রফিকুন নবী: সমাজ ও জনজীবনের নান্দনিক রূপকার  

শিল্পী রফিকুন নবী। তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনুপূর্বিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়েছে গতকাল রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে
ছবি: আশরাফুল আলম

‘রনবী’ নামেই তিনি জনসাধারণের কাছে বিপুল সমাদৃত। শিল্পী রফিকুন নবীর কথা ভাবলেই জনমানসে ফুটে ওঠে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘টোকাই’–এর প্রতিকৃতি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুটি এই বিত্তবৈভবে তিলোত্তমা রাজধানীর ফুটপাতে সড়কবাতির পাশে বসে-শুয়ে খুব সহজ–সরল ভাষায় মাত্র দু-একটি কথায় বলে যাচ্ছে সমাজের পর্বতপ্রমাণ অসংগতির কথা।

শুধু চরিত্র সৃষ্টি নয়, ‘টোকাই’ নামটিও তাঁরই দেওয়া। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিচয়বোধক এই শব্দ শুধু লোকমুখে বিপুল উচ্চারিতই নয়, এখন বাংলা একাডেমির অভিধানভুক্তও হয়েছে। কার্টুনের জন্য বিপুল খ্যাতি ও জননন্দিত হলেও শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্প অন্বেষা ও কর্মপ্রয়াস বহুমাত্রিক। সুবিস্তৃত। তিনি সমাজ ও জনজীবনের এক নান্দনিক রূপকার।

শিল্পী রফিকুন নবীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনুপূর্বিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন অতিথিরা। গতকাল জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে
ছবি: আশরাফুল আলম

শিল্পকর্মের বিভিন্ন শাখায় তিনি মৌলিক অবদান রেখে যেমন আমাদের চিত্রকলাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন, তেমনি তাঁর অনবদ্য রসবোধে জারিত বিভিন্ন রচনাও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পী রফিকুন নবীর এই বহুধাবিস্তৃত কর্মময়তা তাঁর বহুবর্ণিল চিত্রকলার মতোই তাঁর জীবনকেও করে তুলেছে বর্ণাঢ্য। দেশের সংস্কৃতির অঙ্গনেই তিনি জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। জীবনের যাত্রাপথে তিনি ৮০ বছর অতিক্রম করছেন। এখনো তিনি তাঁর শিল্পসৃজন, লেখালেখি ও সমাজ সমকাল নিয়ে নানাবিধ কর্মময়তার ভেতর দিয়ে সমাজ ও স্বদেশকে আলোকিত করে চলেছেন।  

এমন এক অনন্য গুণী মানুষের জন্মদিন যেকোনো দেশেই উৎসবের উপলক্ষ হয়ে ওঠার জন্য আদর্শ। ফলে উৎসব করেই তাঁর ৮০তম জন্মদিন উদ্‌যাপনের উদ্যোগ নিয়েছে ‘শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন কমিটি’। তার সূচনা হলো গতকাল রোববার একযোগে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে ও ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কে গ্যালারি চিত্রকে তাঁর ছয় দশকের চিত্রকলার আনুপূর্বিক প্রদর্শনী দিয়ে।  

শিল্পী রফিকুন নবী।
ছবি: প্রথম আলো

শুরুর আগের শুরু

গতকাল প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিও গতানুগতিকতার গণ্ডি ভেঙে হয়ে উঠেছিল ব্যতিক্রমী। জাতীয় জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় ছিল বিকেল চারটা। প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। হেমন্তে বেলা এখন ছোট হয়ে এসেছে, তা ছাড়া বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির ফলে শহরের চিরাচরিত দুর্বিষহ যানজটও ছিল না। ফলে অতিথি অনুরাগীরা সময়মতোই এসে মিলনায়তনে আসন নিয়েছিলেন। দেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজন ও শিল্পী রফিকুন নবীর অনুরাগীদের সমাগমে জাদুঘর মিলনায়তন মিলনমেলা হয়ে ওঠে। অপেক্ষা চলছিল শুধু প্রধান অতিথির জন্য। জানানো হলো সরকারি বিশেষ কাজ থাকায় প্রধান অতিথির আসতে বিলম্ব হবে। ফলে তাঁর জন্য অপেক্ষার এই সময়টুকুতে আয়োজনে ঘটল ভিন্নতার সংযোগ।

