নিজেকে ‘সুখী মানুষ’ মনে করেন রেজাউল

খেলার মাঠে ক্যামেরা হাতে ক্রীড়া আলোকচিত্রী রেজাউল করিমছবি: সংগৃহীত

মুখের ডান পাশে কালচে জন্মদাগের জন্য রেজাউল করিম নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে রাখেন। তবে সেই ছোটবেলাতেই তিনি বুঝেছিলেন, এ দাগ জীবনে যাতে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

রেজাউল বললেন, ‘মা সুলতানা বেগম ছোটবেলা থেকে মাথার মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন, এ দাগ সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিশেষ চিহ্ন; যে কারণেই আমি হয়তো বেঁচে আছি। আমার জন্মের আগে মা–বাবার ৯ সন্তান জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেছেন। আমার জন্যই তাঁরা প্রথম মা–বাবা ডাক শুনেছেন। আমার দুই ছেলেমেয়েও বলে, এ দাগের জন্যই নাকি তাদের বাবা দেখতে এত সুন্দর। সব মিলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান, সফল ও সুখী মনে করি।’

ছেলে হওয়ার কারণেই হয়তো মুখের বিকৃতি বা এ কালো দাগ নিয়ে সমাজে যতটা ভোগান্তি পোহানোর কথা ছিল, বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় যেমন হয়, তেমনটা হয়নি বলে মনে করেন রেজাউল।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের জন্মদাগকে হেম্যানজিওমা বলে। জীবনে নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে রেজাউল করিম বর্তমানে ওয়ালটন গ্রুপের মিডিয়া প্রতিষ্ঠান রাইজিংবিডি ডটকমের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্রীড়া ফটোগ্রাফার হিসেবেও দেশ–বিদেশে সুনাম কুড়াচ্ছেন তিনি। ২০১৩ সাল থেকে স্পোর্টস ফটোগ্রাফার হিসেবে বাংলাদেশের সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে বিশ্বকাপ এবং এশিয়া কাপে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভ্রমণ করেছেন প্রায় ১৭টি দেশ।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভার সুয়াবিল গ্রামে জন্ম রেজাউলের। তবে বাবা সামছুল আলমের চাকরি সূত্রে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছেন কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে মা, স্ত্রী শাহিনা আকতার, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে তাহসিন রেজা ফারহান ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তানজিনা রেজাকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার।

গতকাল বৃহস্পতিবার কথা হয় রেজাউল করিমের সঙ্গে। জানালেন, তাঁর বাবা চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিলে স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন। তাই অভাব–অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। চন্দ্রঘোনা পাহাড়িকা উচ্চবিদ্যালয় ও রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন।

রেজাউলের বাবা মারা গেছেন ২০০৮ সালে। বাবা মারা যাওয়ার পর এবং বাবা বেঁচে থাকতেও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। এসএসসি পাসের পর বাবা কর্ণফুলী পেপার মিলে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। মাসিক ৬০০ টাকা বেতনে আট ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমের জীবন ছিল তখন। কাজ করতে করতেই কাপ্তাইয়ের একটি স্থানীয় ট্যাবলয়েড পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে বিনা বেতনে কাজ শুরু করেন তিনি। পরে চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে কাপ্তাই সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পান।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের জন্মদাগকে হেম্যানজিওমা বলে। জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রেজাউল করিম বর্তমানে ওয়ালটন গ্রুপের মিডিয়া প্রতিষ্ঠান রাইজিংবিডি ডটকমের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্রীড়া ফটোগ্রাফার হিসেবেও দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়াচ্ছেন তিনি।

নিজের জীবনের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে ওয়ালটন ছাড়াও প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন রেজাউল করিম। জানালেন, প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিভাগের প্রকাশনা ‘আলোকিত চট্টগ্রামে’ প্রায় পাঁচ বছর প্রদায়ক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি; যা তাঁকে চট্টগ্রামে সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচিতি বাড়াতে সহায়তা করে।

রেজাউল বললেন, ‘শ্রমিক হিসেবে লোহার ভারী বোঝা বয়েছি। পড়াশোনা করি, তাই অনেককে অনুরোধ করেছি, অফিস সহকারী বা লেখালেখির কাজ দিতে। অনেকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতাও করেছেন।’

তিন বোনকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই রেজাউল করিমের। পরিবারে অভাব থাকার পরও তিন বোনই শিক্ষিত হয়েছেন। বাবা এক বোনকে বিয়ে দিয়ে গেছেন। অন্য দুই বোনের পড়াশোনা ও বিয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন রেজাউল। বড় বোন কুলছুমা বেগম গৃহিণী। মেজ বোন রহিমা আকতার রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আর আরেক বোন কামরুন নাহার পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর।

রেজাউল করিম বলেন, ‘বোনদের পড়াশোনার জন্য নিজে প্রাইভেট পড়িনি। তারপরও মাত্র ৬০০ টাকার জন্য ছোট বোনের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া প্রায় আটকে গিয়েছিল। বোনেরা এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের ভাইবোনদের জন্য কষ্ট করেছে, এটা সব সময় মনে রাখে। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইকে তারা বাবার মতোই শ্রদ্ধা করে। বোনেরা বেতন পেয়ে জানতে চায়, আমার কিছু লাগবে কি না।’

