ফরিদপুরে নির্মাণাধীন সেতুর পাইলিংয়ের মাটি ধসে তিন শ্রমিক নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন

ফরিদপুরে নির্মাণাধীন সেতুর পাইলিংয়ের খনন করা মাটি ও খালপাড় ধসে সাত শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। বুধবার সদরপুর উপজেলার ভাষাণচর ইউনিয়নের জমাদ্দার ডাঙ্গী এলাকায়
ফাইল ছবি

ফরিদপুরের সদরপুরের ভাষাণচর ইউনিয়নের জমাদার ডাঙ্গী এলাকায় একটি খালের ওপর সেতুর নির্মাণকাজের সময় মাটি চাপায় তিন নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ওই তিন নির্মাণশ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠন করা তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে এডিএম (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) বিপুল চন্দ্র দাসকে। তবে তাঁর ছুটিজনিত সময়ে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. লিটন আলী। কমিটির অপর তিন সদস্য হলেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বরুন কুমার বিশ্বাস, সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান ফারহান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম সাহা। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। দুপুরে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।

সেতুর নির্মাণকাজের সময় মাটি চাপা পড়ে তিন নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আসিফ ইমতিয়াজ কনস্ট্রাকশন বা এই কাজ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে এলাকাবাসী বলেছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা এলজিইডি এই দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেছেন, ভিডিও ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সবার ব্যর্থতা রয়েছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে এভাবে দিনের বেলায় তিনটি লোক মাটি চাপা পড়ে মারা যেতে না। এ ধরনের বড় প্রকল্পের কাজ যেসব সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত ছিল দৃশ্যত দেখা যায় সেসব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি।

ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, কাজের শুরু থেকেই ঝুঁকি ছিল। কিন্তু ঠিকাদার জোর করে কাজ করেছে। এ কাজ ঠিকাদারের পক্ষে দেখাশোনা করেছেন মো. সিদ্দিক মিয়া। ঠিকাদার আসিফ ইমতিয়াজ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াকের ভাই। এই ভয় দেখিয়ে সিদ্দিক আমাদের চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলার হুমকি দিয়ে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে কাজ করে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা সদরপুর কলেজের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আসলাম (২৪) বলেন, কাজের সময় খালের পাড়ের নিচে থেকে মাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে পাশের দোতলা ভবনসংলগ্ন খালের পাড় ধসে পড়ে মানুষ মারা গেছে। ওই বাড়ি বা খালের পাড় রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ফরিদপুর সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের কুজুরদিয়া গ্রামের সুমন খান বলেন, অল্প জায়গায় ২৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের সেতু করতে গিয়ে এলাকার লোকদের জমিতে কাজ করতে হয়েছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে ঠিকাদারদের লোকজন ও এলজিইডির প্রকৌশলীদের বিরোধ চলে আসছিল। যে পাড়ের মাটি ধসে পড়েছে, সেই পাড়ে সেতুর ভিত্তি ১১ মিটার করতে গিয়ে নিচের দিকে দেড় থেকে দুই ফুট মাটি সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। এ জন্য খালের পাড়ের মাটি ধসে পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

ওই নির্মাণকাজে নিয়োজিত ওই একই এলাকার আরেক শ্রমিক আরিফ শেখ (২৫) বলেন, প্রথমে খালের পাড়ের এক অংশ ধসে পড়ে। এতে কয়েকজন শ্রমিক চাপা পড়ে অন্য শ্রমিকেরা দ্রুত সরে গেলেও জাবেদ আটকা পড়ে। ওই সময় নিহত অপর দুই শ্রমিক অন্তর ও জুলহাস দ্রুত জাবেদকে উদ্ধার করতে গেলে তাঁদের ওপরে পাড়ের বড় আরেকটি মাটির অংশ ধসে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

এ কাজটি তদারকিতে নিয়োজিত ছিলেন সদরপুরের উপসহকারী প্রকৌশলী ওয়াজিবুল্লাহ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আগে ওই জায়গায় যে সেতু ছিল, সেটির প্রস্থ ছিল দুই মিটার। সেটি ভেঙে যাওয়ায় নতুন এই সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন সেতুটির যে নকশা করে দেওয়া হয়, তার প্রস্থ ৯ দশমিক ৮ মিটার। এত বড় প্রস্থ বিশিষ্ট সেতু করার জন্য ওই জায়গা জুতসই ছিল না। এ কারণে এলাকাবাসীর জায়গায় গিয়ে ঢুকতে হয়েছে। তিনি বলেন, তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার সতর্ক করার পরও গভীর গর্ত করার পর খালের পাড় রক্ষার জন্য কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। নিলে এ ঘটনা ঘটত না।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান আসিফ ইমতিয়াজকে আজও বারবার ফোন করার পর তিনি ফোন না ধরায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কথা হয়েছে ওই কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদার মো. সিদ্দিক মিয়ার সঙ্গে। সিদ্দিক মিয়া বলেন, এলজিইডি অন্যের জায়গায় কাজ করে। ঠিকাদাররা দ্রুত কাজ শেষ করতে চান। এ কাজের মেয়াদ ছিল ১৮ মাস। দুই মাস আগে এ কাজ শুরু হয়। আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে শেষ হতো। তিনি বলেন, বুধবারই ঢালাই দেওয়ার কথা ছিল। এর জন্য পাড় ধসে পড়ার ব্যাপারে প্রতিরক্ষাকাজ হয়নি। তিনি বলেন, যেসব শ্রমিক নিহত হয়েছেন, তাঁদের এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এককালীন টাকা দেওয়াসহ আজীবন খোঁজখবর নেওয়া হবে।

সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত গোলদার বলেন, স্বজনদের আবেদনে বিনা ময়নাতদন্তে বুধবার সন্ধ্যায় মৃতদেহ স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের মামলা করার সুযোগ আছে। যে ঘটনা ঘটেছে, তা সবার জানা। এখানে ময়নাতদন্ত অবশ্যক নয়।

আরও পড়ুন