অতিথি অনুরাগীদের অনেকেই শুভেচ্ছা জানাতে পুষ্পস্তবক এনেছিলেন শিল্পীর জন্মদিনের কথা ভেবে। তবে শিল্পীর জন্মদিন হলো ২৮ নভেম্বর। সে দিনেই জন্মদিনের আলাদা উৎসব হবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনী পর্ব যেহেতু শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছিল তাই সঞ্চালক শিল্পী আফজাল হোসেন শিল্পী রফিকুন নবীকে মঞ্চে আসার অনুরোধ করলেন। আর অতিথিদের আহ্বান জানালেন মঞ্চে এসে ফুল দিয়ে শিল্পীকে শুভেচ্ছা জানাতে।

এমন এক অনন্য গুণী মানুষের জন্মদিন যেকোনো দেশেই উৎসবের উপলক্ষ হয়ে ওঠার জন্য আদর্শ। ফলে উৎসব করেই তাঁর ৮০তম জন্মদিন উদ্‌যাপনের উদ্যোগ নিয়েছে ‘শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন কমিটি’।

শিল্পীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি একটু একটু করে আরও কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত হচ্ছিল এই পর্বে। রফিকুন নবীর অনুরোধ করলেন সভার সভাপতি ও জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন কমিটির আহ্বায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরকে একই কবিতা আবৃত্তির জন্য। তিনি মঞ্চে এসে আবৃত্তি করলেন সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘আমার পরিচয়’।

এরপর সঞ্চালক দর্শকদের জানালেন, তাঁরা শিল্পী রফিকুন নবীর কাছে কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। মাইক্রোফোন ফোন গেল দর্শকের সারিতে। এক দুই করে বেশ কয়েকজন প্রশ্ন করলেন, শুভেচ্ছা জানালেন। তাঁদের মধ্যে রফিকুন নবীর চারুকলার সহপাঠী খ্যাতনামা অভিনয় শিল্পী কেরামত মওলাও ছিলেন। শুভেচ্ছা জানিয়ে বললের বন্ধুর কৃতিত্বে তিনি গর্বিত। প্রত্যুত্তরে বন্ধুর অভিনয় খ্যাতির প্রশংসা করলেন রফিকুন নবীও।

একজন জানতে চাইলেন, দেশের চারুকলা শিক্ষার সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে তাঁরা কেমন করে কাজ করেছেন, কেমন ছিল পরিবেশ? রফিকুন নবী বললেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সহকর্মীরা ভারত ভাগের পরপরই ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চারুকলা শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন এখানে সাধারণ মানুষের আধুনিক চিত্রকলা সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণাই ছিল না।

শিল্পী রফিকুন নবীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনুপূর্বিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন দর্শনার্থীরা।  গতকাল রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে
ছবি: আশরাফুল আলম
আরও পড়ুন

রফিকুন নবী বললেন, তাঁর সৌভাগ্য যে শিল্পাচার্যের সান্নিধ্যে দেশে চারুকলা শিক্ষা ও এর প্রসারের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করতে পেরেছেন। সে সময় তাঁরা শুধু আঁকাজোকা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না। সমাজে চারুকলার প্রচার, জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে  তোলা এবং শিল্পীদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কাজটিও তাদের করে যেতে হয়েছে।

রফিকুন নবী আরেক প্রশ্নের জবাবে বললেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে শিল্পীরা নানাভাবে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার স্বাধীনতার জন্য রাজপথের আন্দোলনেও সহায়তা করেছেন, সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সেই কর্মপ্রবাহে নিজের যুক্ততার কথা উল্লেখ করে তিনি জানালেন, তখন আজকের দিনের মতো এত ছাপানো পোস্টার হতো না। মিছিল জনসভায় হাতে লেখা পোস্টার, ফেস্টুন,ব্যানার, দেয়াললিখন—এসব কাজের দায়িত্ব পড়ত চারুকলার তরুণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অলংকরণের কাজ করেছেন। এই কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পারাটা তাঁর জীবনের এক গৌরবময় অর্জন।