রেজাউল করিমের ছেলেমেয়ে
ছবি: সংগৃহীত

পোড়াতে হয়েছে কাঠখড়

রেজাউল এখন নিজেকে সুখী মানুষ ভাবলেও এ পর্যায়ে আসতে তাঁকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে চলে এসেছে মুখের জন্মদাগ। শুধু এ দাগের জন্যই জীবনে তেমন কোনো বন্ধু হয়নি। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসতেন। দাগের জন্য মানুষ যখন মা–বাবাকে কথা শোনাতেন, তা সহ্য করা ছিল কঠিন।

রেজাউল করিম বলেন, ‘কিশোর বয়সে কে কী বলবে, তা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতাম। কেউ আমাকে উপেক্ষা করলে কান্না পেত। আড়ালে চোখের জল ফেলতাম। কোথাও গেলে মানুষ সরাসরি কিছু না বললেও আমাকে নিয়ে অস্বস্তিবোধ করছে, বুঝতে পারতাম। সেই থেকে যখন বুঝতে পারি, কেউ আমাকে উপেক্ষা করছে, তখন তাঁকে এড়িয়ে চলি। এটাই অভ্যাস হয়ে গেছে।’

নিজের ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে মাঝেমধ্যে মুখের দাগ নিয়ে জানতে চায়। রেজাউল বলেন, ‘বিশেষ করে ছেলে যখন মুখের দাগ নিয়ে কিছু জানতে চায়, তখন বুঝতে পারি, হয়তো ওদের বন্ধুরা এ নিয়ে কিছু বলেছে। ছেলে তার বন্ধুদের বলে, মুখের এ দাগের জন্যই তার বাবা দেখতে এত সুন্দর। ছেলেমেয়েরা আমার চেহারা নিয়ে কখনো মন খারাপ করে না। স্কুল থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলে ইউ আর দ্য বেস্ট বাবা।’

৪৫ বছর বয়সী রেজাউল জানালেন, এ দাগের জন্য বিয়ে করতে বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। তবে বিয়ের পর স্ত্রী এ নিয়ে মন খারাপ করা বা কোনো অভিযোগ করেননি।

ছেলেমেয়ের সঙ্গে খাবার টেবিলে রেজাউল করিম
ছবি: সংগৃহীত

এ বয়সে এসেও রেজাউল তাঁকে দেখে মানুষের অদ্ভুত চোখের চাহনি ফেরাতে পারেননি। বললেন, ‘ফেসবুকে মানুষের বেশি বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। হয়তো কারও কোনো পোস্টে মন্তব্য করেছি, তখন অন্যরা বলে, আপনি দেখতে এমন কেন, মন্তব্য করার আগে নিজের চেহারার দিকে তাকাও। এটাকে আমি মানুষের নৈতিক শিক্ষার অভাব আছে বলেই ধরে নিই।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় বড় ক্রিকেটারসহ অন্যরা অবশ্য তাঁর চেহারা এমন কেন, তা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন করেন না বলে জানান রেজাউল।

কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, না হলে এখন যে পর্যায়ে আছেন, তার চেয়েও বড় পরিসরে যেতে পারতেন বলে মনে করেন রেজাউল করিম। তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন বলে জানান।

‘নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে’

রেজাউল করিম নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে বিনা মূল্যে যখন যেখানে কোর্স করার সুযোগ পেয়েছেন, করেছেন। কম্পিউটার, ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন কোর্স করে নিজের মেধাকে ঝালিয়ে নিয়েছেন। বললেন, ‘আমার চেহারা যাতে মানুষের কাছে প্রাধান্য না পায়, সে কারণে নিজেকে যোগ্য করে তৈরি করতে সব সময় চেষ্টা করি। আর যখন যে কাজ করেছি, খুব মন দিয়ে করেছি। ফলে মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছি ও এখনো পাই।’

জন্মদাগ নিয়ে কেউ বিব্রতবোধ করলে তা থেকে বের হতে রেজাউল করিমের একটাই পরামর্শ—নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। চেহারা দিয়ে নয়, যোগ্যতা দিয়ে বিচার করার আহ্বানও জানালেন সবার প্রতি।

খেলার মাঠে ক্রীড়া আলোকচিত্রী রেজাউল করিম
ছবি: সংগৃহীত

রেজাউল করিম বললেন, ‘আমি আমাকে ভালোবেসেই এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা খুঁজে পাই। আমার বাচ্চারা আমাকে সাহসী করে। মা আমার বড় সাহস ও শক্তির জায়গা। প্রায় ৭০ বছর বয়সেও মা আমাকে আগলে রাখেন, এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেন। আর্থিক ও সামাজিকভাবে আমি এখন সুখী এবং সফল মানুষ।’

আর রেজাউলের মা সুলতানা বেগম বললেন, ছেলের জন্মের পর মুখ দেখে একেবারে মন খারাপ হয়নি, তা নয়। অনেক চিকিৎসকও দেখিয়েছেন। আরও বললেন, ‘আমার ছেলের মতো ছেলেই হয় না। সবদিক দিয়ে খুব ভালো। ছেলের বউও ভালো। সব মিলেই আমরা ভালো আছি।’

আরও পড়ুন