চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর কাজ কেমন ও কীভাবে চলছে, তা মঙ্গলবার ঘুরে দেখি। চাক্তাই খাল, রাজাখালী খালসহ বেশ কয়েকটি খাল পরিদর্শন করি। খালগুলোতে চলমান কাজ পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে, প্রকল্পগুলোর আওতায় ইতিমধ্যে অনেক কাজ হয়েছে।
খালের মুখে রেগুলেটর (জোয়ার প্রতিরোধক ফটক) ও পাম্প স্থাপনের অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে গেছে। খালগুলো থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দুই পাশে প্রতিরোধদেয়ালের কাজও হয়েছে। রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। সাদা চোখে দেখলে মনে হবে, প্রকল্পগুলোর বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
তাহলে এত অগ্রগতি হওয়ার পরও কেন চট্টগ্রাম ডুবছে? কেন ফল পাওয়া যাচ্ছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেটি পেলাম, যেসব কাঠামোর কাজ হয়েছে, তা তো জোয়ার ঠেকাতে পারছে না। আর যেটি সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে হচ্ছে, তা হলো জলাবদ্ধতা নিরসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার দিয়ে যেসব কাজ আগে শেষ করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি।
যেমন রেগুলেটরগুলো এখনো পুরোপুরি ফাংশনাল (চালু) হয়নি। জোয়ারের সময় বৃষ্টি হলে খাল থেকে পানি নদীতে নিষ্কাশনের জন্য পাম্প মেশিন স্থাপন করা হয়নি। পানিপ্রবাহ নির্বিঘ্ন রাখার জন্য খালগুলোও প্রস্তুত ছিল না।
আর পাহাড় থেকে আসা বালু-কাদা আটকানোর জন্য যেসব সিল্টট্র্যাপ (কাদা বা বালুর ফাঁদ) নির্মাণ করার কথা, সেগুলোর কাজও সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। আর ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে প্রকল্পগুলোর আওতায় কোনো ধরনের জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। এবার যদি অন্তত রেগুলেটর ও পাম্প মেশিন চালু থাকত, তাহলে জলাবদ্ধতা কিছুটা হলেও নিরসন করা যেত।
কয়েকটি খালে দেখলাম রেগুলেটরের কারণে খালের মুখের প্রশস্ততা কমে গেছে। এতে তো পানিনিষ্কাশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে আর খালগুলো ভরাট হয়ে যাবে। এভাবে রেগুলেটর নির্মাণ এবং খালের পাশে জলাধার নির্মাণের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে সিডিএর প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলীকে ফোন দিই। ওই প্রকৌশলী জানিয়েছেন, রেগুলেটরগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। আর জলাধার নির্মাণের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
এটি আমার কাছে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। এমনিতেই শহরের নিচু জমিগুলো ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। একসময় এগুলো প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে কাজ করত। এগুলো যেহেতু নেই, তাই খালের পাশে নতুন করে ১০-১২টি জলাধার নির্মাণের জন্য জোর দিয়ে আসছিলাম আমরা। তা তো হয়নি, বরং যে তিনটি জলাধার ছিল, সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
এখন পানি জমার জায়গা থাকল না। এতে অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের সময় পানিনিষ্কাশনে পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়লাম। পাম্পের ওপর শতভাগ নির্ভর হওয়া খুব ব্যয়বহুল ও অবিশ্বস্ত। কারণ, যান্ত্রিক ত্রুটির সমস্যা থাকতে পারে, যন্ত্রাংশের সংকট থাকতে পারে, জ্বালানি না থাকতে পারে, জনবল অনুপস্থিত থাকতে পারে। আবার কোনো ধরনের যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিলে তা ঠিক করার লোকের অভাব থাকতে পারে। তখন আসলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে।
সব হতাশার কথা না বলি। এখন পর্যন্ত যেসব কাজ হয়েছে, চাইলে আগামী এক বছরের মধ্যে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব। এ জন্য সংস্থাগুলোকে প্রকল্পগুলোর কাজ নিবিড় ও আন্তরিকভাবে করতে হবে। আর শুধু অগ্রগতির কথা না ভেবে ফলভিত্তিক কাজে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাজ করে যেতে হবে। রেগুলেটরগুলো পুরোপুরি চালু করতে হবে। সিটি করপোরেশনের নতুন খাল খননের কাজ সম্পন্ন হলে একটি বড় এলাকার মানুষ সুফল পাবেন।
এ ব্যাপারে প্রকল্পগুলোকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তদারকি দরকার। কেননা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। স্থানীয় পর্যায়ে চাইলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।
আমি বারবার বলছি, সব এলাকায় একসঙ্গে কাজ না করে একেকটি ড্রেনেজ এলাকা ধরে ধরে কাজ করতে হবে। এসব এলাকার কোন কোন জায়গায় পানি নামার পথে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, কোনো কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে কি না, তা চিহ্নিত করে কাজ শেষ করতে হবে। এভাবে একটি একটি এলাকা ধরে কাজ করলে জলাবদ্ধতার সুফল পাওয়া সম্ভব।
দেলোয়ার মজুমদার, সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম কেন্দ্র, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