রফিকুন নবী তরুণদের লক্ষ্য করে বললেন, শিল্পী হতে শুধু নিয়মসিদ্ধভাবে আঁকার অনুশীলন, রংরেখার ব্যাকরণ আয়ত্ত করলেই চলবে না। সমাজ, মানুষ, সংস্কৃতি, দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ সবকিছু সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। শিল্পাচার্য এই শিক্ষাই তাঁদের দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষার উত্তরাধিকার নিয়েই তিনি কাজ করে চলেছেন। অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে জীবন ও শিল্পচর্চার ভেতর দিয়ে পেরিয়ে এসেছেন ৮০ বছর। সামনের দিনগুলোতেও চান এভাবেই সক্রিয়তায় মগ্ন থাকতে।


এভাবেই ভাবের আদান প্রদানে এক অন্য রকম উপভোগ্যতা এল মিলনায়তনের আবহে। এর মধ্যেই এলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি।

শিল্পী হতে শুধু নিয়মসিদ্ধভাবে আঁকার অনুশীলন, রংরেখার ব্যাকরণ আয়ত্ত করলেই চলবে না। সমাজ, মানুষ, সংস্কৃতি, দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ সবকিছু সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে।
রফিকুন নবী

কর্মময় জীবন

আনুষ্ঠানিক পর্বের স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান শিল্পীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তুলে ধরলেন তার সংক্ষিপ্ত জীবনী। শিল্পী রফিকুন নবীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। বাবা রশীদুন নবী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা আনোয়ারা বেগম। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়েছে তাঁদের। তবে তাঁর শৈশব–কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে পুরান ঢাকায়। ছবি আঁকতেন শৈশব থেকেই। বাবার কাছে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, বাবাও ভালো ছবি আঁকতেন। রফিকুন নবী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্ট’ এ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হন ১৯৫৯ সালে। স্নাতক ডিগ্রি নেন ১৯৬৪ সালে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সংবাদপত্রে লেখা, অলংকরণ এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা দিয়েই। সেই বছরই তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৩ সালে গ্রিক সরকারের বৃত্তি নিয়ে এথেন্সের স্কুল অব ফাইন আর্টসে তিন বছর ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে তিনি ছাপচিত্রের কাঠখোদাই মাধ্যমে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং এই উপমহাদেশেই ছিল নতুন এবং স্বতন্ত্র।   শিক্ষকতার জীবনে রফিকুন নবী অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান, চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক, অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে  তিনি সম্মানিত  হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে। শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্পকর্মের দেশে ১৩টি ও গ্রিস, ভারত, যুগোস্লাভিয়া ও মেক্সিকোতে ৪টি একক প্রদর্শনীসহ দেশ বিদেশে বহু যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে। ১৯৭৮ সালে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আঁকা তার কার্টুন ‘টোকাই’ দেশের কার্টুন শিল্পকলায় এক অতুলনীয় সংযোজনা। শিল্পকলা চর্চার পাশাপাশি উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, রসরচনা মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০–এর বেশি। শিল্পকলা ও সাহিত্য চর্চায় অবদানের জন্য ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, সাহিত্য কর্মের জন্য অগ্রণী ব্যাংক শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক পুরস্কারসহ দেশ বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।  

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে প্রদর্শনীর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানালেন গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান।

