দেখতে পাবেন। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাওয়ার পর যে পরিমাণ আমরা হারাব, তার চেয়ে বহুগুণ পাব।

প্রশ্ন:

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যেহেতু কম সময়ে মানুষ ঢাকায় আসতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে ঢাকার ওপর বেশি চাপ পড়ার কোনো আশঙ্কা আছে কি না। এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?

মুস্তফা কামাল: এটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এটা নিয়ে কাজ করছে। ‘বিউটিফুল ঢাকা’ নামে একটা প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বিশ্বব্যাংক। শহরটাকে আমরা চারদিক থেকেই সম্প্রসারণ করছি। এই ফাঁকে হয়ে যাচ্ছে মেট্রোরেল। ঢাকায় তখন আসবে যেমন মানুষ, চলেও যাবেন তারা।

প্রশ্ন:

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদীর ওপর সেতু হলে নদীর বুকে চর পড়ে। সেতু তৈরি হওয়ায় পদ্মা নদীর কোনো ক্ষতি হবে না তো?

মুস্তফা কামাল: পদ্মা নদীর কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, নদীশাসন প্রকল্প আছে। আজ আছে কাল নেই—এমন প্রকল্প নয়। নদীশাসন প্রকল্পটি সব সময়ের জন্যই থাকবে। সব দিক বিবেচনা করেই এ সেতু করা হয়েছে। সবশেষে আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের অহংকার, পদ্মা সেতুও আমাদের অহংকারের আরেক নাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মুস্তফা কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।