জন্মদিনের আয়োজন

চারুকলা অনুষদের ডিন ও জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যসচিব শিল্পী নিসার হোসেন তাঁর বক্তব্যে বললেন, এই প্রদর্শনী ছাড়াও শিল্পীর জন্মদিন ২৮ নভেম্বর বিকেলে চারুকলা অনুষদে জন্মদিনের উৎসব হবে। এতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,আড্ডা, আলোচনা ছাড়াও রফিকুন নবীর প্রায় ৯ হাজার কার্টুন, বইয়ের প্রচ্ছদসহ বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্ম নিয়ে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী শুরু হবে। এই দিনে ‘উনসত্তরে ছড়া’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হবে। এই বইয়ে সেই সময় দেশের প্রায় সব ছড়াকার, কবি ও লেখকদের ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল। অলংকরণ করেছিলেন রফিকুন নবী। এবার বইটিতে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও সংযোজিত হয়েছে।

শিল্পী রফিকুন নবীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনুপূর্বিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন একজন।  গতকাল রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে
ছবি: আশরাফুল আলম

অতিথিদের কথা

প্রধান অতিথি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘শিল্পী রফিকুন নবীর মতো একজন গুণীকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হয়েছি। তিনি তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ ও সমাজ সচেতনতা সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে কার্টুনের মাধ্যমে তিনি হাস্যরসাত্মকভাবে সমাজের অসংগতি তুলে ধরেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের শিল্পীরা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। রফিকুন নবীও এসব আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তরুণ প্রজন্ম তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হবে। পরে তিনি রফিকুন নবীর কার্টুনসমগ্রের চার খণ্ডের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।’

বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সমাজের দিকে তাকিয়ে তাঁর ভেতরের বাস্তবতার অনুসন্ধান করেছেন। শিল্পের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সমাজে অসংগতিগুলোকে তিনি চেখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। এর মধ্যে দিয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার বার্তা দিয়েছেন।

রফিকুন নবী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতিক,সামাজিক অবস্থা তাতে সহজ মসৃণ জীবনযাপন করা যায় না। অনেক ঘটনায় জড়িয়ে জীবন নিয়ে যে উপলব্ধি, সমাজ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি নিয়ে চেতনা ও শিক্ষকদের প্রেরণা—এসবই তাঁর শিল্পসাধনার পথ চলতে সহায়ক হয়েছে।’

এই প্রদর্শনী ও তার জন্মদিনের উদ্‌যাপন আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তা এবং তাঁর সব শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানান।

শিল্পী রফিকুন নবীর মতো একজন গুণীকে সম্মান জানাতে পেরে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হয়েছি।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী

সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, সমাজ বাস্তবতাসহ বাঙালিত্বকে তুলে এনেছে। দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর একটি শিল্পকর্ম জাতীয় জাদুঘরে প্রদান করেন ও একটি শিল্পকর্ম প্রধান অতিথিকে উপহার দেন।

গ্যালারিতে নান্দনিক ভুবন

জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে এই প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত এবং ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এবং গ্যালারি চিত্রকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকবে। প্রদর্শনীতে দর্শকেরা শিল্পীর ১৯৫৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে করা দেড় শতাধিক শিল্পকর্ম দেখার বিরল সুযোগ পাবেন।

শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, সমাজ বাস্তবতাসহ বাঙালিত্বকে তুলে এনেছে। দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আসাদুজ্জামান নূর

জাদুঘরের প্রদর্শনীর সবগুলো শিল্পকর্মই বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহক ও শিল্পীর নিজের সংগ্রহে থেকে আনা হয়েছে। ফলে এগুলো বিক্রি হবে না। চিত্রকের শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশ ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের। অল্প কিছু শিল্পকর্ম আছে বিক্রির জন্য।
১৯৫৭ সালে অষ্টম  শ্রেণিতে পড়ার সময় পেনসিলে একটি ছবি এঁকেছিলেন রফিকুন নবী। এক নারীর মাথায় চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন আরেক নারী। ‘কেশবিন্যাস’ নামের সেই ছবিই আছে জাদুঘরের প্রদর্শনীর প্রথমে। এ খানে শিল্পীর কাঠখোদাই, চারকোল, জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ রয়েছে।
যেকোনো আনুপূর্বিক কাজের প্রদর্শনীতে মোটামুটিভাবে তাঁর শিল্পযাত্রার ক্রমবিকাশের নানা পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য, গতিপ্রকৃতির বিষয়গুলো দেখার বিরল সুযোগ পান দর্শকেরা, তা ছাড়া এক সঙ্গে এমন বহু কাজ দেখার সুযোগও সচরাচর থাকে না।

দর্শকেরা এই প্রদর্শনীতে দেখতে পাবেন তাঁর বিখ্যাত টোকাই নিয়ে অ্যাক্রিলিকের বড় কারের বেশ কয়েটি শিল্পকর্ম। মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধাদের দৃশ্য এঁকেছেন বিশাল ক্যানভাসে।

শিল্পী রফিকুন নবীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আনুপূর্বিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন শিল্পী ও অতিথিরা। গতকাল জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে
ছবি: আশরাফুল আলম

সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রাম শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্পকলার একটি প্রধান বিষয়। তিনি গভীর মমতা ও অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এই আমজনতার জীবনকে দেখেছেন। উপলব্ধি করেছেন বাস্তবতা। সেই উপলব্ধিই ক্যানভাসের বিশাল পরিসরে তুলে এনেছেন শৈল্পিক সুষমায়। ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষ, আটপৌরে মধ্যবিত্ত পরিবারের যূথবদ্ধ জীবন তাঁর শিল্পে এসেছে বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তি নিয়ে।

১৯৫৭ সালে অষ্টম  শ্রেণিতে পড়ার সময় পেনসিলে একটি ছবি এঁকেছিলেন রফিকুন নবী। এক নারীর মাথায় চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন আরেক নারী। ‘কেশবিন্যাস’ নামের সেই ছবিই আছে জাদুঘরের প্রদর্শনীর প্রথমে।

মা ও শিশু এঁকেছেন অনেক রকম বিন্যাসে। অপত্য স্নেহ মমতার নিবিড় বন্ধনের এক চিরন্তন মাধুর্যমণ্ডিত রূপ উদ্ভাসিত হয়েছে তার রংতুলির স্পর্শে।

রেলগাড়ি তার আরেকটি প্রিয় বিষয়। দর্শকেরা দেখতে পাবেন গ্রামীণ দিগন্তের পটভূমিতে ছুটছে ট্রেন। আছে ব্যস্ত স্টেশন। প্রকৃতির দৃশ্যে মহিষ, রাখল জেলে আর নাগরিক পাখি কাক তাঁর কাজে উঁকি দিয়েছে বারে বারে। দেশের প্রকৃতিকে তিনি নানা মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় তুলে এনেছেন।

প্রকৃতির দৃশ্যে মহিষ, রাখাল, জেলে আর নাগরিক পাখি কাক তাঁর কাজে উঁকি দিয়েছে বারেবারে। দেশের প্রকৃতিকে তিনি নানা মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় তুলে এনেছেন।

বহু রঙের বড় আকারের কাঠখোদাই কাজের জন্য রফিকুন নবী যেমন পথিকৃৎ , তেমনি তিনি অনবদ্য জলরঙের কাজের জন্যও। বাংলার নিসর্গ, বিশেষ করে সুন্দরবন, নদীর চর, মাছরাঙা পাখি, জলেদের নৌকা জলরঙে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নয়নাভিরাম রূপে।

আবার চারকোলে তিনি অনেক বড় পরিসরে পূর্ণাঙ্গ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। সচরাচর চারকোলে এমন বড়মাপের পরিপূর্ণ চিত্রকলার রীতি এখানে দেখা যায় না।
বিদগ্ধজনেরা বলেছেন, শিল্পী রফিকুন নবী বিভিন্ন মাধ্যমে বহু নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। তিনি নিজেকে কোনো একটি ধারা বা রীতিতে সীমিত না রেখে নিজেই নিজেকে অতিক্রম করতে সফল চেষ্টা করেছেন। দর্শকেরা এই বরেণ্য শিল্পীর সেই অনবদ্য কাজগুলো দেখতে পাবেন  প্রদর্শনীতে এলে।